X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

 গরুর মাংস যেন আমাদের খেয়ে না ফেলে!

আমীন আল রশীদ
০৮ জুন ২০২১, ১৯:১৫আপডেট : ০৮ জুন ২০২১, ১৯:১৫

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশে গরুর মাংস এবং গোমূত্র বিষয়ক আলোচনা সেভাবে চোখে পড়ে না বা এ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি নেই। তবে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ক্যান্টিনে রেওয়াজ ভেঙে গরুর মাংস রান্নার প্রতিবাদ এবং সেই প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় যে তোলপাড় চলছে, তা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। কারণ, অনেকে এটিকে সাম্প্রদায়িক উসকানি বলছেন। অনেকে বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে এই ধরনের প্রতিবাদ অযৌক্তিক। কেউ কেউ বলছেন এটা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত।

এ প্রসঙ্গে শুরুতেই বলা দরকার, ব্যক্তিগত হেঁশেল, বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্যান্টিনে কিছু মৌলিক তফাৎ রয়েছে। আপনি আপনার ব্যক্তিগত হেঁশেলে কী রান্না করবেন, সেই এখতিয়ার আপনার। বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্টে কী রান্না হবে, সেটি ওই রেস্টুরেন্ট মালিকের কৌশল। এখানে তার কাছে মূল বিবেচ্য ব্যবসা। তিনি যদি তার রেস্টুরেন্টে ‘নো বিফ’ লিখে রাখলে বেশি ক্রেতা আসবে বলে মনে করেন, তাহলে তিনি সেটিই করবেন। আবার কোনও রেস্টুরেন্টের মালিক যদি মনে করেন, শুধু গরুর মাংস বিক্রি করাই তার জন্য লাভজনক, তিনি তাই করবেন।

প্রাতিষ্ঠানিক ক্যান্টিনের হিসাব আলাদা। সাধারণত সরকারি-বেসরকারি অফিসের ক্যান্টিনগুলো কোনও না কোনও তৃতীয় পক্ষ লিজ নিয়ে চালায়। বিনিময়ে তারা ওই প্রতিষ্ঠানকে একটি নির্দিষ্ট ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি অফিসের গ্যাস-পানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। একেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একেক পক্ষের একেকরকম চুক্তি থাকে। ফলে যারা ওই ক্যান্টিন লিজ নেয়, তারা সেখানে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখবে এটি যেমন সত্যি, তেমনি যেহেতু এটি শতভাগ বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট নয়, ফলে ওই ক্যান্টিনে কী রান্না হবে না হবে, সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের কিছু দিকনির্দেশনাও থাকে। কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না হবে না—তাহলে সেটিই সই। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা গরুর মাংস রান্নার দাবি জানাতে পারেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যদি সব ধর্মের মানুষের অনুভূতি বিবেচনায় নিয়ে সেখানে গরুর মাংস রান্না না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে খুব বেশি বিতর্কের সুযোগ নেই।

সুপ্রিম কোর্ট ক্যান্টিনে হঠাৎ করে গরুর মাংস রান্নার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আইনজীবী ঐক্য পরিষদ যে প্রতিবাদ করছে এবং তারা কর্তৃপক্ষকে যে চিঠি দিয়েছে, সেটি এ কারণে অযৌক্তিক নয় যে এখানে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের লোক খাওয়া-দাওয়া করেন। হিন্দুদের একটি বিরাট অংশই গরুর মাংস খান না। এটি বিবেচনা করেই হয়তো কর্তৃপক্ষ এই ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন এবং এভাবেই চলে আসছিল। কিন্তু চিঠিতে বলা হচ্ছে, গত ২৯ ও ৩০ মে রাতে সুপ্রিম কোর্ট বার ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না করা হয় এবং রাতে তা খাবারের জন্য পরিবেশন করা হয়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ঐতিহ্যগতভাবেই এর সৃষ্টিলগ্ন থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে কখনও এই ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না ও পরিবেশন করা হয়নি। তাই হঠাৎ এ ধরনের তৎপরতায় তারা বিস্মিত ও হতবাক।

তবে এই চিঠির পরে ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না ও পরিবেশনের পাল্টা দাবি জানিয়ে আরেকটি চিঠি দিয়েছেন আরেকজন আইনজীবী। চিঠিতে তিনি গরুর মাংসের গুণাবলি এবং এর আইনি বৈধতার বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা গরুর মাংস খাবেন না, তাদের জন্য বিকল্প রাখারও দাবি জানিয়েছেন।

মনে রাখা দরকার, সুপ্রিম কোর্ট ক্যান্টিন কারও ব্যক্তিগত হেঁশেল বা শতভাগ বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট নয়। বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিন। তা সত্ত্বেও এখানে গরুর মাংস রান্নার পক্ষে-বিপক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব প্রতিক্রিয়া ও মতামত আসছে, তাতে অনেকে সৌজন্য এবং সংবেদনশীলতার মাত্রা অতিক্রম করছেন। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে গরুর মাংসের বিরোধিতা কেন? তারা কি দেশে গো মাংস নিষিদ্ধের দাবি তুলছেন ইত্যাদি। বিষয়টি বোধ হয় এত জটিল নয়। কারণ, এই ক্যান্টিনটি দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। এখানে বিচারকরা কাজ করেন। কোনটি ভালো কোনটি মন্দ; কোনটি ন্যায়, কোনটি অন্যায়—সেটির সুরাহা করা হয় যেখানে, সেখানের ক্যান্টিনে গরুর মাংসের পক্ষে-বিপক্ষে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে, সেটির সুরাহা দ্রুতই হবে বলে আশা করা যায়।

কিন্তু এই ইস্যুতে তৈরি হওয়া বিতর্কের ঢেউ যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়েছে এবং সেখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তারও সুরাহা করা জরুরি।

হিন্দুদের একটি অংশ বা ধরা যাক বড় অংশই যেহেতু গরুর মাংস খান না, ফলে তাদের এই অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কোনও বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্যান্টিন যদি গরুর মাংস পরিবেশন থেকে বিরত থাকে, তাহলে সেটি তাদের এখতিয়ার এবং অবশ্যই এটি সাধুবাদযোগ্য। একইভাবে শূকরের মাংস ও মদ ইসলামে হারাম। সুতরাং কোনও অমুসলিম প্রধান দেশের কোনও বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্যান্টিন যদি শূকরের মাংস ও মদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকে, তাহলে সেটি তাদের এখতিয়ার এবং এটিও সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনও অমুসলিম প্রধান দেশের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যান্টিনে শূকর ও মদ পরিবেশন বন্ধের দাবি জানিয়ে যদি সে দেশের মুসলিমরা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ সেটি আমলে নেবে? নেবে কি নেবে না—সেটি তাদের এখতিয়ার। কিন্তু এই দাবি জানানোর অধিকার মুসলিমদের রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ক্যান্টিনেও গরুর মাংস পরিবেশন না করার দাবি জানানোর অধিকারও হিন্দুদের রয়েছে। একইভাবে এই ক্যান্টিনে গরুর মাংস পরিবেশনের দাবি জানানোটাও অযৌক্তিক নয়। কিন্তু আসলেই এখানে গরুর মাংস পরিবেশন করা হবে কী হবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একান্তই আইনজীবী সমিতির।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পৃথিবীর সব রেস্টুরেন্ট তো বটেই, বাংলাদেশেরও সব রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। অনেক বড় বড় রেস্টুরেন্টেই লেখা থাকে ‘নো বিফ’। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমসহ সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনেই গরুর মাংস বিক্রি হয় না। সুতরাং কেউ যদি গরু খেতে চায়, তার জন্য আরও অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। কেউ তাকে বাধা দিচ্ছে না। অর্থাৎ গরুর মাংস খে‌তে হিন্দু‌দের‌ যেমন বাধ‌্য করা যা‌বে না, তেমনি মুসলমান‌দের‌ও খে‌তে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।

সুতরাং সুপ্রিম কোর্ট ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না করলেই যে সেটি হিন্দুদের বা মুসলমানদের মধ্যেও যারা গরুর মাংস খান না, তাদের খেতে বাধ্য করা হবে—এমন নয়। আবার কিছু লোক খায় না বলেই যে সেখানে গরুর মাংস রান্না করা যাবে না, এমনটিও যুক্তিযুক্ত নয়। তবে কোন প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনে কী রান্না হবে বা হবে না—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ওই প্রতিষ্ঠানের।

পৃথিবীর সব রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। পৃথিবীর সব রেস্টুরেন্টে শূকরের মাংসও বিক্রি হয় না। পৃথিবীর সব মুসলমান যেমন গরু খায় না, তেমনি হিন্দুদের অনেকে আছে যাদের গরুর মাংস খাওয়ায়ও আপত্তি নেই।  সুতরাং যে গরুর মাংস খেতে চায় তার জন্য অনেক বিকল্প আছে। সুপ্রিম কোর্ট ক্যান্টিনে গিয়েই তাকে গরুর মাংস কেন খেতে হবে? তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের এই ক্যান্টিনকে আর দশটি রেস্টুরেন্ট বা ক্যান্টিনের সঙ্গে মেলোনোর সুযোগ নেই। সুতরাং এই ক্যান্টিনে যারা নিয়মিত খেতে আসেন তাদের মধ্যে এক শতাংশ মানুষও যদি মনে করেন যে এখানে গরুর মাংস রান্না হলে সেটি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে, তাহলে তাদের সেই অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই সঙ্গত। কারণ, যারা গরুর মাংস খেতে চান, তাদের জন্য আরও অনেক বিকল্প রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আশপাশে অনেক বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট আছে।

কেউ কেউ বলছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে হিন্দুদের জন্য আলাদা রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হোক। বস্তুত এটি আরও বেশি সাম্প্রদায়িক চিন্তা। কারণ, সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশ যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে, সেখানে সুপ্রিম কোর্টের মতো পবিত্র জায়গায় দুই ধর্মের মানুষের জন্য দুটি ক্যান্টিন চালু করা অন্যায়। বরং ক্যান্টিন একটিই থাকবে এবং সেখানে সব ধর্মের মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে খেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করাই কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। সামান্য এক গরুর মাংস ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়া কাম্য নয়। কারণ, যারা এই ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না না করার দাবি জানাচ্ছেন, তারা দেশের সব রেস্টুরেন্টে গরুর মাংস রান্না বা গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধের দাবি তোলেননি। সেই দাবি তুললে যে হালে পানি পাবে না—সেটিও তারা জানেন।

অতএব, ভবিষ্যতে যদি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না হবে, তাতেও সমস্যা থাকার কথা নয়। যে গরুর মাংস খাবে না, সে অন্যটা খাবে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এটিকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, সুপ্রিম কোর্ট ক্যান্টিনে গরুর মাংস বিষয়ক তর্কটা ক্রমশই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে গরু খাওয়া যাবে না কেন—এই জাতীয় আলোচনায় বাঁক নিচ্ছে, যা আরও ভয়াবহ। কারণ ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ বলে কোনও কথা নেই। আপনি যখন নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাববেন, তখন বাকিরা সংখ্যালঘু। এটাই সাম্প্রদায়িকতা। সবার পরিচয় মানুষ। কে সংখ্যাগুরু আর কে সংখ্যালঘু সেই বিবেচনাটিই অমানবিক। আপনি এই দেশে সংখ্যাগুরু তো পাশের দেশে সংখ্যালঘু। মোদ্দা কথা হলো, কেউ গরুর মাংস খাবে, কেউ খাবে না। কিন্তু মাংস যেন আমাদের খেয়ে না ফেলে।

লেখক: সাংবাদিক।

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ