X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পটভূমি ও ‘বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট’

মাকসুদুল হক
১১ জুলাই ২০২১, ১৫:০০আপডেট : ১১ জুলাই ২০২১, ১৬:০৬

মাকসুদুল হক ‘জগৎ মুক্তিতে ভোলালেন সাঁই
ভক্তি দাউও যাতে তোমার
রাঙা চরণ দুটি পাই’—ফকির লালন শাহ

১. যুদ্ধের আপডেট ও ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য পূর্বাভাস ৮-১০ জুলাই ২০২১:

১ জুলাই ২০২১ লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর যেসব তথ্য উপাত্ত আমাদের নজরে এসেছে, তাতে স্পষ্টত প্রতীয়মান এ সপ্তাহের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারের মূলসূত্র ভয়াল করোনাভাইরাস মানবদেহে ওঁৎ পেতে ছিল ৩ সপ্তাহ আগে। অর্থাৎ গেলো ১২ থেকে ১৮ জুন ২০২১ যাদের দেহে ভাইরাস ছিল তাদের দ্বারা এইবারের ‘ওয়েভ’ সৃষ্টি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ১০ জুলাই, ২০২১ যাদের দেহে ভাইরাস সংক্রমণ করছে তাতে দৈনিক মৃত্যুর হার ৯ জুলাই ২০২১– সর্বোচ্চ ২১২ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এরপরে যা আসবে তাকে ‘ওয়েভ’ বা ঢেউ বললে মারাত্মক ভুল হবে। আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে এক ‘করোনা সুনামি’ ও তা কোরবানি ঈদ অতিক্রম করে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি অবধি স্থায়ী থাকার জোর সম্ভাবনা। পরিস্থিতির এই ভয়ানক ‘অবনতি’ থেকে ‘রাষ্ট্রীয় দুর্যোগে’-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিধায় এই কলামে আমার ২৭ জুনের ২০২১ প্রেরিত প্রস্তাবনাগুলো আবার পুনর্ব্যক্ত করছি:

ক. দেশজুড়ে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করা।
খ. ভ্যাকসিনের জন্য বয়স ৪০-এর নিচের ক্যাটাগরির কথা বিবেচনা করা ও কর্মসূচি সম্পন্ন না হওয়া অবধি দেশের প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টেস্ট করা।
গ. আসন্ন কোরবানি ঈদে পশুর হাট বন্ধ ঘোষণাসহ ভারতীয় গরুর চোরাচালান রুদ্ধ করা।
ঘ. পরিস্থিতি বেগতিক হলে কারফিউ জারিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকারি নির্দেশ অমান্যকারী, বিশৃঙ্খলাকারীদের ‘দেখা মাত্র গুলি’ করার ক্ষমতা প্রদান।

২. চলমান করোনা যুদ্ধের ধারাভাষ্য ও বিবরণী:

আমি এই মহামারিকে আগাগোড়া সম্মুখ রণযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছি। যুদ্ধে প্রথম বোমা হামলা হয় যেকোনও দেশের রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে। প্রথম টার্গেট এবার রাষ্ট্রের মাথাগুলো এবং প্রতিষ্ঠানকে ঘাবড়িয়ে দিয়ে সরকার ও জনগণের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি করে নতুন আখ্যায়িকা স্থাপন করা। প্রতিক্রিয়া বা রি-অ্যাকশন পর্যবেক্ষণ করা– এরপর চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর গ্যাপ (ফাঁক) খোঁজ করা। পেয়ে গেলে তা সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে সমগ্র দেশজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়া। ২০২১-এ শত্রুর কাঙ্ক্ষিত গ্যাপ সৃষ্টি হলো রমজান ঈদের ছুটিতে। ঢাকা শহরের মানুষ ডেল্টাকে ছড়িয়ে দিলো জেলা শহর, মফস্বল ও গ্রামগঞ্জে। বাকিটা ইতিহাস।

২০২০-এ যা কিছুই ঘটেছে, তা ছিল যুদ্ধের দামামা বা প্রাথমিক সূচনা সংকেত। বাংলাদেশ তা প্রচণ্ড দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে খুব অল্প সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের কাছাকাছি নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল নগণ্য। দেশের ৮০ ভাগ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থকষ্টে থাকলেও কখনোই অনাহারে ছিল না, বা দুর্ভিক্ষ এমনকি মঙ্গার মতো পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি।

কিন্তু শত্রুকে এতটা অবমূল্যায়ন করা ছিল রাষ্ট্র ও জনগণের এক বিশাল আত্মঘাতী ভুল। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে জেনেও জরুরি রসদ যেমন আইসিইউ, অক্সিজেন, ওষুধ, খাদ্য, পানি, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, নার্স, বিছানা ইত্যাদি আগাম মজুত না রাখা ও সম্ভাব্য ক্যাজুয়ালটি কী হতে পারে– তা হ্যান্ডেল করার অবকাঠামোগত বা মানসিক প্রস্তুতি আমাদের একবারেই ছিল না, এখনও নেই।

প্রাথমিক বিজয়ের পর আমরা আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রসাদের মচ্ছবে বিভোর হয়ে পড়ি। ‘আমরা করোনার চেয়ে অধিক শক্তিশালী’ মার্কা অভিনন্দন সূচক একে-অপরের পিঠ চাপড়ানোতেই ছিলাম বেশি ব্যস্ত। ওই একই ভুল করেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, যার খেসারত আমাদের অঞ্চলসহ সমগ্র বিশ্বে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ দাপটে ঢুকে পড়ে আমাদের ভাগ্যলিখন সম্পূর্ণ পাল্টে ফেললো।

এখন শত্রু আমাদের চতুর্দিকে অবরুদ্ধ রাখেনি, সে ঘরের ভেতরে, বাইরে, জলে, স্থলে ডাঙায় নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে শেষ ছোবলটি দেওয়ার জন্য। লাশের গন্ধ না ছড়ালেও– বাতাস ভারী হয়ে আসছে।

৩. অভ্যন্তরীণ শত্রু চিহ্নিতকরণ:

এই ভয়াল দুর্যোগের সময়ে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লক্ষ করছি, দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তব শত্রুদের নির্লজ্জ আস্ফালন। যেখানে রক্ত-মাংসের মানুষ মরছে– আর আমরা কিছুই করতে পারছি না, সেখানে একে অপরকে দোষারোপ করা, ‘বিতি-কিচ্ছিরি’ কথাবার্তার চালাচালির করার সময় যে এখন নয়– তা কি আমাদের চিন্তায় একবারও আসে? 

শুধু সমস্যা আর সমস্যার কথা দিনরাত ‘বকবক’ করছি এবং স্থূল ও উটকো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ‘আমরা কত ভালো, ওরা কত খারাপ’ ঠাওরাচ্ছি ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিলি করছি। কিন্তু এত মেধাবী জাতি হওয়া সত্ত্বেও এই মহামারিকে রুখে দেওয়ার জন্য কোনও সম্ভাব্য সমাধান কী হতে পারে–তা নিয়ে কি কারও কোনও মাথা ব্যথা আছে? এই লজ্জাকর ব্যর্থতা কি শুধু সরকারের নাকি তার দায়ভার আমাদের সবার কাঁধেও বর্তায়?

৪. দেশের রুপক ‘স্বরূপ’ নাকি ‘ভাবমূর্তি’?

আর দেশের তথাকথিত ‘ভাবমূর্তি’? বাবারে বাবা–সেকি বিশাল এক ‘হেডঅ্যাক’!

আরে মশাই এই গালাগালি ও পিঠ ‘চুলকাচুলকি’ করতে করতে যে করোনা সুনামি হয়ে ‘নিউ বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট’ সমগ্র বিশ্বে আবির্ভাব ঘটাবে, তা কি আপনাদের আক্কেলে একটুও ঢুকছে?

দয়াল আমাদের ক্ষমা করুক– যদি তেমন দুর্ঘটনা ঘটে যায়, আপনাদের ভাবমূর্তির ‘মুখ’ যে ধ্বংস হয়ে, চুরমার হয়ে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হবে– তা নিয়ে ‘ভাব মারার’ ফুরসত এ অবধি কি পেয়েছেন?

কোথায় যাবে আপনাদের রফতানি শিল্প– কোথায় যাবে গার্মেন্টস শিপমেন্ট? বাংলাদেশ থেকে একটা মানুষ বের না হতে পারলে আপনাদের তো কোনও সমস্যা নেই। আপনাদের টাকা আছে ও চিত্তবিনোদন, মনোরঞ্জনের জন্য প্রচুর দেশীয় স্থাপনা রয়েছে। তবে বিদেশে অবস্থানরত হতদরিদ্র অভিবাসী শ্রমিকদের ঘাড় ধরে ধরে যে বিতাড়িত করা হবে– তখন কি ছুঁক ছুঁক শব্দ করে ‘আহারে বেচারা’ বলে মায়াকান্না করবেন?

তাও মেনে নিতাম -কিন্তু সবুজ পাসপোর্ট দেখা মাত্রই বিদেশিরা যে আপনাদের সঙ্গে কুষ্ঠ রুগীর মতো ‘ছেঁচে’ আচরণ করবে– তখন আপনাদের এই ভাবের ‘মুখ’খানা  কোথাই লুকাবেন স্যার?

আমাদের দয়াল সৃষ্টিকর্তা সীমা লঙ্ঘন করা বরদাশত করেন না, তথাপি আপনাদের ঔদ্ধত্যকে বরদাশত করেছেন কেবল ৮০ ভাগ হতভাগা জনগোষ্ঠীর মুখের দিকে তাকিয়ে। গরিবকে ঠকিয়েও আপনারা পেয়েছেন দয়ালের আশীর্বাদ। আপনাদের হাজার কোটি কালো টাকার মাত্র ১০০ টাকার ‘বরকত’ হলো সেই আশীর্বাদ। একবার কি ভেবেছেন যে দয়াল আপনাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আশীর্বাদ করেছেন?

৫. ‘খয়রাত’ নাকি ‘সাদকায়ে জারিয়া’?  ‘দ্য চয়েস ইজ ইউরস’:

তাই অনতিবিলম্বে সেই আশীর্বাদ ধরে রাখার জন্য শুকরিয়া আদায় করুন আর এই করুণ করোনার সময় ঝাঁপিয়ে পড়ুন দরিদ্র মানুষের জীবন রক্ষায়। নিদেনপক্ষে আসন্ন কোরবানি ঈদে মানুষ দেখানো লক্ষ টাকার নিরীহ পশু হত্যা না করে অন্তরের পশুটিকে হত্যা করুন। সঞ্চিত অর্থ দিয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করুন। কারণ, রাষ্ট্রীয় খাদ্যভাণ্ডার আপনাদের ভাণ্ডারের ন্যায় ‘অফুরন্ত’ নয়।

আমাদের হিসাবে কেবল এই ঈদে সঞ্চিত অর্থের মূল্য অতি নিম্নে হলেও ৩৫০ কোটি টাকা। আপনাদের একজনকে দেখাদেখি সবাই যদি এই কাজটি করেন তা হবে ‘সাদকায়ে জারিয়া’– এবং নিশ্চিত থাকেন পাঁচ বছরের ভেতরে বাংলাদেশে একটিও গরিব থাকবে না। ‘নিম্ন আয়’ থেকে ‘মধ্যম আয়’-এর দেশ মোটেও না- আমরা পোলভল্ট করে ধনী রাষ্ট্রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ ঘষাঘষি করবো ইনশাআল্লাহ!

তবে কৃপা আপনাদের ওই অতি ভঙ্গুর ধর্মীয় অনুভূতির ‘ভূত’টিকে শক্ত শিকল দিয়ে আটকে রাখুন ও তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন প্লিজ। এই ভুতুড়ে সময়ে বাড়তি কিছু ভূতকে ‘খোশ আমদেদ’ জানানো দয়াল বরদাশত করবেন না।

আরেকটা কথা, দয়াল ভজনার জন্য যেকোনও দৃশ্য বা অদৃশ্য আঁকার যথা ‘মূর্তি’ বা ‘ভূত’ দুটোই ‘শিরক’। ইমান প্রমাণ করার জন্য তা গুরুত্বহীন ও অপ্রয়োজনীয়।

৬. অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ লক্ষ নব্য রাজাকার:

দেশের এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র ফাঁকা বুলি অভ্যন্তরীণ প্রোপাগান্ডার কাজে লাগলেও লাগতে পারে– তবে তা দিয়ে শত্রুকে  ঘায়েল করা নেক্সট টু ইম্পসিবল। সরকার কেন জানি বুঝেও বুঝতে চায় না যে ‘হাইব্রিড’ আওয়ামী লীগারদের দাপট ও অত্যাচার থেকে জনগণ মুক্তি চায়– ও এরাই দেশ, জাতি ও জনগণের এক নম্বর চিহ্নিত শত্রু।

এই সুবিধাবাদী চাটুকার চক্রের সঙ্গে অশ্লীল জোট বেঁধেছে অতি নগণ্য তথাকথিত ব্যবসায়ী মাফিয়া সিন্ডিকেট। এদেরই কথায় নিহিতার্থে আজ আমরা দরিদ্র জনগণ কান ধরে উঠবস করছি। আমরা এমন কি পাপ করেছি ভাই? দরিদ্র হওয়াটাই কি আমাদের একমাত্র পাপ? কেন দিচ্ছেন এই লাগামহীন শাস্তি?

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অথনীতির যে বেগবান শক্তি তাতে অন্য কিছুর কমতি হোক, টাকার কমতি নেই। পিঠাপিঠি চাটুকার ও লোভী চক্রেরও অশ্লীল দাপট ও ক্ষমতাও কমতি নেই। ৮০ ভাগ খেটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষের সৃষ্ট সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার, আর দুর্নীতির দলিলসহ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তার বিচার তো দূরের কথা– তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলাপেরও আছে এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা।

২০২১-এর মুক্তিযুদ্ধে ১৬ কোটি নিরীহ মানুষের দেশে ১৬ লক্ষ ‘নব্য রাজাকারের’ উপস্থিতি এই প্রমাণ করে যে বঙ্গবন্ধুর সেনার বাংলার স্বপ্ন ও জনগণের প্রকৃত মুক্তি তথাকথিত কিছু ‘আমাদের লোক’রা সুপরিকল্পিতভাবে ধূলিসাৎ করার পাঁয়তারায় মগ্ন।

এই ইয়াজিদ তুল্য ঘাতকদের দল জাতির পিতা ও তার পরিবারকে হত্যা করার সময় তাদের বুক একটুও কাঁপেনি, আর জনগণ? তার গর্দনে করপাল চালাবে সে হাসিমুখে– তবে তাদের সেই অট্টহাসিকে মুহূর্তে কান্নায় পাল্টে ফেলার ক্ষমতাও রাখে সদা জাগ্রত লড়াকু জনগণ– তা যেন আমরা ভুলে না যাই। গরিবের পিঠ এখনও দেয়ালে ঠেকেনি– তার ধৈর্য দেখে আপনারা অহেতুক অধৈর্য হবেন না।

হুশিয়ার: মুখে মুখে নয় হৃদয়ের গহিনে গেঁথে রাখা ‘জয় বাংলা’র আমরা গেরিলা যোদ্ধা জাতি। একাত্তরের যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ট্রেনিং জমা দেইনি। আমরা শান্তিতে লড়তে চাই। আমাদের ক্ষেপাবেন না।

তবে সবকিছু ‘ফিনিশ’ হওয়ার সময় এখনও আসেনি। কারণ, অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা সেদিনই হবে যেদিন আমরা প্রকৃত ‘মনের মুক্তি’ অর্জন করতে পারবো।

একাত্তরের ৯ মাসের শিক্ষা– আজকের প্রজন্মকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বোঝাতে ও নব্য রাজাকার নির্মূল করতে নিদেনপক্ষে ৯ বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। করোনার এই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ চলতেই থাকবে এবং বাঙালি নিঃসন্দেহে সেই খেলাতে অতিদ্রুত সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠবে।

৭. যুদ্ধ ‘খেলতে’ হবে হাসিমুখে:

যেকোনও খেলা বাঙালি দুর্দান্ত খেলে। ক্রিকেটের মতো ‘যুদ্ধযুদ্ধ’ খেলায় বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্য তার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখে। চিন্তা করেছেন একেকটা ‘পোলা তো নয় সে আগুনের গোলা’?

তবে এই খেলার শিক্ষণীয় ‘অগ্রিম তালিম’ দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং। মস্তিষ্কের খেলা ‘ব্রিজ’ নিয়ে ইংরেজি মন্তব্য যা একদা করেছিলেন তার বঙ্গানুবাদ দাঁড়ায়:

‘যদি জারজেরদের সঙ্গে খেলতে হয়– তোমাকে আরও বড় জারজের মতো খেলতে হবে, তা না হলে তুমি হারবে’।

সুতরাং ইতিহাসের পাতা থেকে যেহেতু আমরা শিক্ষা নিতে ব্যর্থ– কেবল করুণ ও নিষ্ঠুর বাস্তব অভিজ্ঞতাই তা দিতে বাধ্য।

অভিজ্ঞতাই জীবনের সাম্যক গুরু!

৮. মস্তিষ্ক ধোলাই-এর ১৬ মাস ও ‘বুদ্ধিজীবীর’ ভূমিকা:

এই ১৬ মাসে আমাদের সবার অনুভূতিগুলো হয়ে গেছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, আমাদের অন্তরগুলো হয়ে গেছে লোহার চেয়েও শক্ত ও নির্বিকার, পারদ-এর চেয়েও শিথল ও নিষ্প্রাণ। আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার। চোখের জল নিতান্তই আমাদের আত্মার রক্তক্ষরণ– আর কতইবা রক্ত ঝরানো সম্ভব? আত্মা তো কোনও লেবু না যে চিপে চিপে তার ‘জুস’ বের করে পান করা যাবে? চোখের জল-ই বা কি করে আসবে যখন কাঁদতে কাঁদতে আমাদের সেই ফোয়ারা বহু আগেই ফুরিয়ে গেছে?

আমরা সবাই ‘আত্মার অ্যাকজিমা’ রোগে ভুগছি– সেই জীবন্ত আত্মার পচনের গন্ধের প্রাথমিক ধাক্কা এতটাই প্রগাঢ় যে নাকও তা সহ্য না করতে পেরে ভয়ে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। তখন ভাবনাগুলো লুকোচুরি খেলা করে বলে– ‘করোনা ধরলো নাকি, হায়রে জীবন ফুরালো নাকি?’

যুদ্ধের সময় মস্তিষ্ক ধোলাই সবচেয়ে খতরনাক হাতিয়ে যা নিপীড়ক শত্রু এই মিডিয়া যুগের ‘কল্যাণে’ অনায়াসে ও নির্দ্বিধায় আমাদের করছে। স্ট্র্যাটেজি হলো জনগণের সব চিন্তাচেতনা যেন বিলকুল শত্রুর সঙ্গে প্রান্তিককৃত থাকে ও তাহা নিশ্চিত করতে দণ্ডায়মান আছে অতি ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন এক ‘ছ্যাঁচোরের’ দল: আমাদের স্বঘোষিত ‘বুদ্ধিজীবী’ বাহাদুরগণ।

সরকার ‘বাহাদুর’ এদের সমীহ করলেও একটু নিরাপদ দূরত্বে রাখে, কারণ কোনও ভ্যালু না থাকলেও এদের ‘নুইসেন্স ভ্যালু’ প্রচুর। তবে এসব বিজ্ঞ পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীর মাথা, যে অনেক আগেই ক্রয় করে শত্রু তাদের পকেটবন্দি করেছে– তা জনগণের কাছে এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ থাক।

৯. মানসিক স্বাস্থ্য ও আমাদের সমাজ:

মহামারিকালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কালেভাদ্রে ‘না করলেই নয়’ স্টাইলে কথাবার্তা চলছে। এই আলাপের সামাজিক অনেক ঝুঁকি আছে ও আছে অযাচিত স্টিগমা (পাংশু)। এই আলাপ শুরু করলেই প্রকারান্তরে সবাই ধরে নেয়  ‘উনি কি পাগল?’ আর পাগল নিয়ে হাসিঠাট্টা? সে তো আমাদের নিষ্ঠুর সংস্কৃতিতে আদিকাল হতেই ‘উৎকৃষ্ট’ বিনোদন।

যদিও পাগল শব্দটা ব্যবহার করা সামাজিক অপরাধ, তার আরেক ভয়ানক বাস্তবতা যা আমরা অনেকেই জানি না: পাগল কখনই স্বেচ্ছায় স্বীকার করে না সে পাগল। এই ‘নিউ নরমাল’ বা নতুন স্বাভাবিক ফটকাবাজির যুগে জাতিগতভাবে আমাদের ইদানীংকার আচরণ সেদিকেই কি ইঙ্গিত দিচ্ছে?

আমরা তো কোনোদিনও ভুলেও স্বীকার করবো না আমরা পাগল, তাই আমরা ‘অ-পাগল’ জনগণ না হয় বিষয়টা একটু ‘ঘেঁটে দেখি’ কেমন?

১০. মিডিয়া ও নেগেটিভ নিউজে পসিটিভ সিম্পটম:

‘ভয় নয় সচেতনতায় জয়’– এসব চালু কথাবার্তা এখন হাই ফ্যাশন। টেলিভিশনের স্মার্টলি ড্রেসড সংবাদ পাঠক/পাঠিকারা বিরতির সময় বা খবর শেষে স্যানিটিজার হাতে মেখে, স্পন্সর কোম্পানির সূক্ষ্ম ‘ব্র্যান্ডিং’ করে (প্রাইম টাইম খবরের ভেতরে বিজ্ঞাপন, সকল ধান্দার ঊর্ধ্বে মহাধান্দা) মুখে মাস্ক পরে জনগণকে তথাকথিত ‘স্বাস্থ্যবিধি’ মানার সচেতনতার ‘উদ্বুদ্ধ’ করে বিদায় নেন। এসব ফালতুমি আন্তর্জাতিক কোন চ্যানেলগুলোতে কেউ কি দেখেছেন? তবে প্রশ্ন হচ্ছে এ কীসের স্বাস্থ্য? আপনাদের মানসিক কোষ্ঠকাঠিন্য নাকি মৌখিক আমাশয়ের ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন?

ভালো বোঝা গেলো আপনাদের নিজেদেরই সৃষ্ট মৃত্যু আতঙ্ক থেকে বাঁচার উপায় আপনারা ১০০ ভাগ পোক্ত ইমান দ্বারা নিজেরাই বাতলিয়ে দিচ্ছেন– কিন্তু অপর দিকে জনগণের মস্তিষ্কগুলোকে ধোলাই করে নির্বিচারে ধ্বংস করছেন– সেই ‘সচেতনতা মলম’ কোথায় পাওয়া যাবে ভাই?

এসব মানুষ মারার ধান্দায় জনগণের মতো রাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে– আর রাষ্ট্রকে দোষারোপ করেই বা লাভ কী? তার আমলাতন্ত্রের সকালে এক, বিকালে আরেক, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, মিনিটে মিনিটে কথা পাল্টানো ‘পাগলের প্রলাপ’ না বলে আমি নিজেও অতি মোলায়েম সুরে ‘সিদ্ধান্তহীনতা’ বা ‘হিতাহিতজ্ঞান শূন্যতা’ বলি– কিন্তু তাতে কি বিন্দুমাত্র জনগণের উপকার হচ্ছে?

পত্রিকা বলেন আর টিআরপি পাগল টিভি চ্যানেল বলেন– আপাদমস্তক নেগেটিভ ‘হায় হায় কী হবে’ বা ‘ছিঃ ছিঃ সরকার এসব কী করছে’, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানিসহ করোনা মৃত্যু নিয়ে কান গরম করা গালাগালি। আর যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাকে চোর, জুলুমশাহী, ফ্যাসিস্ট, পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, ধান্দাবাজ না বললে তো বাঙালির পেটের ভাত হজম হয় না। এসব ভীতিকর খবর ছাড়া যেন পৃথিবীতে আর কোনও খবরই নাই।

এই যে ২৪ ঘণ্টা লাগাতার ‘নেগেটিভ’ নিউজ দিতে দিতে জনগণকে মানসিক ব্রেকডাউনের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছেন তা কি বোঝেন? বারবার টেস্ট, দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার শেষে দেহে কোভিড-১৯ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরেও আমরা ‘অসুস্থ’। কীসের এই অসুস্থতা? কেন আমাদের এই অপচিকীর্ষু অসুস্থতা?

তার একটিমাত্র কারণ জনগণের আত্মার ভেতরে আপনারা করোনা সংক্রমণ করিয়ে আমাদের ‘মানসিক কোভিড পজিটিভ’– কেবল করেননি, ভাইরাস দিব্বি পরিপাটি সংসার বেঁধে কিলবিলিয়ে চলছে। তার ফলশ্রুতিতে শিক্ষিতমূর্খ নির্বোধ কিছু জনগণ কোভিড-১৯ কে মানব ‘মস্তিষ্কের উঁকুন’ মনে করা শুরু করেছেন। এবং অতি আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে অত্যন্ত টক্সিক ‘ঘোড়ার উঁকুন’ মারার ওষুধ গিলে তারা ভাইরাস খতম করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ও অন্যকে মরার জন্য ‘উদ্বুদ্ধ’ করছেন– হাসবো নাকি কাঁদবো?

১১. ক্রান্তিকাল নাকি মহাপ্রলয়?

২০১৬ নাগাদ বিশ্ববরেণ্য ভারতীয় সাধগুরু বাসুদেব জাগ্গি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন:

‘আজ পৃথিবী যে ভয়াবহ নিয়মে চলছে তার যদি কোনও পরিবর্তন না ঘটে এবং একইভাবে চলতে থাকে– নিশ্চিত থাকেন আগামী ৫০ বছরের ভেতরে পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা আত্মহত্যা করবে– আর বাকি অর্ধেক উন্মাদ-এর মতো বেঁচে থাকবে’।

আমার সমগ্র শরীর শিউরে উঠছে এই ভেবে যে ৫০ বছরও কি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না? মানবজাতির ক্রান্তিকাল কি শুরু হয়েছে– নাকি এ মহাপ্রলয়ের প্রাথমিক আলামত?

‘সেই দিন’ কি এই জীবনেই দেখতে হবে আমাদের? আমরা কি কোনও বিভ্রমে আটকে গেছি নাকি আমরা জীবিত মৃত? আমরা কি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সব নিরীহ মানুষ: শুধু রায় কার্যকর হওয়ার অজানা দিনক্ষণের অপেক্ষায়?

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ