X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনা মোকাবিলায় আমলাই যথেষ্ট, বিশেষজ্ঞ কমিটি কেন?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৮ জুলাই ২০২১, ১৬:১০আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২১, ১৬:৩৯

ডা. জাহেদ উর রহমান করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এই দেশের মানুষ একজন ব্যক্তিকে খুব ভালোভাবে চিনেছে– এন্থনি ফাউচি। আমেরিকার জাতীয় এলার্জি এবং সংক্রামক ব্যাধি ইনস্টিটিউটের পরিচালক তিনি। সেই রোনাল্ড রিগ্যানের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পর্যন্ত সব মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ প্রাপ্ত এই চিকিৎসক।

করোনা মহামারিতে আমেরিকায় এই ভদ্রলোকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকেই করোনা মোকাবিলায় হোয়াইট হাউজ টাস্কফোর্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। জো বাইডেনের সময়ে এসে ফাউচি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। তিনি এখন বাইডেনের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং করোনা মোকাবিলায় নতুন করে গঠিত হোয়াইট হাউজ কোভিড ১৯ রেসপন্স টিমের অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

বাইডেনের সময় বা ট্রাম্পের আগে উনি কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বা কী করেছেন তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনি ট্রাম্পের সময় কী করেছেন সেটা। এটা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে ট্রাম্প করোনা মোকাবিলায় বিজ্ঞানকে একেবারে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেতাই করতে চেষ্টা করেছেন, সফল হয়েছেন অনেকটাই। কিন্তু এই ভদ্রলোক তখনও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন।

অনেক সময় আমরা দেখেছি, করোনা নিয়ে ট্রাম্প যা বলছেন, মানুষকে যে ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছেন, সেটাকে স্পষ্টভাবে বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন ফাউচি। এমনকি তিনি ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের তার বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করছেন– এমন দৃশ্যেরও সাক্ষী হয়েছি আমরা।

বাংলাদেশে গত বছরের ১৯ এপ্রিল করোনা মোকাবিলায় জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে এর সদস্য সচিব করা হলেও একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে এর প্রধান করা নিয়ে তখনই বিতর্ক হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কমিটিতে জনস্বাস্থ্য এবং করোনা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অন্যান্য রোগের বিশেষজ্ঞ তুলনায় অনেক কম। দলীয় কিংবা অন্য প্রভাবের ভিত্তিতে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করার উদাহরণ হয়ে থাকবে এই কমিটি।

২৩ মে, করোনা মোকাবিলায় জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের এক মাসের বেশি সময় পার হওয়ার পর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকায় এসেছিল, করোনার পরীক্ষা, করোনা চিকিৎসা, হাসপাতালগুলোতে নন-করোনা রোগীদের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে নানারকম সমন্বয়হীনতা এবং অব্যবস্থাপনার চলছে। সেই রিপোর্টে টেকনিক্যাল কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলে বলেন, ‘আমরা আশা করি আমাদের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে সরকার।’ ওই রিপোর্টে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সদস্য হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। এদের এক সদস্য বলেন, ‘আমাদের কথা না শুনুক, ক্ষতি নেই। দরকার হলে সরকার কমিটি ভেঙে দিক, কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমুক।’

এক মাস পেরোতে না পেরোতেই কমিটির সদস্যদের মধ্যে এমন হতাশা জেঁকে বসেছিল। এরপর গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নানা সময়ে নানাভাবে এই কমিটির কোনও না কোনও সদস্যকে আমরা অন রেকর্ড ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি। বিশেষ করে মাত্র একটা কোম্পানির সঙ্গে টিকা নিয়ে চুক্তি করা, লকডাউন দেওয়ার সময়, সেটাকে কার্যকর করার পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে তারা প্রকাশ্যেই তাদের পরামর্শ রাখা হচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন।

সর্ব সাম্প্রতিক ঘটনাটি কমিটির কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। ঈদকে সামনে রেখে আট দিনের জন্য তথাকথিত কঠোর বিধিনিষেধটি শিথিল করে দিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্তটি এমন সময় নেওয়া হলো যখন বাংলাদেশে সরকারি হিসাব মতেই করোনা শনাক্তকরণের হার ৩০ শতাংশের বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ২০০-এর বেশি। পরিস্থিতি এই পূর্বাভাস খুব স্পষ্টভাবে দিচ্ছে বাংলাদেশ বর্তমান ঢেউটির চূড়ার দিকে যাচ্ছে। পৃথিবীর করোনার ইতিহাসে চূড়ার দিকে যাওয়ার সময় লকডাউন খুলে দেওয়ার উদাহরণ হিসেবে আমাদের কথা আসবে নিশ্চয়ই।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতে কী ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটিয়েছে, সেটা আমরা দেখেছি। মোটামুটি সেই সময়ে গামা ভ্যারিয়েন্ট-এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা এই ঢেউটি আসার আগের প্রায় তিন মাস সময়ে আদৌ তেমন কিছু করিনি। সরকার যেহেতু খুব শক্ত লকডাউন দীর্ঘদিন রাখবে না এবং আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা রাখে না, তাই সরকারের উচিত ছিল অন্তত পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেনসহ আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে প্রস্তুত রাখা। স্রেফ এক হাজার কোটি টাকার মতো খরচ করলে দেশের প্রায় সব উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করা যেত।  

ঈদের সময়ে এই লকডাউন তুলে নেওয়ার কারণে ঈদের পর এক ভয়ংকর বিপর্যয় তৈরি হবে এটা প্রায় নিশ্চিত। আমরা স্মরণ করবো ভারতেও ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেই কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ একসঙ্গে হয়েছিল। পরের সেই মানুষরা সারা ভারতে করোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। এক গবেষণায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল ল্যানসেট এটা নিশ্চিত করেছে।

প্রতি হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসাকর্মী সবকিছুতে ভারত আমাদের তুলনায় অনেক ভালো হওয়ার পরও তাদের কী বিপর্যয় হয়েছে সেটা আমরা দেখেছি। তাই করোনার এই সময়ে এই শিথিলতা একেবারেই আত্মহত্যার মতো ব্যাপার। তাই সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অগ্রাহ্য করে যখন লকডাউন শিথিল করে দিলো তখন এই কমিটির কোনও কোনও সদস্য আলাদাভাবে পত্রিকায় এর বিরোধিতা করেছেন। কয়েকদিন পরে অবশ্য রীতিমতো পত্রিকায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে পুরো কমিটি এর প্রতিবাদ করেছে। তাতে তারা কোরবানির পশুর হাট বন্ধ করার কথাও পুনরুল্লেখ করেছেন। দেখে মনে হচ্ছে তথাকথিত বিধিনিষেধ নিয়ে সর্বশেষ পদক্ষেপ এই কমিটির অহমে লেগেছে অবশেষে। আসলেই কি লেগেছে? তাদের যদি অহম বলে কিছু থাকতো তাহলে অতীতের যাবতীয় সব ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি মিলিয়ে এই কমিটি পদত্যাগ করতো অনেক আগেই।

এই দেশের করোনা মোকাবিলায় আমলাই তো যথেষ্ট। বিশেষজ্ঞ কমিটি যে পরামর্শই দিক না কেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা রক্ষা করা হয়নি। এই দেশে যেভাবে করোনা মোকাবিলা করা হচ্ছে তার জন্য আসলে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দরকার নেই, একটা টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা দূরেই থাকুক। করোনা মোকাবিলায় যেভাবে অ্যাডহক সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেগুলো নেওয়ার জন্য আসলেই কোনও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দরকার নেই, দরকার করোনা নিয়ে ভাসা ভাসা ধরনের সাধারণ জ্ঞান। সাধারণ জ্ঞান এবং অন্যান্য দেশের উদাহরণ অনুসরণ করলে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ ছাড়াই করোনা আরও ভালো মোকাবিলা করা যেত। অবশ্য এটুকুও তো পারেননি আমলারা।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ