X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: গালি, তালি, পরীমণি ও প্রজন্মের বিদ্রোহ

মাকসুদুল হক
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:০৯আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:০৯

মাকসুদুল হক ‘তোমার সন্তানদের তুমি ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমার চিন্তা দিও না। কারণ, তাদের নিজস্ব চিন্তার জগৎ আছে। তাদের আত্মা আগামীর ঘরে বসবাস করে, যেখানে তুমি কখনোই ঢুকতে পারবে না– এমনকি তোমার স্বপ্নেও না’।  

কাহলিল জিবরান (১৮৮৩-১৯৩১); বঙ্গানুবাদ-লেখক

১. প্রসঙ্গ পরীমণি: কে কাকে ‘সাইজ’ করছে?

প্রারম্ভে বলে রাখি পরীমণির কোনও মুভি বা নাটক আমি দেখিনি। আর যতটুকু তার সম্পর্কে জেনেছি তা নিতান্তই মিডিয়া রিপোর্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মারফত।

 তথাপি ৮ জুন ২০২১ বোট ক্লাবে তার ওপর ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদের ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ও অভিযুক্তের গ্রেফতার ও পরবর্তীতে ১৫ দিন পুলিশি হেফাজতে (কারাগারে নয়) থাকার পর জামিনে মুক্তি, অনেকের মতো আমাকে ভাবিয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত ২০ জুন ২০২১ ‘ব্যবসায়ী শ্রেণির মানসিকতা ও ‘ম্যানেজ’ সংস্কৃতি’ শিরোনামের একটি কলামে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছি।

শেষ করেছিলাম এই বলে– ‘নারীগণ সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করে যাবে— সেদিনের সমাপ্তি নিশ্চয়ই ঘনিয়ে আসছে। এখন দেখার অপেক্ষায় থাকলাম (অভিনয়) শিল্পী আসলেই কি সুবিচার পাবেন, নাকি ‘ম্যানেজের’ খপ্পরে পড়বেন। পড়ে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই!’

আশ্চর্য আসলেই হয়েছি।  
গেলো এক মাসের ঘটনা দেখে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পরীমণি ‘ম্যানেজ’-এর খপ্পরে পড়েননি, সম্ভবত ম্যানেজ না হওয়ার কারণেই তাকে ২৬ দিন হাজত ও কারাগারে থাকতে হয়েছিল, ৩ দফা রিমান্ডে প্রেরণ ও একাধিকবার জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর অবশেষে ১ সেপ্টেম্বর মুক্তি।

কিন্তু দুঃখের বিষয়টা হচ্ছে, পরীমণির দায়েরকৃত ধর্ষণের অভিযোগের মামলা সুবিচার পাওয়া তো দূরের কথা– তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই তাকে মাদক আইনে গ্রেফতার করে যে ভয়ানক ঘটনাগুলো ঘটে গেলো, তা এই লেখা যখন লিখছি– জনমনে এতটাই টাটকা, তার পুনরাবৃত্তি করা এখানে নিষ্প্রয়োজন।

 কিন্তু আরেকটা বিষয়ে অবেক্ষণ না করলেই নয়। ধর্ষণচেষ্টার ঘটনায় ব্যবসায়ী নাসির ছাড়া ‘আরও ৪ জন’ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ পরীমণি করেছিল– তা সম্পূর্ণ রহস্যে আবৃত। সেই কাঙ্ক্ষিত নামগুলো এই অব্দি মিডিয়া, পুলিশ, এমনকি পরীমণি কোথাও উল্লেখ করেনি।

অনুকাহিনিতে এটাই সব চাইতে ‘আশ্চর্য’ হওয়ার মতো ঘটনা। কে বা কাহারা এই ‘৪ জন’ এবং কেনই বা তাদের নাম কোথাও আসেনি, যদিও সমাজে এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে– বিশেষ করে তথাকথিত অভিজাত মহলে। এই চার জনের ক্ষমতার দাপট এতটাই কি তীব্র যে সামাজিক যোগাযোগের কানাঘুষা ছাড়া কোনও আলামত রাষ্ট্র, মিডিয়া কেউই তা জনসম্মুখে বা মাননীয় আদালতে হাজির করতে পারেনি?
গোমরটা এখানেই।
এসব তথাকথিত ‘এলিট শ্রেণির’ মানুষজনকে আমরা যেহেতু স্পষ্ট চিহ্নিত করতে পারিনি, ইচ্ছাকৃত বা ‘ঝামেলা’র ভয়ে করি না, আমাদের সব অনুসন্ধান, সব মামলা কেবলি যে মানুষ দেখানো জড়ত্ব, ‘মিডিয়া সার্কাস’– তা বললে কি ভুল হবে? তাহলে কি এসব ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীর নাম যেন তদন্তে না উঠে আসে সে কারণেই পরীমণির ওপরে জুলুম নেমে এলো? জাতিগতভাবে আমাদের মন, মেধা, মনন এতটাই কি পার্ভার্টেড হয়ে গেছে যে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, তা বোঝার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি?

তড়িঘড়ি ৪ জুলাই ২০২১ সালে তাকে গ্রেফতার করা, মাদক রাখা ও ব্যবহার করা ছাড়াও, নিজ ভাড়া করা বাসায় ‘বার’ প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত ‘পার্টিবাজি’র মতো ‘গুরুতর অপরাধ’ করা, সে কতবার বিয়ে করেছে, বা কত পুরুষের সাথে রাত কাটিয়েছে ইত্যাদি চরিত্র হননসহ মিডিয়া ট্রায়াল, ঘন ঘন তাকে নিয়ে নেগেটিভ রিপোর্ট– যা পরবর্তীতে কোনও কিছুই ধোপে টেকেনি –এসবের কারণ কী?

এ-কি প্রমাণ করে না যে পরীমণিকে আচ্ছা মতো ‘সাইজ’ করার জন্য এই অভিসন্ধি, এই ন্যক্কারজনক ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপরে অযাচিত হস্তক্ষেপ, তার নাগরিকসহ মানব অধিকারের চরম ও নির্লজ্জ লঙ্ঘন?

যে দেশে খুনের মামলাতেও জামিন মঞ্জুর হয়, ২৬ দিন একটা মানুষকে বিনা কারণে কান ধরে জনসম্মুখে উঠবস করানো, অতঃপর প্রশাসনের দায়েরকৃত হয়রানির মিথ্যা মামলা– উচ্চ আদালতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া কি বিন্দুমাত্র আমাদের লজ্জায় ফেলছে না? নেপথ্যের ক্ষমতাবান ব্যক্তিগণ যারা এই ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, কী করে ধারণা করলেন তারা খুব সহজে পার পেয়ে যাবেন?

না, অনেকে ব্যর্থ চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ এখনও ‘মগের মুল্লুক’ হয়নি– এটুকুই আমরা আশাবাদ ব্যক্তি করতে পারি।

কেন চোর ডাকাতের মতো কথায় কথায় নিরীহ মানুষজনকে ‘রিমান্ড’ নামের শারীরিক ও মানসিক ‘ধোলাইখানা’তে নিয়ে জবরদস্তি স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য করা হয়– যে ‘স্বীকারোক্তি’ উচ্চ আদালত আবার আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলে দেয়?

পরীমণির মামলায় উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে– তাতে বলা হয়েছে–  নিম্ন আদালত পুলিশের গ্রহণযোগ্য আলামত ছাড়া তিনবার এক ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেওয়া ‘ক্ষমতার অপব্যবহার যা কোনও সভ্য সমাজে হতে পারে না’।

কথা হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা তো অহরহ ঘটছে। জনগণকে হয়রানি করার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও– কতবার তা প্রয়োগ হয়েছে ও ক’জনই বা প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন?

এসব নিয়ে ভাবনা ও দৃঢ় সামাজিক আন্দোলন না হওয়া অব্দি এ ধরনের অ্যাবিউসিভ ঘটনা যে ঘটতে থাকবে তা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশে যারা ক্ষমতাবান, যাদের অর্থের দাপট প্রচুর, যারা পুলিশসহ নিম্ন আদালতকে তাদের ইচ্ছায় পকেটবন্দি করতে পারে, তাদের ঘোরতর অপরাধ করার পর এই ‘দেখে নেবো’ মানসিকতা এ যাত্রা আমরা সবাই বিমর্ষ হয়ে দেখেছি।

২. সাংস্কৃতিক অপ্রতুলতা ও আজকের প্রজন্ম: অবিরাম লড়াই

‘আমাদের বন্দি করে যদি ওরা ভাবে,

দুনিয়ায় পাপের ভারে পুণ্য গেছে ডুবে,

ভুল, ভুল, ভুল সে তো বড় ভুল,

আমাদের সন্তানেরা দেবে সে ভুল ভেঙে দেবে’

খান আতাউর রহমান (১৯২৮-১৯৯৭)

তবে মূল সমস্যা হচ্ছে সাংস্কৃতিক অপ্রতুলতা ও বহু যুগ ধরে চলতে থাকা প্রজন্মগত বিদ্রোহ, যা আমাদের সমাজ, সমাজবিজ্ঞানী কিংবা প্রশাসন সব সময় উপেক্ষা করে এসেছে, পাত্তা দেয়নি।

আমরা ভুলে যাই যে বছরটা ২০২১ ও গেলো ২০ বছরে আমাদের হাজারো উন্নয়নের ন্যায় এক অভাবনীয় নীরব সামাজিক বিপ্লব ঘটে গেছে। নারীর ক্ষমতায়নের ফাঁকা বুলি রাষ্ট্র ও সরকার অহর্নিশ ছুড়লেও আজকের নারীর সাথে ৬০-৭০ দশকের নারীর যে বিশাল অমিল– তা আমরা মানতে রাজি না।

পুরনো দিনের উপন্যাস ও সিনেমার চিরাচরিত ‘নরম, শরম, কথা কম বলা, সতি সাবিত্রী বাঙালি নারী’র যে চিত্রাঙ্কন তার ব্যাপক ও অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে। কালাতিক্রম করে এখন পৃথিবীর যেকোনও উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের নারীরাও দিপ্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে– তা আমরা ক’জনই মানি বা সম্মান করি?

আমাদের যুগ যুগ ধরে মনের গহিনে গেঁথে রাখা ‘সংস্কৃতি’ নামের ঘুণে ধরা উপলব্ধি, সব চিন্তা চেতনা, সব বিশ্বাস এসে সঙ্ঘবদ্ধ ক্রোধে পরিণত হয় যখন পরীমণির মতো এক আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীনচেতা, আত্মনির্ভরশীল ও বিমুক্ত নারী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এ যেন এক ‘শক থেরাপি’ যা হজম করার মানসিক প্রস্তুতি আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রের একেবারেই নেই।

তার বয়স ২৮ ও সে বাংলাদেশের তার বয়সী জনসংখ্যার ৪১ ভাগ মানুষের একজন ও সূক্ষ্ম সমীক্ষায় ১০০ ভাগের ৫২ ভাগ। জি! ঠিক পড়ছেন, নারী।

এ যে নবীন প্রজন্মের এক প্রতিনিধি, তাদের চিন্তার ও কর্মের জগৎ যে আলাদা, তাদের এই অভাবনীয় উত্তরণ, তারা যে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়, তাদের ‘ড্যামকেয়ার এটিচুড’ যে ভবিষ্যৎ বার্তা সমাজকে দিচ্ছে, তা দেখে আমাদের কপটাচারী সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্তরে মৃদু ভূকম্পন অনুভূত হয়ে মুখমণ্ডল লাল করে ‘কাচুমাচু’ বিব্রত করেছে– তা আমরাও স্পষ্ট অনুভব করলাম।

ব্যক্তিগতভাবে আমি আনন্দ পেয়েছি।

আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আমরা সেই যুগে অবতরণ করেছি যেখানে মানুষ একেকজন রাষ্ট্রের অন্তরালে থাকলেও– ‘ব্যক্তি সার্বভৌমত্বের’ অধিকারী, সেই ক্ষমতা তাদের অন্য কেউ না, সময় দিয়েছে।

সবকিছুই টাকার জোরে, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে স্তব্ধ করা যেমন সম্ভব না– আমরা ভুলে যাই যে তারুণ্যের হৃদপিণ্ডের স্পন্দনকেও স্তব্ধ করা কেবল অসম্ভব না, তা আত্মঘাতী, এক মহাপাপ।

যদি তারুণ্যই হয়ে থাকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, তাহলে প্রাচীন, অতীত ও পশ্চাৎমুখী ‘জীবাশ্মিত প্রাণীদের’ প্রজন্মের এখনই প্রয়োজন: সময়ের বাস্তবতা মেনে নিয়ে ধোপাখানায় মস্তিষ্কের নিদেনপক্ষে ‘হালকা ড্রাই ওয়াশ’ করা।

রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের ‘নিজস্ব  মনোনীত’ তারুণ্যের ধারাবাহিক বর্ণনা ছাড়াও– সব স্তরের তারুণ্যের চিন্তার ভিন্নতা স্বীকৃতি দিয়ে, ব্যাপক গবেষণায় মনোনিবেশ করে এক যুগান্তকারী সমাধান উপস্থাপন করা।  

সবকিছুই কাঁচাপাকা কেশধারী ‘বুদ্ধিজীবী’ বা ‘বিশেষজ্ঞ’ মতামত বাদ দিয়ে তারুণ্যের মতামত গুরুত্ব দিয়ে বিচার না করলে– জাতির ভাগ্যের ভরাডুবি অবধারিত।

তাছাড়া যুব মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ যুবক ও আজকের প্রজন্মের হাতে অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া এই মুহূর্তে ফরজ কাজ। ‘মুরুব্বি’ বা ‘আঙ্কেল’ শ্রেণির মানুষজনের ‘যুব মন্ত্রণালয়ে’ আনাগোনা কেবল দৃষ্টিকটু না– তা শুদ্ধরুচি-বহির্ভূত ও পরিপন্থী।

৩. জাতিগত চিন্তার কার্যধারা ও জিম্মি মিডিয়ার ভূমিকা: পেশা নাকি দাসত্ব?

সমস্ত জাতিগত চিন্তার প্রক্রিয়া সব সময় মিডিয়া বা যোগাযোগমাধ্যম কেবল করে আসেনি– বিগত দিনগুলোতে তার নেতৃত্বও দিয়ে এসেছে। কিন্তু যেই যুগ, যেই কাল আমরা এখন অতিক্রম করছি তার সঙ্গে আমাদের মিডিয়ার আদৌ কি কোনও সামঞ্জস্য আছে? মিডিয়া যেখানে জনগণের পালস ধরে থাকার কথা, ও তা নিয়ে সংবাদ প্রেরণ করবে- সে কেন জানি তারুণ্যের পালস ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

মানুষের রুচি বা তথাকথিত মূল্যবোধ তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু দেখা যায় যখনই কোনও নারী আইনগত ঝামেলায় পড়েছে বা গ্রেফতার হয়েছে– (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) মিডিয়া তার সংবাদে সমস্ত প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করে লৈঙ্গিক ‘সুড়সুড়ি’ বিষয়াদি নিয়ে।

গ্রেফতার কী কারণে হলো, তা কি হয়রানিমূলক নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেদিকে মনোনিবেশ করার আগে খেয়াল করা যায় মিডিয়া ‘মেয়েটির চরিত্র কত খারাপ’ তা নিয়ে বিস্তর আজেবাজে কথা বলা শুরু করে, ঠিক যেভাবে ক্ষমতাবান লোকজন বা কায়েমী স্বার্থ বিষয়টাকে এগিয়ে নিতে চায়। সেদিকেই নিবদ্ধ থাকে।

তার ওপরে আছে ‘গোপন সূত্র’ বা ‘পুলিশ সোর্স’-এর ভাষ্য; মোদ্দাকথা রাষ্ট্র বা প্রশাসন যেভাবে মামলা সাজাতে চায়, তারই মদত দিয়ে এক ধরনের জনসমর্থন সৃষ্টির চেষ্টা চলতে থাকে। যেহেতু গণমাধ্যম আক্ষরিক অর্থে মুক্ত বা ‘ফ্রি’ তাতেও কোনও সমস্যা নেই, সমস্যা অন্য জায়গায়।

পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে তা হয় কিনা আমার অজানা। বাংলাদেশে পুলিশের একটা অত্যন্ত সাধারণ রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘চাঞ্চল্যকর’ কোনও ঘটনার পর তা নিয়ে দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিস্তর খুঁটিনাটি জনসম্মুখে তুলে ধরা।

অপর দিকে মিডিয়ার কাজ কিছু নোট নেওয়া, ‘বাইট’ ক্যামেরায় ধারণ করা ও সৌজন্যমূলক দু’একটা প্রশ্ন করা ছাড়া কোনও কিছু করার নেই। কারণ, বাকিটা নিজের কল্পনাপ্রসূত উর্বর মস্তিষ্ক দিয়ে বানিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা যাবে।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির মানব অধিকার লঙ্ঘন ও আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ সুস্পষ্টভাবে এখানে নেই, আর মিডিয়া আদালত পর্যন্ত মামলা না গড়ানো অব্দি এ নিয়ে হয় নীরব ভূমিকা পালন করে, বা বাড়তি সুড়সুড়ি দিতেই থাকে।

এই একতরফা ও অধিকাংশ ক্ষেত্র বানোয়াট আখ্যায়িকা জনগণের মনে রাষ্ট্র, প্রশাসনসহ সরকারের বিরুদ্ধে যে চাপা ক্ষোভ ও রাজনীতির ময়দানে বিরুদ্ধাচরণের যথেষ্ট খোরাক সৃষ্টি করে– তা নিয়ে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই।

পরীমণির বিষয়ে দেখা গেলো প্রথমেই তার পোশাক নিয়ে মিডিয়ার হইচই।

‘এত খোলামেলা কাপড় পরে ফেসবুক লাইভে কী করে আসে’ মার্কা অনুযোগ, ‘মাইয়্যার এত তেজ ক্যা’ বা ‘দেখসো কী অশ্লীল! সে দুপাট্টা পর্যন্ত পরলো না, একদম বুক টানটান করে শার্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছে’– যেন বোরকা বা হিজাব পরে বেরিয়ে এলে ভালো হতো, অন্তত ধর্মীয় উগ্রবাদীরা তাকে সমর্থন করতো– তার পক্ষে কথা বলতো। আহ্! কী দরদ!

এসব নোংরা মন্তব্যে একটি বিষয়ে পরিষ্কার– আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে, মা, বোন, প্রেমিকা বা বন্ধুর চোখে দেখে না।  

অথচ এই একই মিডিয়া যখন স্টার, মডেল বা অভিনয় শিল্পী ‘সৃষ্টি করে’ তাকে যতটা খোলামেলা ছবি দেওয়া যায় তা দিতে উৎসাহিত কেবল করে না, তাকে রীতিমতো পীড়াপীড়ি করে। যে মিডিয়া স্বার্থ ও সুযোগ বুঝে নিজেই অভিনয় আর ব্যক্তি জগৎ ফারাক করে না– সে কোন অধিকারের বলে এসব মানসিক অশ্লীলতার অবতারণা করে?

এই দৈন, এই দুমুখী, ত্রিমুখী ভণ্ডামি যে মিডিয়া নিজেই সমাজে মহামারির মতো ছড়িয়ে দিয়ে দেশটিকে তালিবানি কায়দায় নৈতিকতার ছড়ি (মোরাল পুলিসিং) ঘোরানোর সব উপাদান সৃষ্টি করছে ও যা আমাদের গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিপন্থী– তা নিয়ে খুবই মুষ্টিমেয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ ছাড়া কাউকে সোচ্চার হতে দেখা যায় না।

৪. ইংরেজি অশ্লীলতা ও বাঙালি শ্লীলতা: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’

আমি তীব্রভাবে বিশ্বাস করি যতদিন একটা জাতি অন্য আরেক জাতির ভাষা না শেখে, তার পক্ষে তার নিজের ভাষা শুদ্ধভাবে শেখা অকল্পনীয় ও অসম্ভব।

আমরা এই বাংলা বাংলা করতে করতে– বাংলাটাও শিখলাম না। আর ‘বদ-এর বদ’ ইংরেজিটাও শিখলাম না। তার ঊর্ধ্বের সমস্যা হচ্ছে ইংরেজি শিখলেও সেই ভাষায়, তার শব্দচয়নের সাংস্কৃতিক অনুবৃত্তি আসলেই কী, তা নিয়ে হয় ভাসা ভাসা জ্ঞান বা জ্ঞানহীনতায় আমরা আচ্ছন্ন।

তাই সতর্কতা: বিপদ স্বেচ্ছায় ডেকে আনবেন না। ভুলেও বাঙালিকে ইংরেজিতে ‘গালি’ দেবেন না। ‘স্টুপিড’ বললে সে ক্ষুব্ধ হয়ে যাবে কিন্তু ‘নির্বোধ’

বললে সে স্টুপিডের মতো মুখের দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকবে। ‘ইডিয়ট’ বললে সে আপনার মুখে ঘুসি বসিয়ে দেবে, কিন্তু ‘গবেট’ বললে ইডিয়টের মতো ৩২টি দন্ত বিকশিত করে খিলবিলিয়ে হাসবে।

আমরা মুখের ও চোখের ভাষা বুঝলেও, দৈহিক ভাষা (বডি ল্যাংগুয়েজ) বা আঙুলের ইশারার ভাষা একটু কম বুঝি! সাকিব আল হাসানের একদা ক্ষেপে গিয়ে স্টেডিয়ামে দৈহিক ভাষার স্যাম্পল আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি।

পরীমণি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঠিক একই ‘সঠিক ভুল’টা করলো। তার ডান হাতে মেহেদি দিয়ে লেখা ‘ডোন্ট লাভ মি বিচ’ তারপর মধ্যমা আঙুল উপর দিকে তাক করা ছিল একটা ‘সিগন্যাল’ বা ইশারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা নিয়ে যথারীতি ‘তোলপাড়’– তবে অবাক হলাম এক ইউরোপীয় মিডিয়ার ঢাকা অফিস তাকে প্রশ্ন করলো ‘বিচ আপনি কাকে বললেন?’ পরীমণি স্মার্টলি উত্তরে বললো ‘যার বোঝার সে ঠিকই বুঝে নেবে’– বা সংশ্লেষে ‘সমজদার-এর জন্য ইশারাই যথেষ্ট’!

‘বিচ’-এর আভিধানিক অর্থ যদিও ‘স্ত্রী কুকুর’ কিন্তু শব্দটা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ ‘জেন্ডার নিউট্রাল’ বা লিঙ্গনিরপেক্ষ। পুরুষ, নারী উভয় ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা যায়। অদ্ভুত হলেও সত্য– পশ্চিমা বিশ্বে ‘স্ত্রী কুকুর’কে বিচ বলা হয় না। বলা হবে, ‘মিট মাই ডগ জুলি’– আমার কুকুর জুলির সঙ্গে পরিচিত হও। কুকুরের নামটাই তার লিঙ্গ বিভেদ করার জন্য যথেষ্ট।

আরেকটা উক্তি– ‘স্টপ বিচিং বিহাইন্ড মাই ব্যাক’ – আমার পেছনে বাজে কথা বলা বন্ধ করো।

তাহলে মধ্যমা আঙুল ওপর দিকে তাক করার অর্থ কী? সেই প্রশ্ন ভাগ্যক্রমে কেউ করেনি! তর্জনি ও মধ্যমা একসঙ্গে ওপরে তাক করা যেমন শান্তি বা বিজয়ের প্রতীক– কেবল মধ্যমা তাক করা সিগন্যালটা বোঝানো, একটু ঝুঁকিপূর্ণ। ওই ফাঁকফোকরের বিষয় আরকি- এর বেশি বলা যাবে না!

৫. শ্লীলতা ও অশ্লীলতার যুগোপযোগী মেরুকরণ: ‘ভদ্রতা বজায় রাখুন’-এর দিন কি শেষ?

প্রশ্ন– তাহলে কি মৌখিক ও স্বভাববাজ অশ্লীলতা সমাজে চলতেই থাকবে?

উত্তর: তার আগে জানতে হবে অশ্লীল কি আমাদের চোখ, মন, কান, নাকি অন্তর।

আজকের লেখায় যে কথাগুলো উপস্থাপন করলাম তা আমাদের সমাজ যখন ক্ষমতাবানের অশ্লীলতার দাপটে নিমজ্জিত, সেখানে আলাদা করে কোনটা শ্লীলতা ও কোনটা অশ্লীলতার সেই বিতর্ক কি খুবই জরুরি? যখন সাধারণ যুক্তি, আইন, হিতাহিত জ্ঞানের ‘ভদ্র ভাষা’ ব্যবহার করলে সাধারণের কোনও উপকারে আসে না– এটাই কি চরম অশ্লীলতা নয়?

দুঃখজনক হলেও রূঢ় সত্য– অধিকাংশ প্রচলিত গালি নারীকেন্দ্রিক ও নারীবিদ্বেষী। অতি সাধারণ ও ‘নিরীহ’ গালি– ‘শালা’, যা উঠতে বসতে অহরহ আমরা ব্যবহার করি বা শুনতে পাই, তাও নারীর প্রতি অপমান, সমগ্র মা জাতির ভর্ৎসনা।

আবার বাংলাদেশ সেই দেশ যেখানে জাতীয় সংসদে ‘চুদুরবুদুর’-এর মতো শব্দ সংসদীয় আগুয়ান থেকে মুছে ফেলা হয়নি- অর্থাৎ তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ নিয়ে বেশ কয়েক দিন সরব বিতর্ক অতীতের দিনগুলোতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বাড়তি কিছু বলার কি অপেক্ষা রাখে?

তবে হ্যাঁ, সবকিছু যেমন যুগে ও সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যাচ্ছে– শ্লীলতা বা অশ্লীলতার সংজ্ঞা যে পাল্টাবে না, তা মনে করা মূর্খামি। যতদিন পর্যন্ত পেশীর জোর, ক্ষমতার জোর ও অর্থের জোরের দাপট চলতে থাকবে, তাকে রুখে দেওয়ার জন্য অশ্লীলতা ও অশ্লীল বাক্য ব্যয় বাড়বে বই কমবে না।

ভুলে যাবেন না, একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মুক্তচিন্তার মতো মুক্ত বাক্য বা ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ আমাদের পবিত্র সংবিধানে লিপিবদ্ধ ও সুনিশ্চিত করা আছে। কোথায় কীভাবে তা প্রয়োগ ও ব্যবহার হবে সে ভিন্ন তর্ক। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা তা ‘শেষ হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার যে করবে, বা করতে পারে– তা মানতে আমাদের অসুবিধা কোথায়?

আমরা ভুলে যাই যে ‘গালি’ ও ‘তালি’ উভয় দুঃখ ভরাক্রান্ত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ও প্রচুর আনন্দ দেয়। এবং সেই আনন্দের আয়ু, দিন নয়, বছর নয়, যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে।

যে অশ্লীল গালি শুনে আমরা হতচকিত হবো বা ক্ষেপে যাবো– ধরে নেবেন তা রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও ব্যক্তির প্রাপ্য। সব অবৈধতা, সব অশ্লীলতা সমাপ্তি না ঘটা অব্দি - সবই বৈধ সবই এক্সসেপটেবল।

যাক, আজ অনেক ‘বেহুদা বিচিং’ করলাম, তার জন্য পাঠকদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

লেখক: সঙ্গীতশিল্পী

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ