X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পাপের বোঝা হালকা হলো কি?

ধ্রুব নীল
১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৫:৩১আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৮:৩১

ধ্রুব নীল কুকুরের একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য আছে। গাড়ি দেখলেই তাড়া করে। গাড়িটা থামলে বা সেটাকে যদি ধরেও ফেলে, তারপর যে কী করবে, সেটা ওই কুকুর জানে না। তবু সে উদভ্রান্তের মতো তাড়া করে। ইংরেজিতে যাকে বলে ন্যাচারাল ইনস্টিংক্ট। কুকুরের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছি না। স্রেফ উদাহরণ দেওয়ার খাতিরে বলা। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতার কারণে প্রাণীটি এ কাজ করে। অন্য কোনও কারণে নয়।

প্রাণী হিসেবে মানুষেরও ন্যাচারাল ইনস্টিংক্ট ওরফে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ শুধু কিছু করেই সন্তুষ্ট থাকতে চায় না, একটা কিছু ঘটিয়ে দিতে চায়। বিজ্ঞানীরা চান নতুন কিছু বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে, লেখক চান এমন গল্প লিখে হইচই ফেলে দিতে, সিনেমার পরিচালক মনে মনে ভাবেন, এবার অস্কারে ডাক না দিয়ে যাবে কই। তো, এমন কিছু মানুষ আছে, যারা ‘গাড়ি’ দেখলেই ছোটে। গাড়ির পেছনের বাম্পারে ঝুলে পড়লে কী হবে জানে না তারা। অন্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে আহত হওয়ার ভয় আছে, সেটা জেনেও ছোটে। তারা ওই ‘একটা কিছু করার’ মোহে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারায়। তাদের দরকার একটা কিছু ঘটিয়ে দেওয়ার। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, এরপর যে চেইন রিয়েকশন শুরু হবে এটা তারা জানে। একান ওকান হতে হতে তারা তখন গল্প বলে ‘রানি কাক প্রসব করেছেন’। তারপর আনন্দের সাগরে হাবুডুবু খায়। ‘আমি কী ঘটিয়ে দিলাম!’ ভাবতে ভাবতেই দিন কাটে রাত কাটে। খবরে খবরে তার কীর্তি। আনন্দের চোটে জিভ দিয়ে চুইয়ে পড়ে ডোপামিন হরমোন। মগজের কোণায় কোণায় বিকৃত খেলা দেখার আনন্দ। সে এটা বোঝে না যে, এসব খেলা একটা অসুখ—‘ভাইরাল’ ফিভার। আর ভাইরাল শব্দটা যে ভাইরাস থেকে এসেছে, এটা কি তারা জানে না?

যাদের কথা বলছিলাম, সেই ‘ভাইরাল’ জ্বরে অসুস্থ মানুষগুলো কোনও কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করে না। পুলিশ, প্রশাসন সবাই চায় সব সময় পরিস্থিতি নিয়্ন্ত্রণে রাখতে। ব্যাপারটি ওদের পছন্দ নয়। নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে যত বড় ঘটনাই হোক, তাতে একশ্রেণির মানুষ ওই থ্রিলটুকু বোধ করে না। তারা চায় একটা কিছু ঘটিয়ে সেই নিয়ন্ত্রণের খুঁটি নড়বড়ে করে দিতে। দমকল বাহিনীর ছোটাছুটি, লাঠি হাতে হই হই করা কিছু তাগড়া জোয়ানের হুংকার, মাইকে মাইকে রক্ত টগবগ করা ভাষণ—  আড়াল থেকে এসব দেখা ওই সব খেলুড়েদের কাছে বিশাল এক বিনোদন বটে।

তারা এও জানে, এখনকার ফেসবুক-যুগে ‘সামান্য’ কিংবা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে কিছু নেই। যে কারণে কুমিল্লার গাছে কাক বসলে রংপুরে তাল পড়ে।

এরা তবে কারা? বেকার লোকজন? চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া বখাটে যুবক? অনবরত হুংকার দিয়ে কথা বলা কোনও বক্তা? নাহ, এভাবে শ্রেণিবিভাগ করা যাবে না ওদের। ওরা সবখানেই আছে। এরা হলো তারা, যাদের কাছে মানুষের সংজ্ঞা হলো ‘হিউম্যান ইজ আ স্যোশাল অ্যানিমেল।’ তারা একতাবদ্ধ, সামাজিকও বটে। কিন্তু অ্যানিমেল ক্যাটাগরি থেকে বের হতে পারেনি।

অনেকেই এখন বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ, অধ্যায় ও লাইন নম্বর টুকে বলছেন, ইসলামে এভাবে বিধর্মীদের ঘর পোড়াতে বলা হয়নি কিংবা ইসলামে সহনশীলতার এই এই উদাহরণ দেওয়া আছে। এটা কি আদৌ জরুরি? কোনও ধর্মেই তো এমন জ্বালাও পোড়াওকে বৈধতা দেওয়ার কথা নেই। ধর্ম মানেই তো সহনশীলতা, শান্তি। যে কারণে অন্তত আমার মনে হয় ‘রেফারেন্স’ টানার চর্চাটা বন্ধ করতে হবে। যারাই দাঙ্গা-হাঙ্গামার সমর্থনে কথা বলবে, তাদের চিনে রাখতে হবে। তার সঙ্গে জেনে বুঝে বাতচিৎ করতে হবে। তাকে চটানো চলবে না। তাকে হাসিমুখে বলতে হবে যে ভাই আপনার নাতনির আকিকার মিষ্টিটা কিন্তু জয়গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে আনা হয়েছে। মানসিক বিকলাঙ্গকে তো আর ধরেবেঁধে রিমান্ডে নিয়ে ‘মানুষ’ বানানো যাবে না। তাতে বিদ্বেষের দুষ্ট চক্রটাই বাড়বে।

আরও একটা বিষয় এখানে কাজ করতে পারে— পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু ঘটলে (ধরুন চালের দাম ১৫০ বা ব্রয়লারের দাম ৩০০ টাকা হলো) তাতে আমরা সাধারণত প্যানিকড হই না। আমরা মানে সাতে-পাঁচে-চারে না থাকা জনগণ এসবে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এসব ঘটনায় কোটি কোটি টাকা লুটপাট বা অগণিত মানুষের একবেলা খাবার অনিশ্চিত হলেও একজোট হয়ে জ্বালাও-পোড়াওয়ের প্রশ্নই আসে না। কেননা, এসব ঘটনায় বিশেষ সেই ‘ভাইরাল’ মজাটা নেই। পরিস্থিতি যখন পরিকল্পনার বাইরে যায়, তখনই খেলাটা জমে। আর খেলা মানে তো মগজের রসদ। সুতরাং এই যে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে এর উদ্দেশ্য মূলত একটাই, ভিন্ন কিছু খেলা চাই। নিরানন্দ ইস্যুবিহীন দিন যে ওই খেলুড়েদের কাটতেই চায় না। তারা মানুষকে দাবার ঘুঁটি বানায়। দুর্বল বিবেকসম্পন্ন ওই স্যোশিওপ্যাথদের ধর্মীয় ট্যাগ দেওয়াটাই বোকামি।

এ কারণে আমাদের আগেই বুঝে নিতে হবে, যে হিন্দুদের বাড়ি পোড়ায় সে কোন ধর্মের? উত্তর পেতে খানিকটা ফ্রয়েডীয় রিপ্রেশেন তত্ত্ব কপচানো জরুরি। ওই তত্ত্বমতে, আমরা আমাদের ভেতর যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা, স্মৃতি বা কোনও পাপের অনুভূতি ধরে রাখতে চাই না। তখন আমাদের অবচেতন মন সেই ঘটনা বা অনুভূতিটাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ কাজটা অবচেতন মনও করে, আবার আমরা নিজেরাও করি। আগুন, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, খুন—এসব ঘটনায় দেশের বেশিরভাগ মানুষ জড়িত না হলেও একটা বড় অংশ কিন্তু সেই বিকৃত খেলার অতি-নীরব দর্শক সেজে বসে আছে। তাদের ভেতর কাজ করে সেই রিপ্রেশন। নিজের ভেতর পাপের বোঝা এত বেশি যে তাদের অবচেতন মন বলছে, কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হলেও বোঝাটা হালকা করি। প্রতিমা, ঘর, মন্দির যারা পোড়ালেন, যদি ধর্মের দোহাই দিয়েই পোড়ান, তবে তাদের কাছে প্রশ্ন— পাপের বোঝা হালকা হলো, নাকি বাড়লো?

পরিশেষে ব্যাটম্যান সিরিজের ‘ডার্ক নাইট’ সিনেমার শেষের দিককার একটি দৃশ্যের প্রসঙ্গে টানা যাক। দুটো জাহাজ। একটিতে সাধারণ লোকজন, আরেকটিতে আছে সাজাপ্রাপ্ত একদল কয়েদি। দুটো জাহাজেই রিমোট কন্ট্রোলারচালিত বোমা রাখা আছে। একটি জাহাজের বোমার কন্ট্রোলার রাখা আছে আরেকটি জাহাজের লোকজনের হাতে। সময় দেওয়া হলো রাত ১২টা। এরমধ্যে কয়েদিরা যদি বাটনে চাপ দেয় তো সাধারণ লোকজন মারা যাবে, আর সাধারণ মানুষরা যদি বাটনে চাপ দেয় তো কয়েদিরা মারা যাবে। শেষতক ১২টা বেজে গেলেও কেউ বাটনে চাপ দেয়নি। দুটো জাহাজই ছিল অক্ষত। হারলো ভিলেন, জিতলো মানবতা।

 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

ই-মেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ