X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাদ গেলো না কুয়েটের ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচনও

রুমিন ফারহানা
০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৪আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৪

রুমিন ফারহানা বাড়িতে ঢুকেই তার প্রথম কাজ ছিল একমাত্র কন্যাসন্তানকে কোলে তুলে নেওয়া। বাবা না এলে মেয়ে কখনও খেতো না। এখন যেহেতু বাবা নেই, তাই মেয়েটিকে কিছুতেই খাওয়ানো যাচ্ছে না। তার একটাই আবদার, বাবা না এলে খাবে না সে। বলছিলাম খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের কথা।

খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষটি শুধু নিজের মেধার জোরে পৌঁছেছিলেন আজকের অবস্থায়। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে ফল বিক্রি করতে হতো তাকে। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে কুয়েট থেকে পাস করে অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি শেষে দেশে ফেরেন তিনি। চাইলেই কিন্তু পারতেন অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে। হয়তো সেটা করলেই ভালো হতো। অন্তত ৩৮ বছর বয়সে মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না তার।

সম্প্রতি কুয়েটের লালন শাহ হলে ছাত্র আবাসিক হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য-ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে, সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান প্যানেলের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ ওঠে।

ওই প্যানেলের সদস্যরা প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিলেন, তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় ৩০ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের একটি ক্যাডার গ্রুপ ক্যাম্পাসের রাস্তা থেকে ড. সেলিম হোসেনকে জেরা করা শুরু করে। পরে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত ঘরে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধঘণ্টা ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে। এর পরপরই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ও অসুস্থ হয়ে যান।  

পরবর্তীতে, শিক্ষক ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের উদ্দেশে ক্যাম্পাসে তার বাসায় যাওয়ার পর বাথরুমে ঢোকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী লক্ষ করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। পরে, দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে, কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

এই ঘটনায় গঠিত প্রাথমিক তদন্ত কমিটি ‘রহস্যজনক’ কারণে সেই তদন্তে অপারগতা প্রকাশ করে, এরপর ভিন্ন একটি কমিটি গঠিত হয়। ঘটনার পর অতি স্বল্প সময়ের নোটিশে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের হল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত একদিকে করোনার পর মাত্র শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের জীবনে বড় ক্ষতির কারণ যেমন হয়েছে, তেমনি অতি স্বল্প সময়ের নোটিশে হল খালি করার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগে ফেলেছে।

ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে প্রাথমিকভাবে ৯ জন ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

আমি মানি, ছাত্রলীগ জনাব সেলিমকে খুন করে ফেলতে চায়নি, কিন্তু তাদের তৈরি করা তীব্র মানসিক নির্যাতন যে চাপ তৈরি করেছিল জনাব সেলিমের ওপর, তাতেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়। এটা পত্রিকাকে দেওয়া তার স্ত্রীর বর্ণনায় স্পষ্ট। একজন আইনজীবী হিসেবে পুরো ঘটনাটিকে আমার মনে হয়েছে কাল্পেবল হোমিসাইড, যেখানে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী কাউকে হত্যার উদ্দেশ্য না থাকলেও কারও কারণে কেউ মারা গেলে তার ফৌজদারি অপরাধ হয়। আমরা প্রশাসনের সদিচ্ছা আছে বলতে পারতাম যদি দেখতাম ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। মামলা করা মানেই কেউ অপরাধী প্রমাণিত হয়ে সাজা পেয়ে যাবে তেমনটি নয়। কিন্তু এটুকুও সরকার চাইছে বলে মনে হয় না।

সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী তার বক্তব্যে প্রশ্ন তোলেন, ‘বাগবিতণ্ডা হলে কি সবাই স্ট্রোকে মারা যায়?’ তার এই বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে তিনি ছাত্রলীগকে দায়মুক্তি দিতে চান।

অতীতেও এই ধরনের ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু বহিষ্কার করে দায় সেরেছিল সরকার। ছাত্রলীগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এর পদাসীন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে চাঁদাবাজির দায়ে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অথচ অবাক কাণ্ড, তাদের বিরুদ্ধে কোনও ফৌজদারি মামলা করা হয়নি। ছাত্রলীগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বহিষ্কারের এই ঘটনাই যথেষ্ট এটুকু বোঝার জন্য যে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল। এবং তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেটা ফৌজদারি। সুতরাং একটি ফৌজদারি অভিযোগ, যেটির প্রাথমিক সত্যতাও নিশ্চিত, সেটির ক্ষেত্রেও কোনও মামলা না করে বহিষ্কার করেই দায় সারা হয়েছে।

কুয়েটের এই পুরো ঘটনাটি ঘটলো হলের ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। যে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় (সংসদ নির্বাচন) আর যে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না (স্থানীয় সরকার নির্বাচন) তাদের মধ্যে ন্যূনতম কোনও পার্থক্য নেই। বাংলাদেশের সব নির্বাচনকেই এখন মোটামুটি বিনা প্রতিদ্বন্দিতা, ইলেকশনের জায়গায় সিলেকশন বানানো হয়েছে। এই যেমন, কয়েক ধাপে চলছে ইউপি নির্বাচন। এরমধ্যে প্রথম তিন ধাপেই ২৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়ে বসে আছেন।    

বাংলাদেশের নির্বাচনের রোল মডেল এখন কুমিল্লার লাকসাম ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসন লাভ করেন। অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২৬ জন পুরুষ ও ৪২ জন সংরক্ষিত আসনের সদস্য সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যের ১৮২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন না হয়ে 'নির্বাচিত' হন। নির্বাচনে কোনও বিদ্রোহী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। এটি সংবিধানের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবার যে শর্ত, তার বিপরীত।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে চলছে সহিংসতা। ইতোমধ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত হানাহানিতে প্রাণ দিয়েছেন ৭৪ জন। বিরোধী দল বিএনপি যেহেতু প্রতীকে অংশ নিচ্ছে না, তাই খুনোখুনিটি ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটাকে খুনোখুনি বলতে নারাজ। তার ভাষায় এটি নিছক ‘ঝগড়াঝাটি’। নির্বাচনের প্রচারণায় যে ভাষা সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ব্যবহার করছে সেটি শুধু যে নির্বাচনি আচরণবিধির লঙ্ঘন তাই না, একই সাথে সেটি নির্বাচনি মাঠের বীভৎসতাও ফুটিয়ে তুলছে। একে ৪৭ ব্যবহার করা থেকে শুরু করে ভোট না দিলে কবরে জায়গা না দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত যে ভাষা নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়েছে তাতে সরকারি দলের বাইরে যে কোনও প্রার্থী আর ভোটারেরই পিলে চমকে যাবার কথা। এই সবই রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, ভোটারসহ নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সকল অংশীজনকে নির্বাচন থেকে শত হাত দূরে রাখবার জন্য যথেষ্ট। মনে করিয়ে দেই, বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ নেয়নি। নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে দমন করতেই যদি এ ধরনের অবস্থা তৈরি করতে হয়, তাহলে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিলে কী অবস্থা হতে পারতো তা সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশে নির্বাচন হোক কিংবা না হোক, সহিংসতা হয় পুরো মাত্রায়। সেটির দায় যেমন কাউকে নিতে দেখি না, তেমনি কোনও তরফেই এই ধরনের সহিংসতা বন্ধের কোনও উদ্যোগও লক্ষ করা যায় না। বরং পুরো বিষয়টিকে ‘ঝগড়াঝাটি’, ‘পাহারা দিয়ে সহিংসতা ঠেকানো যাবে না’, ‘কেন্দ্রে কেউ মারা যায়নি’ ইত্যাদি বলে দায় এড়ানোর একটা চেষ্টা লক্ষণীয়। সে কারণেই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার মনে হয়, বাংলাদেশের সব ধরনের নির্বাচন, তা সে যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন, বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তাতে অন্তত বেশ কিছু মর্মান্তিক মৃত্যু এবং মৃতের পরিবারের সীমাহীন দুর্ভোগ এড়ানো যাবে।  

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ