X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর 'পীর' হত্যা: প্রতিবাদের শ্রেণিচরিত্র

রাহমান নাসির উদ্দিন
১২ মে ২০১৬, ১৪:০৩আপডেট : ১২ মে ২০১৬, ১৬:৪২

রাহমান নাসির উদ্দিন পুঁজির বেপরোয়া বিকাশের যুগে সর্বজনীন সংবেদনশীলতা বলে কোনও কিছু সমাজে আর জারি নেই। ব্যক্তির আত্মপরতা শ্রেণিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ও ঘটনাকেন্দ্রিক মানুষের সংবেদনশীল নড়াচড়া এবং সমাজের ক্রিয়া (অ্যাকশন) কিংবা প্রতিক্রিয়ার (রিয়েকশান) ধরন ও চরিত্র নির্ধারণ করে। ফলে, কোন ঘটনায় আমরা কতটা উতলা হব, কতটা আহাজারি করব কিংবা কতটা নির্লিপ্ত (রিলাকট্যান্ট) থাকব, সেটা ঘটনার শ্রেণিচরিত্রের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। সর্বজনীন মানবিকতা কিংবা সামাজিক সংবেদনশীলতা বলে আদৌ কিছু নেই! আমার এ নাবালক উপলব্ধি নতুন করে সাবালক হয়েছে রাজশাহীর পীর হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের সম্মিলিত নির্লিপ্ততা এবং সামাজিক উদাসীনতা দেখে।
রাজশাহী তানোর উপজেলায় গত ৭ এপ্রিল  শহীদুল্লাহ নামে এক পীরকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। রাজশাহীর এসপি নিশারুল আরিফ বলেছেন, ‘সম্প্রতি যে ধরনের খুনের ঘটনা ঘটছে, তার সঙ্গে এ খুনের মিল রয়েছে’। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী পুলিশ অন্যান্য হত্যার মতো এ ঘটনায়ও 'উগ্রপন্থী'দের সন্দেহ করে তদন্ত কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এ পীর হত্যার প্রতিবাদে কোথাও কোনও চেতনার নড়াচড়া দেখছি না। রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে যখন হত্যা করা হলো, তখন তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও লাগাতার আন্দোলন চলছে এবং সেটা বেশ যৌক্তিকভাবেই হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এমনকি অধ্যাপক রেজাউল হত্যার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন দেশব্যাপী সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে তিনঘণ্টার কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তনু হত্যার প্রতিবাদে সমাজের সর্বত্র আলোড়ন উঠেছে। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে একদিন সারাদেশে আধাবেলা হরতাল পর্যন্ত ডাকা হয়েছে। আমরা  সঙ্গত কারণেই সে হরতালকে সমর্থন করেছি। জুলহাজ মান্নান হতাকাণ্ডেরও তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। খোদ নিশা দেশাই সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে উড়ে এসে এ হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তনয় হত্যার প্রতিবাদে অন্যদের পাশাপাশি প্রতিবাদ করেছেন নাট্যকর্মীরা; কারণ তনয় একজন নাট্যকর্মী ছিলেন। সেই রাজীব হায়দার থেকে এ পর্যন্ত যখনই কোনও ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত হিসেবে গ্রহণ করে সমাজের সর্বস্তরে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। আমি নিজে ব্লগার হত্যা নিয়ে অন্তত ডজন খানেক নিবন্ধ লিখেছি সংবাদপত্রে।
যখনই কোনও ব্লগারকে হত্যা করা হয়, ‘সবকিছু গেল-গেল’ রব ওঠে। কিন্তু একই কায়দায় যখন একজন পীরকে হত্যা করা হলো, সমাজ তখন নির্বিকার। সুশীলরা লা-জবাব। প্রগতিশীলরা আড়ষ্ট। চেতনাজীবীরা কনফিউজড! কোথাও কোনও প্রতিবাদ নেই।
গত ২২ এপ্রিল টুঙ্গিপাড়ায় যখন পরমানন্দ রায় নামের এক সাধু ঘাতকের ছুরিকাঘাতে নিহত হন, তখনও কোথাও কোনও আওয়াজ শুনিনি। এসব নিয়ে কোনও হরতাল হয়নি, কর্মবিরতি হয়নি কিংবা কোনও মানববন্ধন হয়নি। দর্জি নিখিলচন্দ্রকে যখন একই কায়দায় খুন করা হয়, তখনও কোনও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দেখিনি। কোনও মানববন্ধন নেই।

কেন? কারণ- ‘সাধু’, ‘পীর’ কিংবা দর্জি— এরা তো ঠিক ‘মানব’ নন! সমাজবিজ্ঞানী জর্জিয়া আগামবেন তার ‘স্টেট অব এক্সেপশান’-এ এদেরই বলেছেন সমাজের চোখে ‘বাতিল মানুষ’। এরা মরে গেলেও সমাজের কিছু যায় আসে না। এরা তো এমনিতেই ‘খালাসের মাল’! এটা আসলে আমাদের সুবিদাবাদী শ্রেণিচরিত্রের একটা বেহায়া রিফ্লেকশান।

আমাদের এ সম্মিলিত নির্লিপ্ততা এবং সামাজিক উদাসীনতা প্রমাণ করে, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদেরও একটা শ্রেণিচরিত্র আছে। ‘হত্যা’র বা নিহত ব্যক্তির জেন্ডার, ক্লাস, পেশা, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থানই আমাদের ক্রিয়া কিংবা প্রতিক্রিয়ার ধরন ও চরিত্র উৎপাদন করে কিংবা আমরা যাকে মানবিক চেতনা বা সংবেদনশীল মানসিকতা বলি, সেই মানবিকতা ও চেতনাকে নির্মাণ করে। অর্থাৎ প্রকারান্তরে আমাদের শ্রেণিচরিত্রই আমাদের চেতনার জোয়ার-ভাটা নির্ধারণ করে। আমরা 'হুদাই' চেতনা চেতনা করে 'বেহুদা বাকোয়াজ' করি। আমার কাছে মনে হয়, এটা শহুরে শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের ক্রমবর্ধমান মনোজাগতিক চেতনাবৈকল্য ছাড়া আর কিছু নয়। এ ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, আমরা যতই সমাজের চরিত্র পাল্টানোর  স্লোগান তুলিনা কেন, আসলে আমাদের শ্রেণিচরিত্র না পাল্টালে সমাজ পাল্টাবে না। তাই অভিজিৎ, দীপন, তনু, রেজাউল, জুলহাজ, তনয় প্রমুখ হত্যাকাণ্ডের যেমন আমি প্রতিবাদ করেছি, তেমনি এ সাধু, দর্জি এবং পীর হত্যাকাণ্ডেরও তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

বাংলাদেশে এখন একটা 'কোপাকুপির কাল' চলছে। সর্বত্র কোপাকুপি। যখন তখন যে কেউ যেকোনও পরিস্থিতিতে যেকোনও জায়গায় দা কিংবা চাপাতির কোপে ‘নাই’ হয়ে যেতে পারেন। সেটা অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তায় যেমন অধ্যাপক রেজাউল হয়েছেন কিংবা দারোয়ান পাহাদারসহ সুরক্ষিত নিজের বাসার ভেতরে যেমন জুলহাজ-তনয় হয়েছেন, যেকোনও পরিস্থিতিতে আপনি কোপাকুপির নাগালেই আছেন।

গত ২২, ২৩ এবং ২৫ এপ্রিলের ঘটনার পর মনে হচ্ছে এ কোপাকুপি রোগটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২২ এপ্রিল টুঙ্গিপাড়ায় পরমানন্দ রায় নামের এক সাধু ঘাতকের চুরিকাঘাতে নিহত হন। ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে চাপাতির আঘাতে হত্যা করা হয়। একদিন না-যেতেই ২৫ এপ্রিল নিজ বাসায় জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিনে আরও দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কুষ্টিয়ায় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

এভাবেই ‘কুপিয়ে হত্যা’, ‘গলা কেটে হত্যা’, ‘চাপাতির কোপে হত্যা’ এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। এপ্রিল মাসেই (৮ এপ্রিল) সিলেট গণজাগরণ মঞ্চকর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে এসব ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। কিন্তু সব ঘটনাকে একত্রে গাঁথলে বোঝা যায় এসব ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা বটে কিন্তু আখেরে কোনওটাই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নয়। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে খুন খারাবি হবে। সেটা নানা কারণে হতে পারে। ‘উন্নত দেশ’বলে আমাদের যাদের উদাহরণ দেওয়া হয়, সেসব দেশেও খুন হয়। হয়তো সংখ্যার বিচার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি খুন হয় এ রকম দেশের সংখ্যা পৃথিবীতে কম নয়। কিন্তু প্রায় একই কায়দায়, একই ঘরানার মানুষ প্রায় এক গোষ্ঠীর লোক দ্বারা এভাবে নিয়মিতভাবে খুন হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। তাই এসব সিরিয়াল কিলিংকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে রাষ্ট্র সমাজের বিদ্যমান অস্তিত্বকে লুকানোর যেমন একটা ব্যর্থ চেষ্টা করছে, তেমনি  দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা ঢাকার একটা সুকৌশল চতুরতা এর মধ্যে নিহিত আছে।

তবে যতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এসব হত্যাকাণ্ডকে পাতলা করে উপস্থাপন করা হোক না কেন, এর মধ্য দিয়ে নাগরিকনিরাপত্তা যে ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ছে, সেটা আমাদের বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ফলে রাষ্ট্র আর জনগণের মধ্যকার আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে যখন সমাজের ভেতর থেকে একটা তীব্র সামাজিক সংবেদনশীলতা এবং সর্বজনীন মানবিকতার বোধ উৎসারিত হওয়া জরুরি হয়ে উঠছে, তখন আমাদের শ্রেণিচরিত্র প্রবল প্রতাপে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধরন, রূপ ও মাত্রা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

পরিশেষে বলব, দলীয় সুবিধাবাদ, দলকানা বুদ্ধিজীবিতা, আত্মপর মধ্যবিত্ত মানসিকতা, শ্রেণিস্বার্থ-কেন্দ্রিক উদাসীনতা এবং দাতার নাটাইয়ে নাচনেওয়ালা সুশীলরা বাইরে এসে নাগরিকনিরাপত্তা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ চিন্তার পক্ষে আমাদের সবার শক্ত অবস্থান সুনিশ্চিতকরণ আজ জরুরি হয়ে উঠেছে। আমি সবসময় আমার লেখালেখিতে অ্যাডভোকেসি করি, আমাদের মনে রাখতে হবে, কারও সঙ্গে কোনও অন্যায় হলে, তার প্রতিবাদ করতে হবে এজন্য যে, সে অন্যায় একদিন আমার সঙ্গেও হতে পারে। আজ যদি আমি অন্যের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি, তাহলে আমার প্রতি যদি কোনওদিন কোনও অন্যায় হয়, অন্যরা সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না। এভাবেই সমাজে অন্যায়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে, যা থেকে আমিও রেহাই পাব না। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বাল্যশিক্ষা হচ্ছে, সমাজে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সমস্বরে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করা। চে বলেছিলেন, এটাই সমাজ বিপ্লবের প্রাথমিক পাঠ।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ