X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘মানুষ নামটি লিখে আমি তাতে… দিতে চাই’

চিররঞ্জন সরকার
২৮ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৫৩আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৫৫

চিররঞ্জন সরকার এসব নিয়ে লিখতে মন চায় না। এক গভীর বিষাদ হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে। এ কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? পাঁচ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করা যায়? তার ওপর এমন পৈশাচিক নির্যাতন চালানো যায়? পাঁচ বছরের শিশু পূজা তার বাবার পরিচিত যে পঁয়তাল্লিশ উর্ধ্ব সাইফুল্লাহকে ‘বড় আব্বা’ বলে ডাকতো, সেই সাইফুল্লাহই যখন আর এক আটত্রিশ বছর বয়সীকে সঙ্গী করে শিশু পূজাকে একটি ঝোপের আড়ালে নিয়ে আঠাশ ঘণ্টা ধর্ষণ করে এবং শিশুটির যোনিপথ খুব ছোট বলে ব্লেড দিয়ে যোনিপথ কাটে- তখন নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে সীমাহীন গ্লানি বোধ হয়! মানুষের এমন হিংস্রতা, বিকৃত কাম ও নৃশংসতা দেখে কবি রফিক আজাদের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, ‘মানুষ নামটি লিখে আমি তাতে মুতে দিতে চাই।’
এ কোন বিশ্বাসহীনতার অন্ধ গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা! চোখের তারায় আমাদের অনিঃশ্বেস সন্ধিগ্ধতা, দিশেহারা আতঙ্ক আমাদের নিত্য সহচর এ ভাবে পুরুষকে পাশে নিয়ে কী ভাবে বাঁচবে মেয়েরা? অল্প চেনা থেকে অতিপরিচিত, এমনকি নিকটতম পুরুষ বন্ধুটিকে ঘিরেও আমাদের সম্পর্কের নামে সর্বদা সন্দেহের পাঁচিল তুলে রাখতে হয়। কোনও সম্পর্কের কি এটাই গভীর ট্র্যাজেডি নয়?
প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় শিরোনামে আসছে নারী নির্যাতনের খবর। ধর্ষণ ও হত্যার খবর। পুরুষতান্ত্রিক বিধানে যৌনতার অনুষঙ্গকে বহন করে চলার আবহমানকালের অভ্যাস মেয়েদের মেনে নিতে হয়েছে বলে নিজস্ব এক সন্ত্রাসের জগতে বাঁচাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অনিবার্য নিয়তি। সে জগতে পুরুষের প্রতিপক্ষে একা নারী, নারীর মন সেখানে অস্বীকৃত-উপেক্ষিত, কেবল আছে তার শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস। ভোগের সেই উৎসবে শামিল শত-সহস্র-লক্ষ জন। নইলে ব্যক্তিগত যৌনলালসা থেকে পারিবারিক বিবাদের আক্রোশ পর্যন্ত যে-কোনও কারণেরই সহজ শিকার নারী, প্রতিশোধস্পৃহার সহজ নিবৃত্তি ধর্ষণ কেন? এই হিংস্রতার অনালোচিত বৃত্তে ধরা দিতে হয় কখনও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোনও সপ্রতিভ মেয়েকে, কখনও নিরীহ গৃহবধূকে, হতদরিদ্র কর্মজীবীকে, আবার কখনও পাঁচ বছরের অবোধ বালিকাকে, মূক-বধির তরুণী, এমনকী দুই-তিন বছরের শিশুকন্যাকেও, কারও নিস্তার নেই।
সম্প্রতি শিশু যৌন নির্যাতনকারীদের রাসায়নিক ব্যবহার করে নপুংসক করে দেওয়ার একটি আইন পাস হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরীকে ধর্ষণের প্রেক্ষাপটে এই আইনের প্রস্তাব করেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ‘রাসায়নিক নপুংসকীকরণ’ প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তকে নারী হরমোনের ইনজেকশন দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এই প্রক্রিয়ায় যৌন নির্যাতনকারী পুরুষ অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এমন বিধান চালু করার দাবি জোরোলো হয়ে উঠছে। আমাদের দেশে এক শ্রেণির ‘এক্সট্রিমিস্ট’ মানুষ আছেন, যাদের কাছে কাছে ধর্ষণের সমাধান দুটো, হয় মৃত্যুদণ্ড, নয় পুরুষাঙ্গ-কর্তন। এ দুটো শাস্তি ধর্ষকদের দিলেই নাকি নাবালিকা ধর্ষণের ইতি ঘটবে। 

কিন্তু তা কি ঠিক? নারী নির্যাতন রোধে শক্ত আইনই কি যথেষ্ট? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা যুক্তরাজ্যে কিন্তু কঠোর বিধান করেও নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণ ঠোকানো যায়নি। আসল ব্যাপার অন্য জায়গায়, পরিবারে সমাজে নারীকে মর্যাদা প্রদান করা, নারীর প্রতি নেতিবাচক মানসিকতা দূর করা। যে সব দেশে শিশু-ধর্ষণ সবচেয়ে কম, সে সব দেশে পুরুষাঙ্গ-কর্তন বা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নেই। তবে সে সব দেশে মেয়েদের মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মেয়েদের স্বাধীনতা এবং অধিকার সে সব দেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি, সে সব দেশে মেয়েরা শিক্ষিত, মেয়েরা স্বনির্ভর, সংরক্ষিত আসনের সুযোগ ছাড়াই সংসদ সদস্যের পঞ্চাশ ভাগই মেয়ে।

নাবালিকা-সাবালিকা সব ধর্ষণই বহাল তবিয়তে চলে সে সব দেশে, যে সব দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মেয়েদের ভোগের বস্তু, দাসী-বাঁদি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন প্রাণী, নিচু জাতের জীব ইত্যাদি হিসেবে বিচার করে।

নারীবাদীরা বলেন, ‘যে দিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সে দিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ। কবে, কখন বন্ধ করবে, সে সম্পূর্ণই পুরুষের ব্যাপার। পুরুষরা সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নিক যে এই দিন থেকে বা এই সপ্তাহ থেকে বা এই মাস থেকে বা এই বছর থেকে নিজের প্রজাতির ওপর ভয়াবহ বীভৎস এই সব নির্যাতন তারা আর করবে না।’ কথাটি কি মিথ্যে? কিন্তু নারী নির্যাতনের পুরুষের কণ্ঠস্বর এত দুর্বল কেন?

কঠোর শাস্তির বিধান, আইনের যথাযথ প্রয়োগ-এগুলো নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ রোধে অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু দরকার আরও কিছু। সবেচেয়ে বেশি দরকার নারীদের সম্পর্কে আমাদের সামিষ্টিক মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। বিশেষ করে পুরুষের।

দেখা যাচ্ছে নারী ও শিশুরাই বিকৃতকাম মানুষের ‘সফট টার্গেট’। শিশুকে সহজে ভুলিয়ে কব্জা করা যায়, একটা লজেন্সের টোপ দিলেই কাজ হয়। অধিকাংশ সময় বাচ্চাটি বুঝতেই পারে না তার সঙ্গে কী হলো। ফলে কাউকে ভালো করে বোঝাতে বা জানাতে পারে না। আবার বুঝতে পারলেও তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকে না। খুব সহজে এদের দাবড়ে, ভয় দেখিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া যায়। তা ছাড়া, এই উপমহাদেশে শিশু-ধর্ষণ নিয়ে ঢাকঢাক-গুড়গুড়-এর ঐতিহ্য অনন্তকালের। ‘বাচ্চা ঠিক সব কিছু ভুলে যাবে। বরং এই নিয়ে হইচই করলে শুধু শুধু তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে, পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে’— এই মানসিকতা নিয়েই চলছি আমরা। সমাজ-রাষ্ট্র-আইন-সবই যেখানে বধির, সেখানে আগাম সতর্কতার সর্বোচ্চ দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদের। শুধু টিনএজার বা যুবতীদেরই ধর্ষিতা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এই ধারণা থেকে প্রথমে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিস্থিতি বিশেষে আত্মীয় বা প্রতিবেশীর কাছে দীর্ঘক্ষণের জন্য না-পাঠানো, পাঠালেও মাঝে কয়েক বার তার খোঁজ নেওয়া দরকার। একটু জ্ঞান হওয়ার পর গান কিংবা অক্ষর শেখানোর মতোই শিশুকে শেখাতে হবে, ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ কী। কেউ জোর করে কোলে বসাতে চাইলে, জবরদস্তি চুমু খেলে, যৌনাঙ্গে হাত দিলে মাকে বা ভরসার কাউকে এসে বলতে হয়। শেখাতে হবে, পরিচিত-অপরিচিত কেউ লজেন্স, পুতুল বা বিস্কুট দেবে বলে নিজের ঘরে ডাকলে সেখানে যেতে নেই।

অনেকে প্রতিবাদ করতে পারেন, এ ভাবে তো শিশুর নির্ভেজাল, অমলিন শৈশব খুন করে তাকে অকালপক্ব করে দেওয়া হবে। দাঁড় করিয়ে দেওয়া হবে পৃথিবীর কুৎসিত মুখটার মুখোমুখি। শিশুর মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে প্রাপ্তবয়স্ক সংশয়, সন্দেহ। হয়তো কিছুটা হবে। কিন্তু পালটা যুক্তিও বড় কম নয়: যদি সতর্ক না হওয়ার ফলে কোনও শিশু ধর্ষিত হয়, যা হামেশাই হচ্ছে, তা হলে তার শৈশব তো অনেক বেশি তছনছ হবে। তার থেকে অল্প বয়সে তাকে মানসিক ভাবে সজাগ, সচেতন করলে যদি তাকে যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচানো যায় সেটাই শ্রেয় নয় কি?

বাচ্চার কথাকে গুরুত্ব দেওয়াও শিখতে হবে অভিভাবককে। তার সব কথা ‘ফালতু’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার ফল মারাত্মক হতে পারে। প্রতি দিন বাড়িতে, স্কুলে, পাড়ায় শিশু কার কার সঙ্গে কী কী করল তা খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে। শিশুকে এমন একটা ধারণা দিতে হবে যে পরিবারে, আপনজনের কাছে সে পুরোপুরি সুরক্ষিত, কেউ তাকে অকারণে মারতে বা বকতে পারবে না। সে যেন নির্ভয়ে মনের কথা খুলে বলে।

পাশাপাশি আর একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক পরিবারের খুদে ছেলেটিকে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাতে হবে। বীজ বপন শুরু করতে হবে এমন এক নতুন প্রজন্মের, যারা ছোট থেকে মেয়েদের দেহসর্বস্ব যৌনবস্তু ভাববে না।

ধর্ষণ কেবল নারী নির্যাতন নয়, তা বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের একটি প্রকাশ। তাই ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তাহার প্রতিকার করা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আক্ষেপের বিষয় এই যে, রাষ্ট্র এ বিষয়ে তার কর্তব্য থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। খুব কম ঘটনার ক্ষেত্রেই পুলিশ অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করছে। আদালতেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই অল্প সংখ্যক মামলা।এই দুটিই অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমনিতেই প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য উপস্থিত করা কঠিন বলে প্রমাণের অভাবে বহু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত মুক্তি পেয়ে থাকে। তার উপর যদি তদন্ত এবং বিচারের স্তরেই অভিযোগ পৌঁছাতে না পারে, তাহলে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠবে। শাস্তির কঠোরতার চেয়েও শাস্তির নিশ্চয়তা অপরাধীদের নিরস্ত করে বেশি। অতএব আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে এ বিষয়ে সজাগ হতেই হবে।

এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরই পথ দেখাবার কথা ছিল। অগত্যা, রাষ্ট্র যাতে শেষ পর্যন্ত পরিবর্তনের হালটি শক্ত করে ধরতে পারে, সচেতন মানুষকে সোচ্চার হয়ে রাষ্ট্রের ঘাড় ধরেই তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সেটা করতে ব্যর্থ হলে আমরা মানুষ হিসেবেই ব্যর্থ হব! সেক্ষেত্রে রফিক আজাদের কথাটিই ধ্রুব সত্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশে পাচারের আগে আড়াই কোটি রুপির হেরোইন জব্দ
বাংলাদেশে পাচারের আগে আড়াই কোটি রুপির হেরোইন জব্দ
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
৩৪জন পেলো ইয়েস কার্ড
৩৪জন পেলো ইয়েস কার্ড
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের দলে আছেন আর্চার-জর্ডান
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের দলে আছেন আর্চার-জর্ডান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ