X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারীর গর্ভ, নারীর সিদ্ধান্ত

বিথী হক
১৩ মার্চ ২০১৭, ১৮:২৬আপডেট : ১৩ মার্চ ২০১৭, ১৮:২৮

বিথী হক একটা সময় ছিল যখন আমাদের মা, খালা, চাচিদের দশ/বারোটা করে বাচ্চা হয়েছে। যে নারীর যত সন্তান, তার বুকের বল তত বেশি, তার শক্তি তত বেশি। তখন অবশ্য যক্ষ্মা, ধনুষ্টংকারে শিশু মৃত্যুর হারও ছিল বেশি। বারোটা বাচ্চার মধ্যে পাঁচ/সাতটা বাঁচলেও তখন বাবা-মা কান্নাকাটি করেই খুশিমনে বেঁচে যাওয়া সন্তান লালন-পালন করতেন। এখনকার বাবা-মায়েরা একটি/দু’টি বাচ্চা হলেই হাঁপিয়ে যান। তিন নাম্বার সন্তান নিতে আগ্রহী এমন বাবা-মায়ের সংখ্যাও হাতেগোনা। এখন দিনকে দিন নারীরা সংসারী থাকার পাশাপাশি অফিস-আদালতে কাজ করছেন। অফিসে একবার মাতৃত্বকালীন ৬ মাসের ছুটি দিলে দু’তিন বছরের বন্ড সই করিয়ে নেন। পরপর দু’বছর দু’টি সন্তান পেটে এলে সেক্ষেত্রে নিয়মনীতি কী হবে, সে বিষয়ে আমার মতো অনেকেই জানেন না। তবে ৫ বছর একই অফিসে চাকরি করবেন, এমন বন্ড সই করতে নিশ্চয়ই কেউ চাইবেন না, এতটুকু অনেকের জন্যই অনেকখানিই নিশ্চিত। এছাড়া গর্ভে একটি প্রাণ নিয়ে নয়/দশ মাস ঘুরে বেড়ানোটাও চাট্টিখানি কথা নয়।
স্বামীরা গর্ভবতী স্ত্রী নিয়ে ভালোবাসাবাসি ও আদিখ্যেতা  যেটাই করুন না কেন, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীর যে হরমোনের ওঠানামার কারণে হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ, হো হো হাসা, মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়াসহ উদ্ভট উদ্ভট খাবার খাওয়ার ইচ্ছে জাগে, তা কিন্তু তারা অনুভব করতে পারেন না। টের পান না মাঝরাতে ঘুম ভেঙে স্ত্রীর শরীর-মনে কী বইছে। সুতরাং স্বামীসহ আশেপাশের সবাই যাই বলুক, যে নারীর গর্ভে সন্তান, সেই-ই জানে  অনুভূতি কেমন!
আজকাল অনেক নারীই সন্তান নিতে চান না। এর পেছনে অনেকেরই অনেক কারণ রয়েছে। কারও কারণকেই আমার কাছে খাটো করে দেখার মতো মনে হয়নি। আমার এক বন্ধুর লিউকেমিয়া, সে বাচ্চা নিতে চায় না। কারণ তার বাচ্চাও যদি একই সমস্যা নিয়ে জন্ম নেয়,  তবে সে প্রাণ আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে না। একটা জীবন সে এভাবে পৃথিবীতে আনতে চায় না। আমার আরেক বন্ধু আছে, যার জীবনের লক্ষ্যই উপার্জন করে পৃথিবীকে অবাক করে দেবে। একটি বাচ্চা এলে তার জীবন আটকে যাবে। বাচ্চার টয়লেট আর কাপড় পরিষ্কার করতে করতে তার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য কলাপাতায় মুড়িয়ে বছরে একবার বার্ষিক পরীক্ষার পর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নদীতে পা ডুবিয়ে নৌকাবাইচের হুলস্থুলের মধ্যেই ছুড়ে ফেলতে হবে।

পরিচিত আরেক জন আছে, যে সন্তান নিতে চায়নি। কিন্তু তার স্বামীর একার সিদ্ধান্তেই হঠাৎ সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এরপর আর সেই ভ্রূণের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। কিন্তু বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর সে মারাত্মক রকমের ডিপ্রেশনে চলে যায়। আকাঙ্ক্ষিত জীবন পরিণত হয় সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। স্বাভাবিক হাসি-কান্না এড়িয়ে সে এখনও পেছনের কয়েকটা বছরকে মুছে ফেলে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। এমন নারীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। অনেকেই এই লেখা পড়ে বলবেন ‘নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বেই’। এসব ছাইপাশ লিখে নারীদের বিগড়ানোর দায় কে নেবে?

কথা হচ্ছে, জীবন প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত; সে নারী বা পুরুষ যেই হোক। আপনার শরীরের কোথাও কেটে গেলে যেমন আমি টের পাই না, তেমনি আমার মেরুদণ্ডের স্যাক্রাম ভেঙে গেলেও আপনি সে যন্ত্রণা বুঝতে পারবেন না। বাচ্চা ধারণের মতো এই কঠিন কাজটিও আপনার কাছে স্ত্রীর থেকে আপনার চাওয়া ছোট্ট গিফট মনে হলেও বিষয়টি কিন্তু আদতে তা নয়। একজন নারী, যে নয় মাস একলা পেটের ভেতর সন্তান রেখে নিজের সব ইচ্ছে, সব কাজ মূলতবি রেখে শুধু একটি মানুষ জন্ম দেবে, তার সিদ্ধান্তের চেয়ে বড় সিদ্ধান্ত আর কারও হতে পারে না। হোক সে যতই প্রিয় মানুষ, আবদারের তো একটা সীমা টেনে রাখা উচিত।

যেসব নারী সন্তান নিতে চান না, তাদের এই না নেওয়ার ইচ্ছেতেও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে না। পৃথিবীতে সাত শ/আট শ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু নারী-পুরুষ যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই মহান কাজটি না করেন, তাহলেও বংশে বাতি জ্বলবে না বলে হা-হুতাশ করার কোনও কারণ নেই। কেউ সন্তান গ্রহণ না করে নিজের মতো থাকতে চাওয়া তো খুন করার মতো অপরাধ নয়। যার জীবন, সিদ্ধান্ত তার একলার। পেট যার, সুবিধা-অসুবিধাসহ সিদ্ধান্তও তারই। 

এছাড়া নিজের গর্ভ থেকে সন্তান উৎপাদন না করেও যারা মা হতে চান, তাদের তো বাহবা দেওয়াই উচিত বলে মনে করি। বিশ্বে পথশিশুদের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। দিন-রাত এক করে যারা ফুল বেচে, চকলেট বেচে সর্দারের কাছে জমা দিয়ে একবেলার ভাত জোটায়, এতিমখানায়, নর্দমায়, ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চার পরিসংখ্যানও অত হতাশাজনক (সংখ্যা কম নয়) নয় বোধ হয়। কেউ যদি মনে করেন বংশবৃদ্ধি না করে অনাথ এতিম বাচ্চাগুলোকে নিজের পরিচয়টাই দেবেন, তাতে সমস্যার কী আছে? সন্তান মানেই নিজের গর্ভের হতে হবে, এমন চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তনের সময় এসেছে।

নারীর বাক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, বিয়ের স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার পাশাপাশি গর্ভধারণের স্বাধীনতাও একটি  গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। নারীই সিদ্ধান্ত নিক, সে কখন সন্তান জন্মদানে আগ্রহী ও প্রস্তুত। সিদ্ধান্ত নিক আদৌ সন্তান জন্ম দিতে চায় কিনা! না চাইলেও এই বিশ্বে যুগ যুগ টিকে থাকবে, এর বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীরা এখনও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি।

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ