X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাওরের বার্ষিক দুর্নীতি বন্ধ করুন আগে

ফজলুল বারী
২৫ এপ্রিল ২০১৭, ১১:৪৩আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:৪৮

হাওরের বার্ষিক দুর্নীতি বন্ধ করুন আগে ছোট অথচ জনবহুল দেশের ইস্যু দ্রুত বদলায়। হঠাৎ হেফাজত-আওয়ামী লীগের সখ্যের ইস্যু ভিজিয়ে দিয়েছে হাওর অঞ্চলের মানুষের চোখের পানি! প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা খুব মনে পড়ছে এই সময়ে। হাওর অঞ্চলে বেড়ে ওঠা মানুষের নেতা ছিলেন তিনি। বেঁচে থাকলে তার প্রাণের কান্নার কথামালায় অনেককে ফালা ফালা করে দিতো। বিব্রত হতে হতো অনেককে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও হাওর অঞ্চলে বড় হওয়া মানুষের আরেক নেতা। তিনি এই বিপর্যয়ে ছুটে গিয়েছিলেন তার প্রাণের হাওর অঞ্চলে। বেশি কথা বলেননি। আমাদের মতো দেশের সংসদীয় ব্যবস্থার রাষ্ট্রপতিরা বেশি কথা বলতে পারেন না। নানা মানা আছে। হাওর অঞ্চল থেকে বঙ্গভবনে ফিরে রাষ্ট্রপতি আড়ালে কেঁদেছেন কিনা, তা কেউ জানেনি। রাষ্ট্রপতি যদি নিয়মিত ডায়েরি লেখেন, তাহলে হয়তো এসব জানা যেতে পারে একদিন।
হাওর ইস্যু থামিয়ে দিয়েছে তিস্তার পানি ইস্যুও। বর্ষায় এমন তিস্তায় বা ফারাক্কায় পানি এলো কি এলো না, এসব এখন আর ম্যাটার না। ভারতীয় অংশের অতিবৃষ্টি অথবা পাহাড়ি ঢলে এত পানি এসে ঢোকে যে, তাতে হাওর অঞ্চলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।  তখন অবশ্য এসব নিয়ে কেউ ভারতকে দোষ দেয় না! নিয়তি মনে করে! হাওর প্রথম দেখি আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমণের সময়। সুনামগঞ্জ অঞ্চল থেকে বিশ্বম্ভরপুর হয়ে আমি নেত্রকোনার কলমাকান্দা অঞ্চলে ঢূকেছিলাম। তখন সব মাটির রাস্তা। বিশ্বম্ভরপুরের এক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে ছিলাম একরাত। তখনও সেই দুর্গম অঞ্চলে আধুনিক জীবনযাপন তার পরিবারের। সেই ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল, এলাকার উন্নয়নে তিনি তেমন আগ্রহী নন। হীরক রাজার মতো অবস্থা আর কি! এলাকার উন্নয়ন হয়ে গেলে লোকজন চালাক চতুর হয়ে গেলে তাকে মানবে কম!

এরপর একবার আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ জমানায় তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশাররফ হাওর দেখাতে আমাকে ওই অঞ্চলে নিয়ে যান। বাংলাদেশের এলোমেলো অনেক ব্যবস্থাপনার মতো হাওরের মালিক কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়! আবার হাওরের বাঁধসহ নানাকিছুর দেখভালের দায়িত্ব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রীর সফরসঙ্গী সাংবাদিক গেছি হাওরে! আদরযত্ন অনেক। সুনামগঞ্জ থেকে স্পিডবোটে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখেছি জলরাশি আর হাওরের নানা অংশের কর্তৃত্ব নিয়ে নানান পক্ষের টানাহেঁচড়ার বৃত্তান্ত। স্থলভাগে ল্যান্ডলর্ড বলে একটা পদবি অথবা টার্ম আছে। হাওর ঘুরে এসে লেখা রিপোর্টে নতুন একটি পদবি এবং টার্ম লিখতে শুরু করি ওয়াটার লর্ড! পাঠক তা বেশ পছন্দ করেছিল।

বাংলাদেশের নানা পরিকল্পনায় নানা শয়তানি আছে!এর একটি হাওর ম্যানেজমেন্টের 'শয়তানি'! হাওরে পাহাড়ি ঢল এটি নতুন কোনও বিষয় নয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণাও আছে। হাওরের বাঁধগুলো মাটি ও কংক্রিটের স্লাবের। প্রতি বর্ষার আগে কখন বাঁধ মেরামত বা নতুন স্লাব বসানো দরকার, তা হাওর অঞ্চলের মানুষ জানেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীলরা জানেন না, তা কি হয়? আর যেখানে প্রতিবছর এ সব বাঁধ মেরামত করতে হয়, নতুন করে স্লাব বসাতে হয়, সেখানে মাটির এসব বাঁধ আর কতদিন? ফি-বছর মাটির বাঁধের মেরামত, স্লাব বসাতে টেন্ডারসহ নানা কিছুতে দুর্নীতি-টুপাইস কামানোর সুবিধা? হাওর ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তাই সরকারকে নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু করা উচিত। যেহেতু সমস্যাটি প্রতিবছরের, তাই হাওরের ফসল রক্ষার জন্য কি স্থায়ী পাকা বাঁধ করা অসম্ভব? বাংলাদেশ যেখানে এখন নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পারে, সেখানে প্রতি বছর বাঁধ নিয়ে নতুন নতুন বরাদ্দ, চুরি-দুর্নীতি এসবের চেয়ে স্থায়ী বাঁধ তৈরি নিয়ে বাংলাদেশ ভাবতেই পারে। দুনিয়ার দেশে দেশে এমন অনেক কিছু হয়েছে। বাংলাদেশ বড় সেতুগুলোর সঙ্গে নদী শাসনের বাঁধগুলোও স্থায়ী পাকা করে তৈরি করে।

এবার হাওরের সংকটের সঙ্গে বাঁধ নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দুর্নীতির বিষয়টি বড় হয়ে সামনে এসেছে। দুর্নীতির বিষয়টি কবুল করে সংশ্লিষ্ট লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশের এসব দুর্নীতিবাজের দুর্নীতিযজ্ঞে এত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এত কোটি কোটি টাকার ফসলহানি, মৎস্যসম্পদ ধ্বংস, এখন আবার পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে গালিগালাজ শোনার পাশাপাশি এখন শতকোটি টাকা খরচ অথবা গচ্চা দিতে হবে আর ওইসব দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হচ্ছে অন্যত্র বদলি?  এতে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্রোধ বাড়ায়। দেশে দুর্নীতি কমায় না।

এবারের হাওরের সংকটের সঙ্গে দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন কথাবার্তায় সংকট আরও ক্রোধ বাড়িয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উন্নত বিশ্বে সংশ্লিষ্ট এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে এটি সব সময় দাবি করা হয়। ক্ষমতাসীনরা সব সময় দাবিটা এড়িয়ে চলেন। এমন দাবি বিরোধীদলে থাকতে আওয়ামী লীগও করতো। আর এখানে এমন দাবির জবাবে একজন সচিব কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো বলেছেন, একটি এলাকার অর্ধেক লোক মারা না গেলে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় না। একজন মন্ত্রী বলেছেন, বাঁধের চাইতে পানির উচ্চতা বেশি হওয়ায় ফসল তলিয়েছে! আরেক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, হাওরের পরিস্থিতি অত খারাপ না। পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এমন একটি সমন্বয়হীন সরকার বা প্রশাসনের একজনের এক রকম কথাবার্তায় সেখানে ঘৃতাহূতি ছড়িয়েছে। পরিস্থিতি ভালো হলে কি এলাকার তিন লাখ পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি করে চাল আর ডাল-নুন কিনতে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়?

এরপর আবার এবারের হাওরের দুর্যোগ আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে আমাদের কৃষির বাস্তব পরিস্থিতির ভয়াল কিছু চিত্র! ফসল বাড়াতে কৃষিতে যে সব সার-কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তা পচে গলে যে কী জাতের বিষ তৈরি করে, তা এবার দেখিয়েছে সুনামগঞ্জের হাওর। অসময়ের ঢলে আধাপাকা ধান তলিয়ে যাওয়ায় সে সব এবং এর সঙ্গে সার-কীটনাশক পচে পানিতে এমোনিয়া গ্যাস বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেনের অভাবে মরেছে মূল্যবান মৎস্যসম্পদ। আর এসব বিষাক্ত মাছ-পানি খেয়ে মরেছে হাওরের হাঁস। হাওর পাড়ের মানুষেরা একসঙ্গে এত দুর্যোগ আগে কখনও দেখেনি। দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশে ফি-বছর হাওরের বাঁধের নামে মাটি ফেলা, কংক্রিকেটের স্লাব ফেলা আর দুর্নীতি ধরা পড়লে কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলির নামে দুর্নীতি আড়ালে এসব ‘শয়তানি’ বন্ধ করা দরকার। চলতি সংকট-নজরদারির মধ্যে আবার নতুন করে হাওরের বাঁধ ভেঙে পড়লো কেন?

ভাটির দেশ বাংলাদেশে শুষ্ক মওসুমে ভারত পানি আটকালে প্রতিবাদের পাশাপাশি এক দফা ভারতবিরোধী রাজনীতিও হয়। এই রাজনীতি স্থগিত থাকে বর্ষায়! কিন্তু এবার এই রাজনীতির টার্গেটে ইউরেনিয়ামও এসেছে! এক পত্রিকা প্রতিবেদন করলো ভারতের ইউরেনিয়াম খনির ইউরেনিয়াম ধুয়েমুছে আসা পানিতে মরেছে হাওরের মাছ! এই প্রোপাগান্ডার সত্যতা যাচাইয়ে আনবিক শক্তি কমিশন যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে গেলো হাওরে। কিন্তু ইউরেনিয়াম পেলো না! আমি থাকি অস্ট্রেলিয়ায়। ইউরেনিয়াম নিয়ে অস্ট্রেলিয়া-ভারতের সম্পর্কের টানাপড়েন টাগ অব ওয়ার জানি। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারত ইউরেনিয়াম চায়। কিন্তু চীনের ভয়ে ভারতকে ইউরেনিয়াম দিতে রাজি হয় না অস্ট্রেলিয়া। কারণ অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি নানাকিছুতে চীনের ওপর নির্ভরশীল। আর অরুণাচল প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, দালাইলামা নানা ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ককে উষ্ণ বলা যায় না। সেই ভারতের নিজের এত ইউরেনিয়াম সম্পদ যা কিনা ধুয়েমুছে বাংলাদেশের হাওরের মাছ মারতেও আসে! অঙ্কটা মেলাতে পারছিলাম না।

হাওরের সংকট মোকাবিলায় সরকারকে স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবা উচিত। হাওর ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখা গেলে এর ফসল আর মৎস্যসম্পদে কী অর্জন সম্ভব, তা এবারের ধ্বংসযজ্ঞে তা সবাই দেখেছে, বুঝেছে। হাওর ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখা গেলে বাংলাদেশ যে কতকিছু পেতে পারে, সে তথ্যও উঠে এসেছে এবারের ধ্বংসযজ্ঞে। প্রতি বর্ষার আগে এমন মাটির বাঁধ, কংক্রিটের স্লাব পানিতে ফেলার দুর্নীতির একটা হিসাব বের করা হোক। এভাবে বছরের বছর ধরে চলে আসা দুর্নীতির টাকায় সারা বাংলাদেশটাই পাকা দেয়ালে মুড়িয়ে ফেলা যেত। স্থায়ী সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে হাওর গবেষকদের নিয়ে বসুন। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশের সাহায্য নিন। অল্প-অল্প করে হলেও স্থায়ী পাকা বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজরা বাধা দেবে। নানা তত্ত্ব শোনাবে। তাদের কথা শুনবেন না। তাদের কথা শুনতে শুনতেই তো হাওর পাড়ের মানুষজন প্রতিবছর কাঁদে। হাওরের কান্না থামাতে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদোগ নিন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটি হোক পদ্মা সেতুর মতো আপনার আরেক কীর্তি।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ