X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও একটি পরিকল্পিত হত্যা

আনিস আলমগীর
২৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:০০আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০১৭, ১৪:০৩

আনিস আলমগীর ইউরোপে পুনরায় চরমপন্থী শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও জার্মানিতে ২০১৭ সালে নির্বাচন হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের নির্বাচন গত মাসে হয়ে গেছে। চরমপন্থীরা খুব হাঁকডাক দিয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণ করেছিলো। তারা বলেছিলো নির্বাচিত হলে তারা নেদারল্যান্ডস থেকে মুসলমানদের বের করে দেবে। তিনশ’ মসজিদ ভেঙে দেবে আর কোরআনকে অবৈধ গ্রন্থ বলে ঘোষণা করবে, যেহেতু এ গ্রন্থটা উত্তেজনা ছড়ায় সেহেতু এ গ্রন্থটাকে নেদারল্যান্ডস সরকার বাজেয়াপ্ত করবে। জনমত জরিপে অনেক সময় তাদের জিতে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছিলো। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের শান্তিকামী মানুষ নির্বাচনে তাদেরকে ভোট দেয়নি। উগ্রবাদীরা পরাজিত হয়েছে।
এখনও ইউরোপের দু’টি শক্তিশালী রাষ্ট্র ফ্রান্স ও জার্মানিতে সাধারণ নির্বাচন হয়নি। ফ্রান্সে ২৩ এপ্রিল প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল। নিয়ম হচ্ছে যদি কোনও প্রার্থী পঞ্চাশ শতাংশের ওপরে ভোট না পায় তবে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হবে। প্রথম দফায় কোনও প্রার্থী তা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ৭ মে। আর তাতে মুখোমুখি হচ্ছেন মধ্যপন্থী প্রার্থী ইমানুয়েল ম্যাক্রন এবং কট্টর-ডানপন্থী প্রার্থী জ্যঁ মারিন লে পেন। প্রথম দফায় সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় পর্বের (রানঅব) লড়াইয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। ৭ মে ফরাসিরা জানাবে লে পেন, না ম্যাক্রন কাকে তারা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রোববারের ভোটে লে পেনকে পেছনে ফেলে দেওয়া ম্যাক্রন এখন দ্বিতীয় দফা ভোটে ফরাসিদের পছন্দনীয় প্রার্থী। উল্লেখ্য, তাকে রাজনীতির বাইরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিষ্ঠিত কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়াই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের অর্থমন্ত্রী ছিলেন মাক্রোঁ, কিন্তু নিজ দল গঠন করার জন্য মন্ত্রিত্ব ছাড়েন।

অপর দিকে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে আসা লে পেন ২০১১ সালে তার বাবার কাছ থেকে কট্টর-ডানপন্থী দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এফএন) নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্ব গ্রহণের পর ফ্রান্সের আঞ্চলিক নির্বাচনগুলোতে এফএন বড় ধরনের সাফল্য পায়। তার নেতৃত্বেই দলটি গত ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।

লে পেনের দল অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার ও বৈধ অভিবাসীদের রশি টেনে ধরতে চায়, অবাধ বাণিজ্যের ওপর যবনিকা টানতে চায় এবং ইউরোপের সঙ্গে ফ্রান্সের বর্তমান সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন চায়। উল্লেখ্য, প্রথম পর্বের ভোটে ম্যাক্রোন পেয়েছেন ২৩ দশমিক আট শতাংশ ভোট। অপর দিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লে পেন পেয়েছেন ২১ দশমিক পাঁচ শতাংশ ভোট।

নির্বাচনের আগে জরিপে দেখা গিয়েছিল কট্টর ডানপন্থী প্রার্থী মারিন লে পেনের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তার এজেন্ডা নেদারল্যান্ডসের কট্টরপন্থীদের চেয়ে উত্তম কিছু নয়।

মুসলমানের প্রতি তিনিও খুবই খড়ক হস্ত। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করে ইউরোপের যে একটা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রীয় কাঠামো ফ্রান্স আর জার্মানি দাঁড় করিয়েছিলো তার প্রতিও লে পেনের আস্থা নেই। তিনি নির্বাচিত হলে ফ্রান্সকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনবেন ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। একক মুদ্রা ইউরো নিয়ে তার বিরক্তির সীমা নেই। তার কথা হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের নিজস্ব মুদ্রা না থাকলে সে রাষ্ট্র আবার সার্বভৌম রাষ্ট্র হয় কিভাবে? তিনি ফ্রান্সকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে বিলিন করে দিতে প্রস্তুত নন।

ব্রিটেন ইতিমধ্যে গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফ্রান্সও যদি তেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে যাবে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল সবাই ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এখন সাম্রাজ্য হারিয়ে সবাই রিক্তহস্ত হয়ে গেছে। আবার আমেরিকা ও রাশিয়ার উত্থান হয়েছে। এখন সম্মিলিত প্রয়াস ভিন্ন আমেরিকা রাশিয়াকে মোকাবিলা করা ইউরোপীয় পুরনো শক্তিগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। সে কারণে একটি সতর্ক পদক্ষেপ হিসেবে তারা ইউনিয়ন গঠন করে অভিন্ন মুদ্রা, কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ইত্যাদি গঠন করেছিলো। কিন্তু উগ্রপন্থীদের আবির্ভাবের কারণে ইউনিয়নের মাধ্যমে অভিন্ন ইউরোপের কল্পনা এখন ভেঙে যাওয়ার কিনারায় এসে উপস্থিত হয়েছে।

নির্বাচনি বিশেষজ্ঞরা এটা মনে করছেন দ্বিতীয় দফা নির্বাচন ইমানুয়েল ম্যাক্রোন জয়ী হওয়া সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তবে প্রথম দফার আগে সেটা পরিষ্কার ছিল না। বরং লে পেন-এর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল নির্বাচনের আগে আগে গত বৃহস্পতিবার ১৯ এপ্রিল সেন্ট্রাল প্যারিসে এক মুসলমান যুবক গুলি করে কর্তব্যরত এক পুলিশকে হত্যা করায়। সন্ত্রাসী যুবকটি দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের নজরদারীতে ছিল। সন্ত্রাসী করিম লে পেনের বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। লে পেন বলে বেড়াচ্ছেন মুসলমানদের থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করতে হবে, সব মসজিদ বন্ধ করে দিতে হবে। সন্ত্রাসী যুবক করিমের কর্মকাণ্ডে নির্বাচনে ৩ দিন আগে লে পেন এর অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল ফ্রান্সের ভোটারদের কাছে। ফ্রান্সে বহু মুসলমানের বসবাস করে। উত্তর আফ্রিকার ফ্রান্সের কলোনি থেকে তারা ফ্রান্সে এসে বসবাস আরম্ভ করেছিলো। মার্সেই শহরে মুসলমান আর খ্রিস্টান জনসংখ্যা প্রায় সমান।

ইউরোপে কট্টরপন্থীরা অনেক সময় ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে জনমত নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করার ইতিহাস আছে। হিটলারের নাজি পার্টি নির্বাচনের আগে নাকি এক ইহুদি যুবক ভাড়া করে জার্মান পার্লামেন্টে আগুন লাগিয়েছিলো। প্যারিসের এই মুসলিম যুবকের ঘটনা তেমন ষড়যন্ত্র হওয়া বিচিত্র নয়। না হয় পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে করিম পুলিশ হত্যা করে কী করে! আবার আরেক পুলিশ করিমকে গুলি করে হত্যা করেছে। নেদারল্যান্ডসে পরাজয়ের পর ইউরোপে ডান ও উগ্রপন্থীরা লে পেন এর বিজয়ের জন্য মুখীয়ে আছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রকাশ্যে লে পেন এর বিজয় কামনা করেছেন। সুতরাং ঘরে বাইরে সব সমর্থকদের ঐক্যে একটি ষড়যন্ত্র যে হতে পারে না তাতো নয়। এখন তো বিশ্ব ব্যবস্থাটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। লাদেন, আল কায়দা, বাগদাদী, আইএস সবই সৃষ্টি করেছে আমেরিকা, আবার ওয়্যার এগেনিস্ট টেরর ঘোষণাও করেছে আমেরিকা। এসবই এক একটা এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে বিশ্ব মুসলমানের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ থেকে খারাপতরও হচ্ছে। মুসলমানেরা তম্বিৎ ফিরে না পেলে অবস্থা খুবই শোচনীয়ই হবে। মুসলমানদের টিকে থাকার ইচ্ছে না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। রোমান সম্রাজ্যের পতন হয়েছিলো টিকে থাকার ইচ্ছে ছিল না বলে।

ফ্রান্সের পরেই নির্বাচন হবে জার্মানিতে। জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল বিশ্বের এক অদম্য সাহসী নারী। তিনি দুই দু’বার জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। এখন তৃতীয়বারের মতো তিনি আগামী নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শরণার্থী শিশু আয়নাল কুর্দীর সাগর তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নিথর দেহখানি দেখে তিনি এতই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, সিরিয়ার শরণার্থীর জন্য জার্মানির সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন এবং ১০ লাখ সিরিয়ার শরণার্থীকে তার দেশ জার্মানিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

রক্ষণশীলরা তার এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছিল। এখন আগামী নির্বাচনে জার্মানিতেও ফ্রান্সের মতো ষড়যন্ত্র হতে পারে। মেরকেলের আমেরিকা সফরের সময় আমরা দেখেছি মেরকেল হ্যান্ডসেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পরও ট্রাম্প তার হাত বাড়িয়ে দেননি। এটা প্রকাশ্যে অপমান করা। মেরকেলকে পরাজিত করার ব্যাপারে ট্রাম্পও সক্রিয় থাকতে পারেন। জার্মানি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় ট্রাম্প অ্যাঞ্জেলা মেরকেলের প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘কলা চুরি’ নিয়ে বিতর্কের জেরে স্কুলছাত্রকে হত্যা: ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড
‘কলা চুরি’ নিয়ে বিতর্কের জেরে স্কুলছাত্রকে হত্যা: ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড
আন্তর্জাতিক মুক্তির আগেই বাংলাদেশে!
আন্তর্জাতিক মুক্তির আগেই বাংলাদেশে!
নির্বাচনে অনিয়ম হলে কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে: ইসি হাবিব
নির্বাচনে অনিয়ম হলে কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে: ইসি হাবিব
১৭ অঞ্চলের তাপমাত্রা আজও ৪০ ডিগ্রির ওপরে, বেশি আর্দ্রতায় অস্বস্তি চরমে
১৭ অঞ্চলের তাপমাত্রা আজও ৪০ ডিগ্রির ওপরে, বেশি আর্দ্রতায় অস্বস্তি চরমে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ