X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট একটি খেলা মাত্র!

মো.সামসুল ইসলাম
০৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৪৪আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ২২:৩০

মো. সামসুল ইসলাম সম্প্রতি আমার মনে হচ্ছে, আমাদের ক্রিকেটভক্তরা দেশ-বিদেশের ক্রিকেট বা ক্রিকেটারদের নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝে যা ভব্যতার সব সীমারেখা অতিক্রম করছে। তারা ভুলে যাচ্ছেন, ক্রিকেট নীতিকথা সংবলিত কোনও ধর্ম নয়; এটি বিনোদনের মাধ্যম–একটি খেলা মাত্র। 
ক্রিকেটার তাসকিনের সম্প্রতি বাবা হওয়ার ঘটনাটি দিয়েই শুরু করি। নবজাতকের ছবি ফেসবুকে দিয়ে বিশাল বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাসকিনকে। অভব্য সমর্থকদের ‘এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা হয়ে গেলো’ ধরনের মন্তব্যের চাপে তাসকিনকে শেষ পর্যন্ত তার বিয়ের দিন তারিখ হিসাব করে ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, তাড়াতাড়ি নয়, তিনি ঠিক সময়েই বাবা হয়েছেন।  
আবার দিন কয়েক আগে ভারতের সঙ্গে এশিয়া কাপের ফাইনালে লিটন দাসের আউট নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি, যার রেশ এখনও চলছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশি সমর্থকদের একটি গ্রুপ সর্বশেষে বিরাট কোহলির অফিসিয়াল সাইট হ্যাক করেছে। হ্যাক করে অনেক কিছুর সঙ্গে লিটন দাসের আউটের পাঁচটি ছবি তারা টাঙিয়ে দিয়েছে।     

লিটন দাস আসলে আউট ছিলেন কিনা, তা নিয়ে আমি বিতর্কে যাচ্ছি না। এটা নিয়ে আমাদের দেশেই দেখছি সমর্থক আর বিশেষজ্ঞদের দুটো মত আছে। কেউ লিটনের পায়ের অবস্থান দেখে বলছেন তিনি আউট ছিলেন, আবার কেউ বলছেন লাইনের ওপরে থাকায় তিনি ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পেতে পারতেন। কিন্তু যাই হোক, খেলা খেলাই, সমর্থকরা হতাশা প্রকাশ করতেই পারেন। তারা প্রতিবাদও করতে পারেন। যেমন বিসিবির ওপর চাপ সৃষ্টি করে আইসিসিতে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারতেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু এসব বৈধপথে প্রতিবাদ না করে তারা বিরাট কোহলির ওয়েবসাইট হ্যাক করেছেন, যা যেকোনও বিচারেই একটি অপরাধ। বিরাট কোহলি কোনোভাবেই লিটন দাসের আউটের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নন, এমনকি তিনি এশিয়া কাপেও খেলেননি। তার ওয়েবসাইট হ্যাক করে আমাদের হ্যাকাররা কী পেতে চাইছেন, তা তারাই ভালো জানেন। কিন্ত তারা বোধহয় ইন্ডিয়ান হ্যাকারদের সংখ্যা ও তাদের পাল্টা আক্রমণের শক্তি সম্পর্কে  জানেন না!

আবার যে লিটন দাসের পক্ষে তারা সোচ্চার, সেই লিটন দাসই তার ফেসবুকে নাকি পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে সমর্থকদের তীব্র সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। যার নিন্দা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গত ৩ অক্টোবর গ্ণভবনের সংবাদ সম্মেলনে করেছেন।  

এসব কিছু বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে দেশেবিদেশে খুব ভালো বার্তা দিচ্ছে না। সমর্থকদের এসব আচরণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ক্রিকেটের যেকোনও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের জগতে একটি উঠতি শক্তি, আমাদের ক্রিকেট যে এখনও খুব দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা বলা যাবে না। আমি স্বীকার করছি যে ক্রিকেট আমাদের দেশকে অনেক দিয়েছে। যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এখন পড়তির দিকে, কিন্তু আমাদের এ উপমহাদেশে বিশেষত ভারতে খেলা হিসেবে ক্রিকেটের এখনও তুমুল জয়জয়কার। ক্রিকেট যেমন বিদেশে আমাদের দেশের পতাকা তুলে ধরছে, তেমনি সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে যুব সমাজকে মাদক বা পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রেও এর অবদান অনস্বীকার্য। সুতরাং সমর্থকদের সংযত আচরণ বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই পর্যায়ে অপরিহার্য একটি ব্যাপার।

তবে শুধু সমর্থকদেরই বা দোষ দেই কীভাবে? আমি বলবো, এ পরিস্থিতির জন্য সমর্থকদের পাশাপাশি খেলোয়াড়, বিসিবি, মিডিয়া সবাই দায়ী।

যেমন বাংলাদেশের খেলোয়াড় মুশফিকের নাগিন নাচের কথা বলা যেতে পারে। এবছরই লঙ্কানদের হারানোর পরে মুশফিকের নাগিন নাচ শ্রীলঙ্কানরা মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটীয় সম্পর্ক এখন তলানিতে। আবার ঐতিহাসিক কারণেই পাকিস্তানিদের সঙ্গে যেকোনও খেলাতে আমরা মোটামুটি যুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করি। এর ওপর ভারতের সঙ্গে আমাদের ক্রিকেট দিনে দিনে যেন যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠছে। অথচ আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে ভারতের অবদান আছে, তাদের দেশের আইপিএলে আমাদের খেলোয়াড়রা খেলেছে, যে সুযোগ পাকিস্তানির খেলোয়াড়রা চান কিন্তু পান না।

এটা তো সবাইকে বুঝতে হবে যে ক্রিকেট এখন আর মোটেই ভদ্রলোকের খেলা নয়। এখানে অবশ্যই রাজনীতি আছে। অর্থনৈতিক স্বার্থের ব্যাপার আছে। আছে বেটিং, ম্যাচ ফিক্সিং, বল টেম্পারিং ইত্যাদির কালো থাবা। প্রতিনিয়তই খেলোয়াড়রা ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং-এর অফার পাচ্ছেন, অনেকেই অভিযুক্ত হয়ে নিষিদ্ধ হয়েছেন। নিষিদ্ধের তালিকায় প্রথম থেকেই রয়েছেন অনেক বাঘা বাঘা খেলোয়াড় যেমন, ভারতের মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, পাকিস্তানের সেলিম মালিক, দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যান্সি ক্রনিয়ে, বাংলাদেশের মোহাম্মাদ আশরাফুল ইত্যাদি।

প্রকৃতপক্ষে বেটিং বা স্পট ফিক্সিংয়ের থাবা এখন অনেক বিস্তৃত, যার খুব কমই মিডিয়াতে আসে। সম্প্রতি অনেক পুরনো খেলা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এছাড়া ক্রিকেটেও রয়েছে বর্ণবাদ। এ মাসেই জানা গেলো ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় মঈন আলী নাকি ২০১৫ সালে কার্ডিফে অনুষ্ঠিত আ্যশেজ সিরিজ চলাকালীন সময়ে বর্ণবাদী মন্তব্যের শিকার হয়েছিলেন। জনৈক অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড় নাকি তাকে নাকি ‘ওসামা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং তার নাকি এ বিষয়ের তদন্ত করবে।     

একজন দর্শক যখন খেলা দেখবেন তখন তাকে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। তাকে বুঝতে হবে ক্রিকেটের অন্ধকার জগতের অলিগলি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় সমর্থকদের না বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের মিডিয়ার দায়ও কম নয়। কেউ একদিন ভালো খেললে মিডিয়া তাকে নিয়ে নাচানাচি করছে আবার পরের দিন খারাপ খেললে তার মুণ্ডুপাত করছে। কাউকে বীর, কাউকে দেশপ্রেমিক ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সমর্থকদের উসকে দিচ্ছে। ইনজুরি নিয়ে কেউ খেললে দেশের স্বার্থে তা মহান আত্মত্যাগ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এতে আবেগের জোয়ারে ভাসছেন সমর্থকরা। খেলা নিয়ে বিশাল প্রত্যাশার সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যে। প্রত্যাশার ব্যত্যয় ঘটলেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন তারা।

ক্রিকেটাররা অবশ্যই দেশের স্বার্থে খেলেন। তবে তাদের স্বার্থও এখানে কম নয়। তাদের অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক। শুধু তারা নয় অনেকেই দেশের স্বার্থেই কাজ করেন। যেমন সাংবাদিকরাও করেন। সাংবাদিকদের  পেশায় জীবনের ঝুঁকি ক্রিকেটারদের চেয়ে শতগুণ বেশি। সুতরাং ক্রিকেটারদের আলাদা করে তাদের ওপর মহত্ত্ব আরোপ করাটা মোটেই ঠিক নয়। বছর তিনেক আগে এসবে বিরক্ত মাশরাফি কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তারা নায়ক নন, দিনশেষে তারা কিন্তু এন্টারটেইনার। তিনি বলেছিলেন, জাতির জন্য আমরা এমন কিছু আত্মত্যাগ করি না, যেটা করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

দুঃখের বিষয় মিডিয়া বা সমর্থকরা এটা এখনও বুঝতে পারছে না।

এদিকে বিসিবিও মনে হচ্ছে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বিষয়ে বেশিমাত্রায় জড়িয়ে পড়ছে। একদিকে তারা যেমন কারণে অকারণে ক্রিকেটারদের কোটি কোটি টাকা উপহার দিচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন তুচ্ছ কারণ, যেমন কে ফেসবুকে কী লিখল, কার ফোনে কয়টি মেয়ের নম্বর আছে, কার রুমে কে ঢুকেছে ইত্যাদি ব্যপারে ক্রিকেটারদের ওপর খড়গহস্ত হচ্ছেন। বোর্ডকে বুঝতে হবে ক্রিকেটাররা রক্তমাংসের মানুষ। অন্যান্য দেশেও ক্রিকেটারদের নিয়েও বিভিন্ন স্ক্যান্ডাল আছে। নৈতিকতা নিয়ে তাদের সঙ্গে জোরাজুরি করে দেশের ক্রিকেটের খুব একটা লাভ হবে না। উলটো সমর্থকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে।

এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় মনে হয় দেখলাম বর্তমানে জাতীয় দলের কোনও কোনও খেলোয়াড় নাকি আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। সত্যি হলে সেটা হবে আরেকটি ভুল। সংসদে আইনপ্রণেতা হওয়ার ম্যাচিউরিটি কি তাদের এই মুহূর্তে আছে? জানি অনেকে হয়তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উদাহরণ টানতে চাইবেন। তবে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে ইমরান খানকে কিন্তু কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি। মায়ের নামে বিশাল ক্যানসার হাসপাতাল, কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে তাকে প্রথমে পাকিস্তানে জনসেবক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়েছে। এরপর তিনি রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া শুরু করেছেন।

আমাদের ক্রিকেটাররা বা খেলোয়াড়রা অবশ্যই নির্বাচন করতে পারেন। তবে অবশ্যই রাজনীতিতে পরিপক্ক হওয়ার পর, দেশের ও রাজনৈতিক দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার পর। হুট করে তারা যদি নির্বাচনে অংশ নেন তাহলে জাতি তাদের দ্বারা কীভাবে উপকৃত হতে পারে, তা দেখার জন্য আমাদের হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।   

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ