X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

শিশু ধর্ষণ: চেনা অচেনা মানুষেরা

তাজুল ইসলাম
১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৪৮আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৫৯

তাজুল ইসলাম ১১ বছরের নীলা (ছদ্মনাম) প্রায়ই মামার নানা আদরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। মামা অবাধে বাসায় যাতায়াত করে। আর ভাগ্নিকে আদরের সামাজিক বৈধতা যেন অলিখিতভাবেই রয়েছে। প্রতিনিয়ত ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া’ টের পায় শিশুটি। নীলা প্রথমে মাকেও জানায়নি। মায়ের আদরের ভাই, মা কী না কী বলে, মা যদি উল্টো নীলাকেই খারাপ ভাবে। কৈশোরের এসব কষ্ট চেপে বড় হতে থাকে সে। একসময় মাকে বলতে বাধ্য হলে মা আর কাউকে না জানাতে বলেন। তবে সেই মামা আর বাড়িতে আসেনি।
কেবল নীলা না, আমাদের ঘরে ঘরে এই সমস্যা রয়েছে। শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয় একেবারে কাছের মানুষদের দ্বারা। আমরা যারা অভিভাবক তারা যেমন শিশুদের শেখাই না কোনটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া আর কোনটা আসলেই আদর। পার্থক্যগুলো কেমন হবে তা নিয়ে যেমন আলাপ করি না, তেমনই এ ধরনের কিছু যদি ঘটে তাহলে নির্ভয়ে যেন মেয়ে বা ছেলে শেয়ার করতে পারে সেই পরিবেশও রাখি না। বাসায় বসে নিপীড়নের শিকার হতে থাকা শিশুটি কেন বাবা মাকে নির্ভয়ে বলতে পারবে না তার খারাপ লাগাগুলো। ফলে আমাদের প্যারেন্টিং এই অপরাধকে এক ধরনের প্রশ্রয় দেয়।

আপনাদের ধর্ষক সাইফুলকে মনে আছে? সেই যে দিনাজপুরের পাঁচ বছরের শিশুটিকে মাসের পর মাস ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলো শরীরের কাটাছেঁড়ার। শরীরের কাটাছেঁড়া জোড়াতালি দেওয়া গেছে, কিন্তু তার মনের ওপর দিয়ে যা গেছে, তার নিরাময় কে করবে? মেয়েটি তার সেই ধর্ষক প্রতিবেশীকে বড় আব্বু ডাকতো। আর কোনও পুরুষকে সে কোনও দিন কাছের মানুষ ভাবতে পারবে কি?

যাকে বড় আব্বু ডেকেছে সেই লোক তাকে ধর্ষণ করেছে। কেন তার সঙ্গে এই আচরণ করেছে সে জানে না কিন্তু বুক দিয়ে বাবা-মা’র আগলে রাখাটা সে যেমন বুঝতো তেমনই ব্যথা দেওয়াটাও ওই পর্যন্তই বুঝেছে। কিন্তু অর্থ খুঁজে পাবে না আজীবন।

পত্রিকা মারফতে জানতে পারা যায়, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে দেশে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৪৪৬ শিশু। অর্থাৎ সেই বছরে শিশু ধর্ষণ হার বেড়েছে শতকরা ৩৩ ভাগ। ২০১৮ সালের ধর্ষণের হিসাব মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনও প্রকাশ না করলেও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর কেবল ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম ৮ দিনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বছরের শুরুতেই ঢাকা সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

কেন ধর্ষণ হয়। মনে রাখা জরুরি, মানুষের ক্ষমতা বিভিন্ন রকম হতে পারে। দৈহিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা। কোনও ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে যে তার অনেক ক্ষমতা রয়েছে তখনই সে এ কাজটি করে। আমরা দেখতে পাই যে, সমাজে যারা ধর্ষণের শিকার হয়, লাঞ্ছনার শিকার হয়, তাদের ক্ষমতা নেই। তেমন বিবেচনাতেই শিশু ক্ষমতাহীন, সে প্রতিবাদ বিষয়টি জানে না, সে থামাতে শেখেনি, সর্বোপরি কোমল শিশু জানে না মানুষ এবং চেনা মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে দিন দিন নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই। এর পেছনে আসলে অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হলো, মানুষের লোভ-লালসা দিন দিন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। সভ্য মানুষগুলো তাদের কামনা-বাসনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন। লোভ-লালসাকে যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, আমরা সমাজ থেকে সে শিক্ষা পাচ্ছি না। সামাজিকভাবে বা আইনগতভাবে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই।

যারা এমন অপরাধে জড়াচ্ছে তারা বেড়ে ওঠার সময় সঠিক শিক্ষা পায়নি। এমনকি যৌন হয়রানি করাকে তারা অপরাধ বলে মনেই করে না। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের কাছ থেকে পাল্টা আঘাতের সুযোগ থাকে বলেই তারা শারীরিক প্রবৃত্তি মেটাতে শিশুদের বেছে নেয়। শিশুদের ওপর জোর খাটানো সহজ যেমন, তেমনই শিশুটি তার ওপর ঘটে যাওয়া অমানবিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ও ইন্টারনেট হাতে হাতে থাকার কারণে এবং মাদকাসক্তির আঘাতে অসুস্থ যৌনাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একে কেবল লিনিয়ার ওয়েতে বিবেচনা করতে হবে না। যত সম্ভাব্য কারণ আছে সবক’টি ধরে এগুতে হবে।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ধর্ষক ক্ষমতাশালী এবং ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ‘ভবিষ্যৎ’ ঠিক রাখতে চাইলে, সমাজের ভেতর তার গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে হলে তার ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধ লুকিয়ে রাখতে হবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ষণের মামলাগুলো জিইয়ে রাখে। ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু এবং তাদের স্বজনেরা মনে করেন, ধর্ষণের দায় ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর ওপর বর্তাবে। কেন এই হেনস্তার ভেতর দিয়ে যাবে। কিন্তু চুপ থাকার সময় শেষ। শিশুটিকে নিজের যাতনার কথা বলতে দিন, এটিই তার ভবিষ্যতের জন্য ভালো।

এই যে একের পর এক শিশু ধর্ষণের বিষয় বেরিয়ে আসছে, এসব নিপীড়নের ঘটনা কি নতুন? দিনের পর দিন এই নির্যাতন ঘটে চলেছে। তবে পরিবার কর্তৃক লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এখনও বেশি। একদিকে ধর্ষণের ঘটনা নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়। ঠিক একইসঙ্গে ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগ শিশুর কাছ থেকে জানা গেছে নিপীড়করা পরিবারের ভেতরের লোক। অনেকে বিস্মিত হতে পারেন বা অনেকে অবিশ্বাস করতে পারেন কিন্তু বাস্তবতা হলো শিশু ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই কাছের মানুষদের দ্বারা হয়ে থাকে।

দেখা গেছে ৭৫ শতাংশ ঘটনা পরিবারের চেনা নিজেদের লোকদের দ্বারা ঘটে, যার ৭০ শতাংশই পিতৃমাতৃতুল্য কাছের মানুষদের বিকৃতির ফল। বাকি ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে তরুণদের দায় দেখা যায়। এরকম একটি যৌন বিকৃতির রোগের নাম পিডোফেলিয়া, যেখানে ব্যক্তি কেবল শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে। মনে রাখতে হবে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নে সবসময় যে দৈহিক মিলন ঘটতে হবে তা নয়, জোর করে অনাকাঙ্ক্ষিত আদর বা হুটহাট পর্নো পত্রিকার সঙ্গে ছবি তুলতে বাধ্য করার জাতীয় নিপীড়নও এর অন্তর্গত হবে।

কতজন মেয়ে এ ধরনের আচরণের নিপীড়নের শিকার হয় তার তথ্য পাওয়া মুশকিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা চেপে যেতে চায়। কেননা নিজের আত্মীয়দের মধ্যে ফাটলের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে এই ভয়ে।

ধর্ষণের শ্রেণিবিভাগ করি আমরা মনোরোগ বিশ্লেষকরা।

১) পরিস্থিতি অনুযায়ী ধর্ষণ; শিশু ধর্ষণ; দলবদ্ধ ধর্ষণ; পরিচিতজন দ্বারা ধর্ষণ; দাম্পত্য ধর্ষণ; পরিবারের লোক দ্বারা ধর্ষণ।

২) লক্ষ্য অনুযায়ী ধর্ষণের শ্রেণিবিভাগে পাওয়া যায় ক্রুদ্ধ ধর্ষক (অ্যাংগার রেপিস্ট); ক্ষমতা দেখানো ধর্ষক (পাওয়ার রেপিস্ট); পীড়নকারী ধর্ষক ( সেডিস্ট রেপিস্ট)।

এই এত ধরনের ধর্ষণ এবং ধর্ষকের ভেতরে আমাদের করণীয় নির্ধারণ জরুরি। সামাজিক কাঠামো পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়ার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। আইনি বিচার ব্যবস্থা নিয়ে ভাববে তো বটেই, সেই সঙ্গে সামাজিক বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তুলতে হবে। মানুষ যেন ধর্ষণের মতো জঘন্যতম কাজ করতে সাহস না পায়।

ধর্ষণের শিকার শিশুরা অনাস্থা, অবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়। আর অন্য সব জটিল মানসিক রোগের মতো তাদের প্রকাশ ঘটে শারীরিক কোনও সমস্যা দিয়ে। কখনও কখনও তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ওই যে ছেলেবেলার যাতনা তা বলতে না পেরে সে এমন লেভেলে বাস করে, বড় হয় যেখানে সে নিজেকে চেনে না, ঠিক চেনা মানুষ যেমন তার কাছে অচেনা হয়ে গিয়েছিল, তেমনই। আমরা শিশুকে এই পরিস্থিতিতে যেতে দেবো, তার ভবিষ্যৎটা নষ্ট হতে দেবো, নাকি তাকে শক্তহাতে বলতে শেখাবো, ‘না’, আমার ওপর নির্যাতন করা যাবে না। আর যে শিশুটি কিছুই বলতে শেখেনি, তাকে কাছের কোনও মানুষের কাছে ‘আদর’ করতে তুলে দেবো না, অভিভাবক হিসেবে এটুকু দায়িত্ব আপাতত পালন করলে অনেকটা নিরাময় লাভ সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক,  জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ বললেন এনসিপি নেত্রী সামান্থা
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ বললেন এনসিপি নেত্রী সামান্থা
মাস্কের নতুন রাজনৈতিক দলকে ‘হাস্যকর’ বললেন ট্রাম্প
মাস্কের নতুন রাজনৈতিক দলকে ‘হাস্যকর’ বললেন ট্রাম্প
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে ড্রাই ডক
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে ড্রাই ডক
ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনে পাঠদান চলছে ৭০০ শিক্ষার্থীর
ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনে পাঠদান চলছে ৭০০ শিক্ষার্থীর
সর্বশেষসর্বাধিক