X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

পরিপ্রেক্ষিত চলমান শ্রম অভিবাসন

এবিএম ফরহাদ আল করিম
০১ মে ২০১৯, ১৮:১৪আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:৪৬

ফরহাদ আল করিম জীবন জীবিকার তাগিদে আমাদের দেশ থেকে শ্রমজীবীদের একাংশের বিদেশে চাকরি খোঁজা বর্তমানে একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইস্যুতে সবার নিরাপত্তা ও শতভাগ মান বজায় রাখতে না পারলেও গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অভিবাসন প্রত্যাশী কর্মীর বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ বেশি পরিমাণে বেড়ে গেছে এবং যাচ্ছেও। সরকারি তথ্যমতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখের বেশি কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। বর্তমান সময়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিদেশে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন, তবে নারীদের নির্যাতন ও শোষণ বঞ্ছনার কথা বেশি শোনা যায়, যা আমাদের শঙ্কিত ও ব্যথিত করছে।
গত দশ বছরের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, প্রতি বছর গড়ে ৫ থেকে ৭ লাখ শ্রমজীবী মানুষ নানাবিধ পেশায় চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় ২০১৭ সালে বিদেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যাটি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। ১০ লাখের বেশি কর্মী যাওয়ার মাধ্যমে এই সালটি এখন পর্যন্ত বিদেশে কর্মী পাঠানোর দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে পরবর্তীকে এই ধারায় বেশ খানিকটা ভাটা পড়ে। 

গত বছরে কর্মীর যাওয়ার সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে কমেছিল, মাত্র ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন শ্রম অভিবাসী কর্মী বিদেশে যান। কিন্তু নির্যাতন ও শোষণ-বঞ্ছনার শিকার হয়ে কিছু সংখ্যক কর্মী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন, যা বিশ্লেষকদের মতে আগের বছরগুলোর চেয়েও বেশি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীও রয়েছেন এই ব্যর্থ বিদেশ ফেরতদের দলে, যা এখনও চলমান রয়েছে। দূতাবাসের সেফহোম বা বিমানবন্দরগুলোতে গেলে চোখে পড়ে স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমা বিদেশ ফেরত নারীদের আর্তি। শারীরিক নির্যাতন, খেতে না দেওয়া, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করানো, বেতন কম দেওয়া বা না দেওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে যৌন নির্যাতন এবং অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভধারণের মতো ভয়াবহ অপরাধ। নির্যাতনের শিকার এসব কর্মীর মাঝে যেমন মানসিক বিকলাঙ্গতা ছাড়াও অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকে, যা বন্ধ হওয়া জরুরি।

শুধু নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা না; আগের বছরগুলোর তুলনায় ২০১৮ সালে প্রবাসী কর্মীর মৃতদেহের সংখ্যাও দেশে বেশি আসে। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিলের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে যেখানে ৩ হাজার ৩৮৭ জন প্রবাসী কর্মীর লাশ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়; সেখানে ২০১৮ সালে আগের বছরের চেয়ে কম কর্মী বিদেশে যাওয়ার পরও ৩ হাজার ৭৯৩ জন কর্মীর লাশ আমাদের ফিরিয়ে আনতে হয়। সুতরাং বিদেশগামীর সংখ্যা না বেড়ে লাশ হয়ে ফিরে আসা এবং শোষণ বা নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে আমাদের কর্মীদের দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে, যা মানতে কষ্ট হয়। কেন মৃতদেহের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তা অনুসন্ধান করে সমস্যা সমাধান করলে স্বপ্ন নিয়ে পথচলা এসব প্রবাসী কর্মীর এই করুণ পরিণতি হয়তো কমতে পারে।

তবে সুখবর হচ্ছে, যদিও কর্মী যাওয়ার সংখ্যা কমে গেছে কিন্তু রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালটি আগের দুটি বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি আয় করেছে। সরকারি মতে, ২০১৮ সালে প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স আমরা আনতে পারি। অথচ তুলনামূলকভাবে বেশি কর্মী পাঠানোর বিপরীতে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে গড়ে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার দেশে আসে। এই ক্ষেত্রে বৈধপথে বিদেশে টাকা পাঠানো বা বতর্মানে বহুল প্রচলিত মোবাইল মানি ট্রান্সফারও ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তবে অবৈধ উপায়ে বা হুন্ডির মাধ্যমে যে পরিমাণ টাকা প্রতিবছর দেশে আসে তা যদি বন্ধ করা যায় তাহলে রেমিট্যান্স আহরণ আরও যে বাড়বে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর ফলে একজন অভিবাসী রেমিট্যান্স আয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা পাবেন ও সমৃদ্ধ হবেন।

আমরা সবাই একমত যে কৃষি ও তৈরি পোশাক খাতের পরে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম একটি ভিত হচ্ছে প্রবাসী কর্মীর পাঠানো রেমিট্যান্স। ধারাবাহিকভাবে দেশে রেমিট্যান্স আসায় শুধু কর্মক্ষমদের বেকারত্ব দূরই হচ্ছে না, একই সঙ্গে এর মাধ্যমে দেশে প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স এসে দেশকে সমৃদ্ধ করছে। যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য খুবই জরুরি। তবে অর্জিত রেমিট্যান্স কীভাবে আয়মূলক কাজে বিনিয়োগ করবো বা বিদেশ ফেরতদের অর্জিত দক্ষতা কীভাবে কাজে লাগিয়ে আরও সমৃদ্ধ হবো এই ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি দেখা যায়। সরকার যদি ফেরত অভিবাসীর সক্ষমতা ও চাহিদা যাচাই করে ফেরত অভিবাসীদের পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগ নেয় তাহলে শ্রম অভিবাসনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সবাই লাভবান হতে পারবো।

যদিও সারাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসীরা বিদেশ যাচ্ছেন, কিন্তু ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র কয়েকটি জেলা থেকে বিদেশ যাওয়ার সংখ্যাটি বেশি দেখা যায়। যেমন: চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নোয়াখালী ও কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে বেশি কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। এর বাইরে অন্য জেলাগুলো থেকে কর্মীর বিদেশে যাওয়ার হার কম। সুতরাং কেন অন্য জেলা থেকে কর্মী যাচ্ছে না তা যদি খতিয়ে দেশে সঠিক নিয়মে বিদেশে পাঠানো যায় তাহলে সবার সুযোগ তৈরি হবে এবং বেকারত্ব আরও কমবে।

সরকারি অফিস বিএমইটি’র ডাটাবেজে প্রতি বছর কতজন মানুষ চাকরির উদ্দেশ্যে বিদেশে যাচ্ছেন এ তথ্যটি সহজে পাওয়া গেলেও প্রতি বছর কতজন মানুষ সফল বা ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন এই তথ্যটি নেই। ফলে এ পর্যন্ত কতজন মানুষ বিদেশে আছেন এই নির্ভুল তথ্যটি প্রায়ই আমরা পাই না। নানাবিধ প্রয়োজনে এই তথ্যটি আমাদের কাজে লাগতে পারে। সুতরাং সরকারের উদ্যোগে ফেরত আসা কর্মীর তথ্য সংরক্ষণ করলে তাদের নিয়ে যে কোনও নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা সহজ হবে।

এটা ঠিক যে শ্রম অভিবাসনের চূড়ান্ত সফলতা হচ্ছে একজন অভিবাসী কর্মীর নিরাপদ শ্রম অভিবাসন ছাড়াও আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন করা। অভিবাসন শেষে যদি আর্থিকভাবে লাভবান হতে না পারেন তাহলে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই অভিবাসনের কোনও প্রয়োজন বোধহয় কাজে লাগে না। বিদেশ ফেরতদের নানাবিধ চাহিদা থাকে। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের সমস্যা বিবেচনায় এনে পুনর্বাসন করা দরকার। পুরুষ ছাড়াও নারী কর্মীদের যাওয়ার আগে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও মর্যাদার বিষয়টি বিশ্লেষণ করে পাঠানোর উদ্যোগ নিলে তারা কম বিপদে পড়বেন। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য সবাই মিলে করণীয় নির্ধারণ করাও জরুরি। মনে রাখা দরকার, এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারাও আমাদের সমাজের অংশ; তাদের ঘামঝরা শ্রমের অবদানে অর্থনীতির চাকা গতিশীল ও নির্ভার। 

লেখক: উন্নয়ন কর্মী।

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
সেতুমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে জিডি
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
ফসলের মাঠে সোনারঙ, তীব্র গরমেও কৃষকের মুখে হাসি
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভূমিকা রাখার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ