X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাকা-পয়সা হাতের ময়লা

বিধান রিবেরু
০১ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৫০আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৫১

বিধান রিবেরু অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য যেমন তেলের ওপর ভাসছে, বাংলাদেশও তেমনি তরল অর্থের ওপর ভাসমান। কারণ রাজনৈতিক দলের মধ্যমসারির নেতাদের শিউলি ফুলের গাছের মতো একটু নাড়া দিলেই শত শত কোটি টাকা ঝরে পড়ছে ইদানীং। বিভিন্ন খেলাধুলা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও বাদ যাচ্ছেন না। সম্প্রতি জুয়াবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই এমন অবৈধ টাকার ঝনঝন শোনা যাচ্ছে অহরহ।
এসব শত শত কোটি টাকার খেলা বালখিল্য, কারণ আমরা জানি হাজার হাজার কোটি টাকা এরইমধ্যে বিদেশে পাচার করা সম্পন্ন হয়েছে। জুয়ার টেবিলে তো হাতের ময়লা ফেলতেই যায় লোকে। তাই এটাকে এতো বড় ঘটনা হিসেবে দেখার কিছু নেই। একজন পোশাক শ্রমিকের কয়েক মাসের বেতন এক জুয়ার আসরেই কি অনায়াসে তারা উড়িয়ে দেয়, যেন ওগুলো টাকা নয়, হাতে লেগে থাকা ধুলোবালি। ক্যাসিনোর টেবিল থেকে উদ্ধার হওয়া অর্থ আদতে হিমশৈলের একাংশ। যারা এক সন্ধ্যায় লাখ টাকা জুয়ার টেবিলে ছড়িয়ে দিতে পারে, তারা কী পরিমাণ টাকা বানিয়েছে, সেটা তো কষ্টকল্প নয়।
গত এক দশকে কত চুনোপুঁটি যে নয়ছয় করে টাকার কুমির নয়, ডাইনোসর বনে গেছে, সেটা সরকারপ্রধানের বক্তৃতা থেকেই স্পষ্ট। আমরা আশা করি, তিনি আরও বড় জুয়ার আসর যেটা, শেয়ারবাজার, সেখানকার নীলতিমিদের দিকেও নজর দেবেন।

এদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ময়লা ও জঞ্জালের পরিমাণ বেড়েছে শঙ্কাজনক হারে। মন ময়লা বলেই এরা সর্বত্র আবর্জনা ছড়াতে থাকে। চাক্ষুষ প্রমাণ সামনেই রয়েছে। যে রাজনৈতিক নেতাদের এত শত শত কোটি টাকা, তাদের দৃষ্টিকটু পোস্টারেই দেখবেন ছেয়ে থাকে শহরের দেয়াল, উড়াল সেতুর স্তম্ভ, এমনকি ময়লার ভাগাড় পর্যন্ত। ব্যানার ঝুলে থাকে বাদুড়ের মতো। শহরটাকে নোংরা বানানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা যেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারবাজিতে ছাত্রনেতাদের সম্পৃক্ত থাকা বা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যদের উন্নয়ন বাণিজ্য ইত্যাদি ময়লা প্রসঙ্গ না হয় উহ্যই থাকলো।

নানা মাত্রার নোংরামি করে হঠাৎ বনে যাওয়া নব্যধনী রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী জানে না কীভাবে অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে হয়। জানবেই বা কীভাবে, জনগণের ঘাড় ভেঙে, সরিষা পিষে তেল বের করার মতো করেই তো এই অর্থের পাহাড় গড়া হয়, তো সেটা আর জনগণের কাছে ফিরে যাবে কেন? সেটা যাবে বিদেশে। সেখানে বিনিয়োগ করে নিজের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার চেষ্টা হবে। সেটাই হচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একসময় শোষণ করেছে, এরপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল, এখন আমরাই আমাদের শোষণ করি। নিজের দেশেই কায়েম হয়েছে দুই রাষ্ট্র। এক রাষ্ট্রের মানুষ ঠকেই যাচ্ছে। আরেক রাষ্ট্রের মানুষ ঠকিয়েই যাচ্ছে।

যারা অনবরত ঠকানোর খেলা খেলছে, তারা জানে, পাশার দান উল্টালে বিপদ হামলে পড়বে বাঘের মতো। তাই নিজেরা যেকোনও সময় দেশের বাইরে উড়াল দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত, এমনকি পরবর্তী প্রজন্মকেও আর বাংলাদেশে রাখতে চাইছে না। নেতাকর্মী বা ব্যবসায়ী, দেশ যেন তাদের কাছে অর্থ কামাই করার কারখানা, পরিবার থাকবে বিদেশে, তারা শুধু এখান থেকে যেনতেন উপায়ে টাকা বানিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। দেশের মানুষ মরুক, বাঁচুক, তাতে কিছু যায় আসে না। সুযোগ বুঝে তারা শুধু সটকে পড়বে। দেশের জন্য ‘প্রেমটেম’ এখন আর কেউ বোধ করে না, উল্টো কেউ বললে কৌতুক বোধ করে।

এই এরাই দেশের ময়লা দেখে ছিছি করবে, অথচ দেশটাকে নোংরা করার সব আয়োজন এরাই রচনা করে প্রতিনিয়ত। এরা কখনও বলবে না, যেখানে-সেখানে ব্যানার পোস্টার লাগানো যাবে না। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা বা তা নাড়াচাড়া করা যাবে না। নদীগুলোতে কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা যাবে না। নির্বিচারে বন উজাড় করা যাবে না। কখনও এরা ছাত্ররাজনীতিকে টেন্ডারবাজি থেকে পৃথক রাখবে না। শিক্ষা বা চিকিৎসা নিয়ে পৈশাচিক ব্যবসা বন্ধ করার কথা বলবে না। কখনও এরা বলবে না, আজ থেকে খাবারে কোনোরকম বিষ মেশানো যাবে না, মেশালে ফাঁসি। এরা কখনোই বলবে না, দুর্নীতির জালে জর্জরিত এই দেশকে মুক্ত করতে আমরা সৎ থাকবো। কাজেই দেশকে ময়লা বানাচ্ছে কারা? তারাই বানাচ্ছে, যারা আজ  জুয়ার আসরে শত শত কোটি টাকা উড়াচ্ছে। বা ওড়ানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। টাকা-পয়সা তাদের হাতের ময়লা। আসলে তাদের মনও ময়লা, তাই দেশটাকেও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে।

বাংলায় আরও একটি কথা চালু আছে, তা হলো—অর্থই অনর্থের মূল। আমি মনে করি, অর্থ মানুষকে অনর্থের পথে চালিত করতে পারে না, যদি আপনার মনে আবর্জনা না থাকে। আবর্জনা সরানোর একমাত্র উপায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কেবলমাত্র জুয়া খেলা বন্ধ করে যদি কেউ রাজনৈতিক সদিচ্ছার দোহাই দেয়, আমি বলবো হয় তারা বোকা, নয় তো তারা সেই একই ধোঁকা দিচ্ছে। জনগণকে ‘বুঝ’ দেওয়া শুদ্ধি অভিযান করে আদতে দেশের এই হাজার হাজার কোটি কালো টাকার প্রবাহ বন্ধ করা যাবে না। আপনি যদি শত শত কোটি টাকার ঋণখেলাপি ও সাজাপ্রাপ্ত কাউকে আবারও ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নেন, আপনি যদি ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেন, আপনি যদি কালো টাকার মালিকদের ছাড় দিয়ে মাথায় হাত বোলান, তো বুঝতে হবে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় ঘাটতি আছে। আর ঘাটতি পূরণের জন্য তাই মাঝে মাঝেই চলবে ক্যাসিনো, জঙ্গি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি অভিযান। সমস্যার পরিধিতে ঘোরাফেরা না করে, কেন্দ্রে হাত দিতে পারলেই জনগণের মন জয় করা যাবে। কাজটি অতো সহজ নয়, আবার কঠিনও নয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ