X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নুসরাত হত্যা মামলার রায় ও জনমনের প্রত্যাশাপূরণ

মো. জাকির হোসেন
২৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:৩১আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:৩২

মো. জাকির হোসেন সোনাগাজীর সোনার কন্যা জীবনযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। চার্জশিটের ১৬ আসামির সবার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। কোনও মামলার সব আসামির মৃত্যুদণ্ড বিরল ঘটনা। তবে জন-মনে এমন রায় বহুল প্রত্যাশিত ছিল।
ঘটনার মাত্র সাড়ে ছয় মাসে ৬১ কার্যদিবসে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে এটি নিঃসন্দেহে ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা।
তবে, নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে জনমনে তুষ্টি থাকলেও হৃদয়ের কোণে একটু বেদনা রয়েই গেছে। সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম এই মামলায় আসামি না হওয়ায় ও শাস্তিপ্রাপ্ত না হওয়ায় বেদনা থাকাই স্বাভাবিক। তবে মন্দের ভালো মামলার রায়ে তৎকালীন পুলিশের এসপি ও ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। আর ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আসামিরা ইতোমধ্যেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল দায়েরের ঘোষণা দিয়েছে। জনমনে প্রত্যাশা উচ্চ আদালতও দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবেন।

নুসরাত এক দ্রোহের নাম। নুসরাত নামে এক তরুণীর ছোট্ট বুকের মধ্যে কী ভয়ঙ্কর দ্রোহের আগুন ছিল। শিক্ষক নামের পশু গায়ে হাত দেওয়ার লজ্জায় কুঁকড়ে যায়নি নুসরাত। সাহসের হাঁটুতে ভর করে শিরদাঁড়া সোজা করে প্রতিবাদ করেছে। থানার ওসি তাঁকে সহযোগিতার বদলে অসহযোগিতা করেছে। অসম্মানিত করেছে। সমাজ-রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয়, বরং নারীর প্রতি বৈরি জেনেও নুসরাত প্রতিবাদ করেছেন। শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই হবে। আগুনে ঝলসে মৃত্যু হবে জেনেও প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে। শরীরের ৮০ শতাংশ দগ্ধ হওয়ার পর ফেনী থেকে ঢাকার মৃত্যু যাত্রার পথে তার ভাইয়ের মোবাইলে রেকর্ড করা এক অডিওতে তাকে বলতে শোনা গেছে—‘শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিয়েছেন, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো।’ অপরাধীরা ভয়ঙ্কর, সংখ্যায় অনেক ও শক্তিশালী জেনেও নুসরাত তার লাড়াইয়ে দমে যাননি। তার দ্রোহের লড়াই আমাদের ধুঁকতে থাকা সমাজ আর রাষ্ট্রকে ঘা মেরেছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থাও দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছে তার অদম্য লড়াইয়ে। তার প্রমাণ মেলে দ্রুত ন্যায্য রায় ঘোষণার মাধ্যমে। এ মামলার রায় বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করা হয় এ মামলার রায়ে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধির মৃত্যুদণ্ডের রায় আইনের শাসনেরই জয়ধ্বনি। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না আমাদের নিম্ন আদালতে ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। এ পর্বতসম মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে সরকারকে বিচার বিভাগের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩২ কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে যেখানে ৮৬ হাজার বিচারক রয়েছে সেখানে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে অনুমোদিত বিচারকের পদই আছে মাত্র ১ হাজার ৬৫৫টি।

সুপ্রিম কোর্টের এক তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে আবার শতাধিক বিচারক বিচার কাজের বাইরে প্রেষণে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজার নাগরিকের বিপরীতে ১ জন এবং ভারতে ৬৭ হাজার নাগরিকের বিপরীতে ১জন করে বিচারক কর্মরত। আর বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ নাগরিকের বিপরীতে কর্মরত বিচারকের সংখ্যা মাত্র ১ জন।এক গবেষণায় প্রকাশ যে হারে মামলা নিষ্পত্তি ও নতুন মামলা দায়ের হচ্ছে এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী কয়েক’শ বছরেও মামলাজট নিরসন সম্ভব নয়। পরিস্থিতি পাল্টাতে চাই বাস্তবসম্মত কার্যকর ব্যবস্থা। অনেকেই অধিক সংখ্যক বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে মামলাজট নিরসনের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে কোনও সন্দেহ নেই। সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্র ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে নতুন নতুন বিষয়কে বিচারিক কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এজন্য পর্যাপ্ত আদালত তৈরি করা হয়নি। বিদ্যমান আদালতের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, সাইবার ক্রাইম, মানব পাচার, পরিবেশ, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের কার্যাবলীর বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ছাড়া সময়ে সময়ে একটি উপজেলা ভেঙে একাধিক উপজেলা ঘোষণা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ওসি, এএসপি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হলেও এ সকল নবসৃষ্ট উপজেলার জন্য বিচারিক হাকিমের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে এক উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারককে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে একাধিক উপজেলার বিচারিক হাকিমের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আর এ প্রক্রিয়ায় মামলাজট ফুলে-ফেঁপে উঠছে দিন, মাস বছর গড়িয়ে। এ অবস্থায় বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হলো অধিক সংখ্যক বিচারক নিয়োগ হলে এজলাস কোথায় পাওয়া যাবে। বিচার বিভাগ তো ভয়ঙ্কর ভৌত আবকাঠামো সমস্যায় জর্জরিত। কিছুদিন আগে পটিয়া আইন কলেজ পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আমার বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী পটিয়া আদালতে বিচারক হিসাবে কর্মরত আছেন জেনে ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম পটিয়া যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। সম্মানিত বিচারকদের আমন্ত্রণে চা পানে রাজি হই। চা আপ্যায়নের পর্ব চলাকালে হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। লক্ষ্য করি, বিচারকগণ চা পান রেখে দৌড়া দৌড়ি শুরু করেছেন। প্রথমে বেশ খটকা লাগলেও দ্রুতই রহস্য উন্মোচিত হয়। পটিয়া যুগ্ম জেলা ও দয়রা জজ এর নেতৃত্বে ৮টি আদালত রয়েছে। ২০১৯ সনের জুলাই মাস পর্যন্ত পরিসংখ্যান বলছে পটিয়া আদালতে ২১ হাজার ৭৯১টি দেওয়ানি ও ২ হাজার ১৩৪টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। সম্পূর্ণ আদালত ভবনটি কাঠের খুঁটি, বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাওনি দিয়ে তৈরি। বৃষ্টি নামলে টিনের ছাদের ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টি পড়ে মামলার নথি-পত্র ভিজে যায়। তাই আকাশে মেঘ করলেই জজদের মনের কোণে জমে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আর মেঘ বৃষ্টিতে রূপ নিলেই জজদের ছোটাছুটি মামলার নথি বাঁচাতে। ব্রিটিশ শাসনামলে কাঠ, বাঁশ আর টিনের সমন্বয়ে জজদের আবাসনের জন্য তিনটি বাড়ি নির্মাণ করা হলেও তা এখন মাটিতে বিলীন। তার মানে বিচারকদের জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা নেই এখানে। ভৌত অবকাঠামোর এ সংকট বিচার বিভাগে স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক জেলাতেই বর্তমান বিচারকদের একই এজলাস ভাগাভাগি করে বিচারকার্য চালাতে হচ্ছে। দিনের এক অংশে একজন বিচারক এজলাসে বসছেন আর দিনের অপর অংশে আরেকজন বিচারক সেই এজলাসে বসে বিচারিক কাজ করছেন। ফলে বিচারক তার দায়িত্বের পুরোটা পালন করতে পারছেন না কেবল এজলাসের অভাবে। এভাবে বিচারকের অব্যবহৃত সময় ও সম্ভাবনা মামলাজটে ভূমিকা রাখছে। খোঁড়া অজুহাতে আইনজীবীদের বারবার সময় নেওয়াও মামলার দীর্ঘসূত্রিতার অন্যতম কারণ। বিচার ব্যবস্থার খোল-নলচে পাল্টে ফেলা সংস্কার ছাড়া কেবল বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিচার পাওয়ার অধিকারের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

নুসরাত হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে জনমনে যে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করতে জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারক নিয়োগ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। যে সব ক্ষেত্রে কেবল ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সুবিধার্থে বিদ্যমান আইনের ফাঁক-ফোকরের সুযোগ নিয়ে বিচারকে বিলম্বিত করার সুযোগ রয়েছে তা আইন সংশোধন করে এবং প্রয়োজনে নতুন আইন তৈরি করে বন্ধ করতে হবে। এটি না করলে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা অনিবার্য। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কেবল ব্যক্তিবিশেষ বা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে মারাত্মক ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যায়। বিচারকার্য নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরাও অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। এমন অচালয়তন ভাঙতে না পারলে আবার কোনও এক নুসরাতের ঘটনার দ্রুত বিচারের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া জনমনের প্রত্যাশা পূরণ হবে কীভাবে?

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

 

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
বিএনপি নেতারা ‘সিম্প্যাথি কার্ড’ খেলার অপচেষ্টা করছে: কাদের
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
গ্রন্থাগার অধিদফতরের কাজে গতি আনতে কামাল চৌধুরীর আহ্বান
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
মীরসরাই প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি ঘোষণা
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ