X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

এসব কীসের আলামত?

রেজানুর রহমান
০৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১৯আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:২১






রেজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনে খবরটা পড়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম। এও কী সম্ভব? খবরের শিরোনাম হয়েছে ‘মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে জাতীয় চার নেতার পরিচিতি নাম সবই ভুল!’ প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিলো না। জাতীয় চার নেতার নাম ও পরিচিতি দিতে ভুল করবে, কার এত বড় সাহস! অনেকে হয়তো বলবেন, ভুল তো ভুলই। এখানে সাহসের প্রশ্ন আসছে কেন? সাহসের প্রশ্ন আসছে এজন্য যে, বিশেষ বিশেষ কাজে ভুল মানেই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। পিতা অথবা মাতার কবরে নাম খোদাই করবেন। এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই নামের বানানে ভুল হবে না। বরং নামের ক্ষেত্রে যাতে কোনও ভুল-ভ্রান্তি না হয় সে ব্যাপারেই আপনি বেশি সচেতন ও সতর্ক থাকবেন! জাতীয় চার নেতাও তো আমাদের পিতা সমতুল্য। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ তারা। অথচ তাদের নাম ও পরিচিতি দিতে যখন ভুল হয়, তখন কি সেটা শুধুই ভুল? নাকি চূড়ান্ত পর্যায়ের অমনোযোগিতা এই ভুলের জন্য দায়ী?




বাংলা ট্রিবিউনের খবরেই পড়লাম ঐতিহাসিক মুজিব নগরে শত কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কাজ ৯ বছর আগে শেষ হয়েছে। অথচ পরিচয়লিপিটি সংশোধনের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ আসছেন এই স্মৃতি কমপ্লেক্সে। জাতীয় চার নেতার নামের ভুল বানানে ভুল পরিচিতি দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন। মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি অনেকটা দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলেছেন, ‘এ প্রকল্পটি গণপূর্ত বিভাগ দেখাশোনা করে। তারপরও আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে এটি সংশোধেনের জন্য তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।’

খবরটি পড়ে একটি আলোচিত মঞ্চ নাটকের কাহিনি মনে পড়ে গেলো। নাটকের কাহিনিতে দেখা যায়, প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে একটি বড় গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে যায় এবং একজন লোক ভাঙা ডালে চাপা পড়ে। ঝড় বৃষ্টি থেমে যায় কিন্তু গাছের ডালে চাপা পড়া মানুষটিকে উদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসে না। মৃত প্রায় মানুষটি বারবার তাকে বাঁচানোর জন্য চিৎকার করছিলো। কিন্তু কেউ তার চিৎকার শুনছিলো না। বরং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো কেউ কেউ। পরে জানা গেলো গাছটির ডাল ঠিক কোন মন্ত্রণালয়ের ভূমিতে পড়েছে তাই নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। বিতর্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত গাছের ডাল সরানো যাবে না। কারণ, আইনি বাধা আছে! শেষমেশ কী হলো? একসময় ডাল সরানো হলো ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে গাছের ডালে চাপা পড়া মানুষটির অসহায় মৃত্যু হয়েছে।

মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে প্রতিদিনই এভাবে ইতিহাসের মৃত্যু হচ্ছে। ভাবা যায়, দেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনায় ইতিহাসের ভুল তথ্য দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ এক্ষেত্রে কারও কোনও জবাবদিহি নেই!

সত্যি কথা বলতে কী, শুধু মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি জায়গায় মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ঠিক পরিচর্যা গুরুত্ব পাচ্ছে না। সারা বছর এক ধরনের অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে অধিকাংশ স্থাপনা। ডিসেম্বর ও মার্চ মাস এলেই হঠাৎ করে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়। তাও অনেকটা দায়সারা গোছের ধোয়ামোছা! ডিসেম্বর ও মার্চ মাসের পর বছরের বাকিটা সময় আর কোনও নজর থাকে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বেশি দূর যেতে হবে না। রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কথাই যদি বলি, চূড়ান্ত পর্যায়ের অনিয়ম ও অবহেলায় পড়ে থাকে আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাসে হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার জাতির কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কত আয়োজন, কত নিরাপত্তা। কতই না আদর! ফেব্রুয়ারি শেষ হতে না হতেই আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আবার অযত্ন-অবহেলার চোরাবালিতে পড়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবই জানে, সবই দেখে। কিন্তু ওই যে আনুষ্ঠানিকতা? আনুষ্ঠানিকতার বাইরে তো যাওয়া মুশকিল। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করতে গিয়ে আমরা অনেকেই দায়-দায়িত্বহীন হয়ে যাচ্ছি। আমার দায় ও দায়িত্ব ঠিক অতদূর পর্যন্ত। অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি যেন সফলভাবে সম্পন্ন হয়... ব্যস আমার দায়িত্ব শেষ। তারপরে কী হবে আমার তো জানার কথা নয়। এই যে দায়সারা দায়-দায়িত্ব পালনের মন মানসিকতা এটাই সর্বনাশ ডেকে আনছে।

অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন সর্বনাশটা কি-রে ভাই? তাদের উদ্দেশে বিনীত জিজ্ঞাসা, এখনও কি সত্যি সত্যি বুঝতে পারছেন না সর্বনাশটা কী? ডিসেম্বর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাস। এবারের বিজয়ের মাসটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চলছে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী। আগামী বছর পালিত হবে স্বাধীনতার ৫০ বছর। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি কোণে তখন আনন্দ আর উৎসবের ঢেউ ওঠার কথা! অথচ দেশটা যেন হঠাৎ থমকে গেছে। ভাস্কর্য ও মূর্তি বিতর্কে ভীতি ছড়ানো পরিবেশ দেখা দিয়েছে। মহান স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা হচ্ছে। কুষ্টিযায় নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাবা যায়, যে মানুষটির আপসহীন নেতৃত্বে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হলো সেই দেশেই তাঁর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা হচ্ছে। তাও আবার ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ভাস্কর্য ও মূর্তি নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু শ্রদ্ধার সাথেই বলছি, যারা বিতর্ক করছেন তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, মানুষটি কে? কার ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? যে মানুষটি একটি দেশের জন্ম দিলেন, সেই দেশেই তাঁর ভাস্কর্য হবে কী হবে না সেটাও কি বিতর্কের অংশ হতে পারে? পাশাপাশি বিতর্কের ভাষা চয়নের ক্ষেত্রেও কি সংশ্লিষ্টরা সংযত আচরণ করছেন? এসব কীসের আলামত?

ইসলাম শান্তির ধর্ম। আর তাই আমি একজন মুসলমান হিসেবে গর্ব করি। যুগের প্রয়োজনে আমাদের ধর্মীয় বিধানের অনেক পরিবর্তন এসেছে। একসময় বলা হতো ইসলাম ধর্মে ক্যামেরায় ছবি তোলা পাপ। যুগের প্রয়োজনে আমাদের তো ছবি তুলতে হচ্ছে। টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রেও ধর্মীয় বিধান ছিল। এখন টেলিভিশন ছাড়া জীবন যেন চলেই না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যে জয় জয়কার এখন। এক্ষেত্রে আমাদের ধর্মীয় বিধান কী বলে? অথচ আমাদের সম্মানিত ধর্মীয় বক্তাগণ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যকেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন। এটাই হলো যুগের দাবি। যুগের দাবি মেটাতেই পৃথিবীর দেশে দেশে বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মনীষীদের ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। অনেক মুসলিম প্রধান দেশেও একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তির ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানে হঠাৎ করে বাংলাদেশে ভাস্কর্যবিরোধী এই যে আন্দোলন শুরু হয়েছে এর পেছনে কারণ কী? কারণ একটাই, তা হলো- দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা।

এজন্য কি বর্তমান সরকারের দায় নেই? অবশ্যই আছে। মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স-এর কথায় আবার আসি। এটি মহান স্বাধীনতার ইতিহাসশ্রয়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অথচ এই স্থাপনার ক্ষেত্রে ভুল করার নামে যারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন তাদের কেন এতদিন শাস্তি দেওয়া হয়নি। দেশের অধিকাংশ মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের জাতীয় সংগীত বাজে না। দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস পড়ানো হয় না। স্বাধীনতার ইতিহাস আলোচনাও করা হয় না। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই তা জানেন। তাহলে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে ধর্মের বিধান তুলে প্রতিবাদ শুরু হয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে, সরকার ওই সময় নমনীয় মনোভাব পোষণ করায় ধর্ম ব্যবসায়ীরা সাহসী হয়ে উঠেছে। যার ফলশ্রুতিতে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রেও বিরোধিতা করার সাহস দেখাচ্ছে।

দেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় বিস্ময়কর খবর পড়লাম। বঙ্গবন্ধুর খুনির নাম নাকি এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক নামের ভিড়ে এই নামটি নাকি তাদের নজরে আসেনি। তার এই বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য। এক বালতি দুধকে নষ্ট করতে এক ফোঁটা লেবুর রসই যথেষ্ট। এই যে আমরা এক ফোঁটা লেবুর রসকে গুরুত্ব দিচ্ছি না; এই মানসিকতাই হয়তো শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ দুর্যোগ ডেকে আনবে। আরও ভয়াবহ একটি তথ্য তুলে ধরতে চাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম দেশের একটি মাদ্রাসায় আমাদের জাতীয় সংগীতের অনুকরণে পৃথক মাদ্রাসা সংগীত চালু করা হয়েছে এবং এই সংগীত প্রতিদিন ওই মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গাইছে। জানা মতে, এই সংগীত রচয়িতা অথবা উক্ত মাদ্রাসার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব কীসের আলামত? জবাব আছে কী?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা সেনানিবাসে এএফআইপি ও সেনাপ্রাঙ্গণ ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
ঢাকা সেনানিবাসে এএফআইপি ও সেনাপ্রাঙ্গণ ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
চালককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রিকশা ছিনতাই করতো তারা
চালককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রিকশা ছিনতাই করতো তারা
হলফনামায় তথ্য গোপন, ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের মনোনয়নপত্র বাতিল
হলফনামায় তথ্য গোপন, ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের মনোনয়নপত্র বাতিল
মানবপাচার: মিল্টন সমাদ্দার আবার ৪ দিনের রিমান্ডে
মানবপাচার: মিল্টন সমাদ্দার আবার ৪ দিনের রিমান্ডে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ