X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পঞ্চাশে বাংলাদেশ: সত্তাবোধের সুদীর্ঘ লড়াই

কাজী আনিস আহমেদ
১২ এপ্রিল ২০২১, ১২:১৯আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৪৪

কাজী আনিস আহমেদ কেউ যদি জানতে চায় পঞ্চাশে পা রাখা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন কী? নিঃসন্দেহে প্রথম উত্তর– স্বাধীনতা। এরপর? উন্নয়ন সূচকের নানা বিচারে তাক লাগানো অগ্রগতি? অর্থনৈতিক খাতে উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি? দারিদ্র্যের হারে উল্লেখযোগ্য হ্রাস? নারী ক্ষমতায়ন বা গড় আয়ু বৃদ্ধি? এমন অনেক অর্জনই এখন বাংলাদেশের ঝুলিতে আছে। এসব সূচকে আমাদের আরও অনেক অর্জনের সুযোগ থাকলেও বাস্তবে অর্জিত ফলগুলো খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে কোনও একটি সঠিক উত্তর নেই। একেকজনের ধারণায় একেকটা বিষয় বেশি বা কম গুরুত্ব পাবে। তবে আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন- সাংবিধানিকভাবে আমরা আজও একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

ধর্মনিরপেক্ষতা যেহেতু আমাদের রাষ্ট্র হিসেবে ভিত্তিকালীন চারটি মূলনীতির একটি, অতএব এটির অটুট থাকা নিয়ে তৃপ্তি প্রকাশ অনেকের কাছেই বিচিত্র ঠেকতে পারে। বাস্তবতা এই যে, এই একটি মূল্যবোধের ওপর বারবার যেভাবে আঘাত এসেছে; তা আর অন্য কোনোটার বেলায় ঘটেনি।

ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে তর্ক সাপেক্ষ। তবে আমাদের সার্বভৌমত্ব কেউ সরাসরি ক্ষুণ্ন করতে চেষ্টা করেছে এমনটা দেখা যায় না। সমাজতন্ত্র বিশ্বে সর্বত্র তত্ত্বীয় এবং প্র্যাকটিক্যাল পর্যায়ে অসার প্রমাণিত। এটাকে সামাজিক সাম্যতা ও সুরক্ষার আকরে নিয়ে আসা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমাদের ঘাটতি অনেক। কিন্তু এটাই যে অভীষ্ট, সেটা কেউ অস্বীকার করে না। দেখা যায় যে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শটাকেই বাতিল প্রতিপন্ন করার জন্য আমাদের রাজনীতির এবং সমাজেরও একাংশ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে এসেছে।

অধিকাংশ নাগরিকের কাছে দৈনন্দিন পর্যায়ে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের কাছে গণতান্ত্রিক অধিকারও যথেষ্ট কাম্য। সেই তুলনায় ধর্মনিরপেক্ষতা কেন জরুরি, এটা অনেকেই বোঝেন না বা বুঝতে চান না। ভাবটা এমন যেন এটা কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা বা স্বস্তির জন্যে দরকার। কিন্তু সেই সংখ্যালঘুদের প্রতি একটি জাতি ও সমাজের মনোভাব ও আচরণ কেমন তা কিন্তু মূলত সংখ্যাগুরুদের চরিত্রেরই প্রকাশ। পাকিস্তান আমলে এই মনোভাব ছিল অধোমুখী। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই...। হিন্দু...বৌদ্ধ...খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’

বঙ্গবন্ধুর অগণিত ভাষণে এ ধরনের উচ্চারণের নমুনা পাওয়া যায়। স্বাধীনতার লগ্নে বাঙালিরা বুকে এই আদর্শ ধারণ করতো বলেই বারবার তার মুখেও এমনটা শোনা গেছে। অতএব, বাংলাদেশের আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

এখানে এটা পরিষ্কার করা দরকার যে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু পশ্চিমাদের মতো ধর্ম ও রাষ্ট্রকে একেবারে আলাদা করে রাখা নয়। উপরন্তু, এটা দিয়ে যা বোঝায় তা হলো, সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ও ধর্মীয় ভিত্তিতে কোনও বৈষম্য না দেখানো। অথচ সংসদের মূল কক্ষে যখন আমরা কেবল একটি ধর্মের বাণী দেয়ালে খচিত দেখি তখন ঠিক সেইরকম বৈষম্যেরই চরম প্রতীকী প্রকাশ ঘটে।

বলা যেতে পারে যে, আদর্শের যুদ্ধটা ১৯৭১ সালে আমরা জিতেছিলাম, সেটা কার্যত আবার শুরু হলো ১৯৭৫ সালে- যখন কিনা নির্মমভাবে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে।

এখানে রাষ্ট্রতত্ত্বের একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। কোনও সমাজ যখন কোনও প্রশ্নের মীমাংসায় কোনও বিকল্প খুঁজে না পায়, তখন তা রূপ নেয় যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধে। এক্ষেত্রে আমেরিকায় প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ক্রীতদাস প্রথা অবলোপনের প্রশ্নে সেদেশের উত্তর ও দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। সেই যুদ্ধে বিজয়ীদের আকাঙ্ক্ষাকে যুদ্ধের পরপরই সাংবিধানিক রূপ দেওয়া হয়। যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত মৌলিক আদর্শের বিষয় নিয়ে পরে প্রশ্ন তোলা বা গণতন্ত্রের নামে রেফারেন্ডামে ফেলার নৈতিক অধিকার কারও নেই। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ’৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশে সেটাই করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছিল যার, সেই জেনারেল জিয়াউর রহমান তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন শাহ আজিজুর রহমানকে। তিনি আবার স্বাধীনতাবিরোধীদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কুখ্যাত। গণহত্যাকারী পাকিস্তানিদের সহচর জামায়াতে ইসলামির ওপর থেকে তুলে নেওয়া হলো নিষেধাজ্ঞা। যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার প্রক্রিয়া বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন, সেটাও বাতিল করেন জিয়া। এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের হাত থেকে বাঁচাতে মারাত্মক এক ইনডেমনিটি আইন পাস করে খুনিদের বসিয়েছিলেন আরামপ্রদ কূটনীতিক পদে।

জিয়ার উত্তরসূরি স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও ধর্মকে বগলে নিয়ে ঘুরেছেন। তার শাসনকে বৈধতা দিতে তড়িঘড়ি নানান সরকারি নীতি ইসলামিকরণ করতে শুরু করেন। মুক্তি-সংগ্রামের মূল আদর্শকে পাস কাটিয়ে ইসলামকে এই দেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করে বসেন। যদিও বাংলাদেশ এখনও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ দেশই আছে, ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ নয়।

১৯৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র আসার পরও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল জিয়ারই গড়ে তোলা দল বিএনপি। দলটির নেতৃত্বে থাকা খালেদা জিয়া তখন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি জোট করেন। বিএনপি-জামায়াত জোটটা শুধু কৌশলগতই ছিল না। বিএনপির জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ তাতে বাঙালি পরিচয়টাকে এড়িয়ে বরাবরই ইসলামিক পরিচয়টাকে সামনের দিকে রাখা হয়েছিল। আর বিএনপির এ প্রচেষ্টা জামায়াতের ইসলামপন্থী এজেন্ডার সঙ্গে ভালোমতো খাপ খেয়ে গিয়েছিল।

যে আদর্শের হাত ধরে এ রাষ্ট্রের জন্ম, সেটা যদি শুরু থেকে অক্ষত থাকতো, তবে এ জাতি কতটা এগিয়ে যেতো, আমরা বোধহয় কখনই তা জানতে পারবো না। তবে আমরা যা জানি তা হলো, ১৯৭৫ সাল থেকে সামরিক শাসক ও তাদের ইসলামপন্থী মিত্রদের হাত ধরে যে নীতিতে বছরের পর বছর দেশটি চলেছে, সেটার চড়া মূল্য আমাদের দিতে হয়েছে। এখনও দিতে হচ্ছে।

ওই সময়টাতে পেট্রো-ডলারের হাত ধরে ইসলামিক প্রোপাগান্ডার উত্থান হয়েছিল। সম্প্রতি অনলাইন মৌলবাদকরণের হাত ধরেও ইসলামি চরমপন্থার প্রসার ত্বরান্বিত হয়েছে। এর যে বিস্তৃত প্রভাব, তাতে জনমানুষের একটা বড় অংশই এখন ভাবে, ধর্মীয় পরিচয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণির নাগরিক ভাবার অধিকার তাদের আছে। এই ধরনের চিন্তা কেবল ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী নয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ও আমাদের সংবিধানে সবকটি মূলনীতিরও পরিপন্থী। এ ধরনের চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের মৌলিক সত্তাবোধের বিপরীত।

এক বিচারে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিমালা এখন অনেকটা প্রতীকী অবস্থানে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে সংবিধানের প্রচ্ছদের পরই শোভা পায় ইসলামিক বাক্য। স্কুলের পাঠ্যসূচিতে এমন কিছু বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যা ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে যায়। বিচারিক বিষয়গুলোর দিকে তাকালেও দেখি, মুসলমানদের পারিবারিক বিষয়াবলি শরিয়া আইনের অধীনে আছে এবং সেই সূত্রে উত্তরাধিকার হিসেবে নারীদের সম-অধিকারকে অস্বীকার করার মতো সনাতন আইন আজও টিকে আছে।

তবে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের চেয়েও বড় কথা হলো, বাংলাদেশ যে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে ক্রমে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আমাদের সামাজিক মনোভাবেও সেটার জ্বলজ্বলে প্রমাণ দেখা যায়। ইসলামি বিধান মেনে চলতে সবার ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের মনোভাব বেড়েছে। ‘ধর্মীয় অনুভূতিকে’ আঘাত করার অভিযোগে মামলা থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে বয়কট কিংবা অনলাইন ট্রলিং- তো আছেই; আরও মারাত্মক হলো ইসলামি উগ্রবাদীদের জারিকৃত হত্যার হুমকি।

গত দু’দশকে একাধিক মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী লেখক বা ব্লগারদের ওপর সরাসরি আক্রমণের ঘটনা দেখে বোঝা যায় জাতি হিসেবে আমাদের সহিষ্ণুতার কতটা অবনতি হয়েছে।

ক্রীতদাস প্রথা অবলোপনে গৃহযুদ্ধের দেড় শ বছর পর আজকের আমেরিকায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনে জিম ক্রো’র (যুক্তরাষ্ট্রের জাতিগত বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী আইন) অপচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে। একইভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশের জাতীয় সত্তাবোধের প্রশ্ন নিয়ে আজও চলছে এক ধুন্ধুমার লড়াই।

বাঙালি মুসলমানের সত্তাবোধের জায়গায় কখনও গোঁড়ামি ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে বরং ইসলামি মৌলবাদই এদেশে আরও সম্প্রতি আনা চাপিয়ে দেওয়া একটা ব্যাপার। তাই যেখানে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই বাংলায় হত্যা ও হুমকির বিপদ ছাড়াই মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন ঘটতে পেরেছিল সেখানে একবিংশের গোড়ায় এসে যুক্তিতর্কের গায়ে চাকু চালানোর সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে।

স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে ধর্মব্যবসায়ীদের উল্লম্ফন, হুমকি ও শোডাউনের মধ্যেই সীমিত ছিল। ফলে দাউদ হায়দার থেকে তসলিমা নাসরিন পর্যন্ত অনেকে চাপের মুখে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছেন। ‘নাস্তিক’ তকমা দিয়ে অন্যরা তাঁদের যাবজ্জীবন নির্বাসনকে জায়েজ করেছে ও নিজেদের দায়মুক্ত করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রতত্ত্বের বিচারে সাদা চোখে কী মনে হবে? কোনও অংশের হিংসাত্মক হুমকির মুখে কোনও নাগরিকের চিরতরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়াটা একটি গোষ্ঠীর কাছে রাষ্ট্রের হেরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

কারও বক্তব্য যদি জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিতে এতটাই আঘাত হানে যে তার ফলে ধর্মব্যবসায়ীদের উস্কানি বা উস্কানি ছাড়া সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তবে সে ধরনের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞার আইন থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ধরনের বক্তব্যদানকারী যতই অর্বাচীন হোক না কেন, কোনও গোষ্ঠীর বা ব্যক্তির দ্বারা যখন তার জীবন হুমকিতে পড়ে তখন হুমকিদাতাকেই নিরস্ত্র করা ও শাস্তি দেওয়াই রাষ্ট্রের কাজ। কোনও অজুহাতে কোনও গোষ্ঠীর হত্যা বা অন্য হিংসাত্মক কর্মের হুমকির মুখে রাষ্ট্রের এই নতজানু আচরণ একটি আধুনিক প্রজাতন্ত্রের জন্য লজ্জাকর ব্যর্থতা বলতেই হবে।

স্বাধীনতার প্রথম তিন দশকে যা ঘটেছে তা আরও নিদারুণ রূপ ধারণ করে নতুন শতকের শুরু থেকে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে গণ্যমান্য কবি শামসুর রাহমান ও লেখক-প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদকে ছুরিকাঘাতের ঘটনাও ঘটে। ২০১০ সালের পর মাঝামাঝি সময়ে ওই ইসলামি উগ্রবাদীরা মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারদের টার্গেট করে হত্যা করেছে। মডারেট মুসলিম ধর্মপ্রচারকরাও তাদের হাত থেকে বাঁচেনি।

মূলত ’৭৫ পরবর্তী থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অবনমনের যে চেষ্টা চলে এসেছে তাতে প্রথম একটা ভাটা পড়ে যখন সুদীর্ঘ একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতা আসে। তবে এ ক্ষেত্রে ওই প্রথম মেয়াদের চেয়ে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার এক টানা শাসনকালটা বেশি সফল। কারণ এ সময়ে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো ’৭২ সালের আদি অবস্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরোক্ষভাবে হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে জোরদার করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে শেখ হাসিনার ভূমিকা যেমন আপসহীন, তেমনই কৌশলী। উদাহরণস্বরূপ মনে করা যায়, ইসলামপন্থীরা যখন সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য অপসারণ করার আন্দোলন জমাতে চাইলো, ওটাকে তখন এমনভাবে সরিয়ে নেওয়া হলো, যেন সেটা নামাজের স্থান থেকে আর দেখা না যায়। ভাস্কর্যটাকে কিন্তু উপড়ে ফেলা হয়নি।

তবে আওয়ামী লীগের রেকর্ডও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ’১০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারদের যখন টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন প্রথম দিকে ভিকটিমকে দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। উদারপন্থীরা তখন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে। বাংলাদেশে উদারপন্থী লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার ধারক হিসেবে কঠিন প্রতিকূল সময়েও বড় ও ছেদহীন ভূমিকা রেখে এসেছেন। অতএব তাদের ক্ষোভের সঙ্গত কারণ আছে।

একসময় বাংলাদেশ মানেই সবাই মনে করতো দুর্যোগ-পীড়িত একটি দেশ। দেরিতে হলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, স্কুলে যাওয়ার হার বৃদ্ধি এসব উল্লেখযোগ্য। যে সব উন্নয়নের সূচক নিয়ে বাংলাদেশ এখন প্রশংসিত হচ্ছে তা আমাদের প্রাপ্য। তবে পাশাপাশি এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটাকেও এক ধরনের বিজয় বলতে হবে যে, যতই দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলুক না কেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা এখনও দেশটির একটি প্রতিষ্ঠিত আদর্শ। এটাকে উল্টে ফেলার কম চেষ্টা হয়নি।

গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বেলায় আমাদের যেমন এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার আছে, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতা আদৌ একটি যুঝমান প্রক্রিয়ায় থাকাটাও একটা অর্জনের ব্যাপার। এর সঙ্গে জাতি হিসেবে আমাদের সত্তাবোধের প্রশ্ন সরাসরি ও নিগূঢ়ভাবে জড়িত।

যারা ভাবে এটাকে বাদ দিয়েও সদর্থে বাঙালি ও বাংলাদেশি হওয়া যাবে তারা বুঝে কিংবা না বুঝেই কার্যত খোদ মুক্তিযুদ্ধ ও তার আদর্শকেই অস্বীকার করে। এ কারণেই ’৭৫ থেকে আমাদের জাতিগত বিকাশের ধারার পরিপন্থী বিকৃত ইতিহাস ও একটি নব্য আইডিওলজি চালুর যে অপচেষ্টা চলে এসেছে তা ঘৃণাভরে পরিত্যাজ্য। তার প্রভাব আমাদেরকে এখন পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে হবে।

পঞ্চাশে পা রাখা বাংলাদেশের দৃপ্ত অঙ্গীকার তাই এই হওয়া উচিত যে, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল আদর্শ বাস্তবায়নে আমরা রবো নির্ভয় ও নিরলস।

লেখক: প্রকাশক, বাংলা ট্রিবিউন; সহ-পরিচালক, ঢাকা লিট ফেস্ট। 

 

/এসএ/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ