X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নাভিশ্বাসে জনজীবন!

সজীব ওয়াফি
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৯আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৪৯

সজীব ওয়াফি বাজারে চালের দাম বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। লাগামছাড়া দামে শহুরে দারিদ্র্য মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। গরিব মানুষের সস্তায় ক্রয়ের শেষ পণ্য মোটা চালের কেজি পৌঁছেছে ৫০ টাকায়। চালের দামের ওপর নির্ভর করছে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামের সমীকরণ। পরিণামে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কৃষক, শ্রমিক এবং পেশাজীবীসহ সীমিত আয়ের মানুষ। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে না সারাদেশে কালোবাজারি ঠেকানোর কার্যক্রম। অধিকন্তু বছরের এই সময়ে বাংলাদেশে চালের দাম বৃদ্ধি নজিরবিহীন এবং উৎকণ্ঠার।

প্রতিটি দেশের অর্থনীতির একটি প্রধানতম মাধ্যম থাকে। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। ধান, পাট, গম, চা ও আখ এখনকার কৃষকের আয়ের অন্যতম কৃষিজ ফসল। উর্বর মাটি আর অনুকূল আবহাওয়া এই বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনের উৎস। শতকরা ৮০ ভাগ পরিবার কৃষি আয়ের সঙ্গে জড়িত। সেখানে বছর তিনেক আগে থেকে ধানের বাজার মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ অতিরিক্ত। এর কারণ, ভারত থেকে চাল আমদানি করা হয় কৃষকের ধান কাটার মৌসুমে। মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয় যখন কৃষকের গোলায় ধান ওঠে এবং হাটে নিয়ে বিক্রির সময়। অন্যদিকে চাল আমদানিতে প্রতিবারই আমদানি শুল্ক কমানো হলেও চালের দাম আর কমে না।

পাট শিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় পাটের দাম কমেছে আশঙ্কাজনক। গত বছরে পাটকল পুরোপুরি বন্ধ করায়, পাটের চেয়ে খড়ির দাম এখন বেশি। করোনায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন পাটকল শ্রমিকেরা। লোকসানের মুখোমুখি হতে হয়েছে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের পাট চাষিদের। চা শ্রমিকদের নেই পর্যাপ্ত মজুরি। চাষি তার ফসল বিক্রি করে স্বপ্ন ছিল– ধারদেনা পরিশোধ করার, পরিবার পরিজন নিয়ে তিন বেলা দু’মুঠো খাবার খাওয়ার।

সরকার সরাসরি কৃষকের থেকে ফসল সংগ্রহ করে না। তারা ফসল সংগ্রহ করে মধ্যস্থ কারবারি থেকে। ফলে কৃষক হারিয়েছে তার ফসলের লাভ। কৃষকের প্রাপ্য লাভ গিয়ে ওঠে পুঁজিপতির গোলায়। একদিকে ফসলের লোকসান, করোনার নাকানিচুবানি; আরেকদিকে নিত্যপণ্যের চড়া দামে কৃষকের হাত অর্থশূন্য হওয়ার পথে। করোনা মহামারিকালীন প্রথমে বাড়ানো হলো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে গাড়ির ভাড়া বাড়বে, সারের দাম বাড়বে, বাড়বে কৃষকের ফসল উৎপাদনে সেচের খরচ। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম রাতারাতি হু হু করে বাড়তে বাধ্য। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের দামের সমীকরণ নির্ভর করে চালের বাজারের রাজনীতির ওপর।

প্রায় বছর দেড় আগে পৃথিবীজুড়ে মরণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। রূপান্তরিত হয় মহামারির। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও নিতে হয় লকডাউন-শাটডাউনের সিদ্ধান্ত। থমকে দাঁড়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতি। শুরু হতে থাকে অর্থনৈতিক মন্দা। অন্যদিকে করোনাকালে নিষিদ্ধ হয়েছে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যম ব্যাটারি চালিত রিকশা-ভ্যান, নাসিমন, করিমন। চাকরির বাজার সংকুচিত হয়েছে মারাত্মক রকমের। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়েছে অসংখ্য কর্মী ছাঁটাই। ছোটখাটো অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তি ঘটেছে। বিআইডিএস-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনায় বাংলাদেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে, আগের হিসাব যোগ করে গরিব মানুষের এই সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫ কোটির বেশি। হুঁশিয়ারি দিয়েছে মহামারি বাস্তবতার শিকার হয়ে ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দুর্নীতির দৌরাত্ম্য। মাইনে না পাওয়া বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও পার করছেন দুঃসময়। এমনকি প্রণোদনার মাধ্যমে টাকা চলে গেছে মুষ্টিমেয় একটা শ্রেণির হাতে। কৃষক বারবার গুনেছে ফসলের লোকসান। ঠিক এই সময়টাতেই চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়লো। চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, শিশুখাদ্য, শাকসবজি, মাছ-মাংস সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন করোনায় পরিবহন সংকটের কথা।

শ্রীলঙ্কায় দুর্ভিক্ষ লেগেছে। সেখানকার বাজার পরিস্থিতি মারাত্মক রকমের ভয়াবহ। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে চরম মাত্রায়। চাল, ডাল, চিনি থেকে শুরু করে শাকসবজি; এমনকি শিশুখাদ্য দুগ্ধজাত পণ্যের দাম মানুষের নাগালের বাইরে। বেড়েছে কেরোসিন তেলের দাম। গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। বিদেশ থেকে আমদানিতে সংকটে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে জরুরি অবস্থা চলমান রেখেছিল স্বয়ং রাষ্ট্রপক্ষ। হাত পাততে হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুয়ারে।

 শ্রীলঙ্কায় কিছু দিন যাবৎ যে জরুরি সংকট শুরু চলমান তার বিশেষ কারণ পুঁজিবাদ, মধ্যস্থ কারবারি। অর্থ চলে গেছে হাতেগোনা কিছু পুঁজিপতির কাছে। ফলে মানুষের আয়ের চেয়ে ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য হারায়। বিপরীতে মহামারি সংকটের অজুহাতে কৃত্রিম সমস্যা সৃষ্টি করেছে সেখানকার অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী। মজুতদারি এবং কালোবাজারি কবলে পড়েছে খাদ্য ব্যবস্থা। ঠিক করোনার পূর্ব দিনগুলোতে আমাদের লবণকাণ্ডের মতো, পেঁয়াজ সংকটের মতো। ফলে দিশেহারা হয়েছে খোদ রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
 
হঠাৎ করেই বাংলাদেশে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির উপযুক্ত কোনও কারণ হাজির করতে পারেনি ব্যবসায়ী কর্তৃপক্ষ। বরাবরের মতো কৃত্রিম সংকট, সরবরাহে ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলেছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো। অস্বস্তিতে পড়েছে সরকারও। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির কথা চাউর হলেও আসলে তা সত্যি নয়। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম আমাদের চেয়ে অনেক কম। আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতেই বা বৃদ্ধি পাবে কেন! হঠাৎ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কোনও খরচ কি বেড়েছে? আর আন্তর্জাতিক দোহাই দিয়ে বৃদ্ধির কারণ ব্যবসায়ীরা দেখিয়েই যখন থাকবে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তারা কি স্বেচ্ছায় কখনও দাম কমিয়েছে! পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, আমদানি শুল্কে ছাড় এবং ভর্তুকি দিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঠেকাতে দেশে কী পরিমাণ ধান হয়, ওই ধান থেকে কী পরিমাণ চাল উৎপাদন হতে পারে, মিল মালিকদের গুদামের ও নিত্যপণ্যের মজুতদারির হিসাব-নিকাশ এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। জরুরি হয়ে পড়েছে মিল মালিকেরা ধান কত দামে ক্রয় করেছিল এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে কত খরচ হয়েছে সেই হিসাব-নিকাশের।

খাদ্যের অভাবে এই পৃথিবীতে কখনও পণ্যের দাম বাড়াতে হয়নি, সংকট লাগেনি। সংকট লেগেছে মজুতদারদের মজুতদারিতে, আড়তদারিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহামারি পরবর্তী আমরা দেখেছি, পৃথিবীজুড়ে একদিকে মানুষ না খেয়ে কঙ্কাল হয়ে মরলো, আরেক দিকে মজুতদার কোম্পানি করলো তাদের পণ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ। ৪৩ এবং ৭৪-এর সংকটময় পরিস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এমনকি মজুতদারির কালো প্রভাবের শিকার হয়েছি করোনার আগেই। লোনা পানির দেশে কৃত্রিম সংকট এবং গুজব ছড়িয়ে লবণকাণ্ড ঘটিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফা সৃষ্টির চেষ্টা সবারই মনে থাকার কথা। পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে কীভাবে বিপর্যয় নেমে এলো সেটা মজুতদারির জলজ্যান্ত প্রমাণ। বর্তমানে একদিকে করোনা মহামারি, একদিকে ডেঙ্গুর ছোবল, আরেকদিকে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। এর একমাত্র কারণ আয় কমে সবকিছুর দাম বাড়ায় অর্থ কুক্ষিগত হয়েছে পুঁজিপতির ঘরে। অসাধু ব্যবসায়ীরাও অতিরিক্ত মুনাফার লোভ সামলাতে পারছেন না। বিপরীতে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া লোকজন।

মহামারিকালীন এবং তার পরবর্তী পৃথিবী অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আয় এবং ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে না পারলে শ্রীলঙ্কার মতো অশুভ দিনের মুখোমুখি হতে পারে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য সাধারণ মানুষের অধিকার। টিসিবি পণ্যের সহজলভ্যতা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করে বাংলাদেশে দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি শক্ত হাতে দমন এখন সময়ের প্রয়োজন। পৃথিবীর নাজুক পরিস্থিতিতে কৃষকদের বাঁচিয়ে কৃষিতে মনোযোগী হলে একদিকে যেমন খাদ্যে জোগান আসবে, ঠিক অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকটজনক সামঞ্জস্যহীনতা মোকাবিলা সম্ভব। নতুবা আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে চরম বিপর্যয়। শুধু দরকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।

লেখক: প্রাবন্ধিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ