X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি কোনও মিথ?

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:৫১আপডেট : ১৮ জুন ২০২২, ১৮:৩৫

ব্রিটিশ শাসন গাঁড়ার আগে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলায় হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল। আমি এ কথা অনেকবার শুনেছি, আবার ইতিহাসের দোহাই দিয়েও এ কথা বলা হয়। কিন্তু উত্তর আফ্রিকার বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘আর-রেহলা’তে চতুর্দশ শতকের পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে বর্ণনা প্রদান করেছেন, তা তো রীতিমত ভয়াবহ!

তবে হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষেও ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। ভিনদেশি মুসলিম, যারা বাংলা শাসন করেছিলেন, তাদের রক্ষণশীলতা ও নাক উঁচু ভাব এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের বর্ণবাদী আচরণ সত্ত্বেও পীর ও আউলিয়াদের ধর্ম প্রচার এবং যারা হিন্দু ও বৌদ্ধ থেকে মুসলিম হয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক মেলামেশার কারণে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুন্দর পরিবেশ না হলেও, সহনীয় একটি পরিবেশ ছিল বলে অনুমান করার যৌক্তিক ভিত্তি আছে।

এই সম্প্রীতির বয়ান আমরা পাই বাউল শাহ আবদুল করিমের গানে, যে গানে বলা হয়েছে, “গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান,/ মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম,/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।/ হিন্দুগো বাড়িতে যাত্রা গান হইত/ নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...” সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চর্চার প্রতিফলন শুধু জারিগান ও সারিগান নয়, যাত্রাপালা, কবিতা ও নাটকেও রয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ কলোনিয়াল মাস্টারদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির কারণে হিন্দু-মুসলমানের দূরত্ব ও পারস্পরিক বিদ্বেষ বেড়েছে। দ্বিজাতি তত্ত্ব সেই বিদ্বেষের আগুনে জ্বালানি সরবরাহ করেছে নিরন্তর। পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার কাজে। এখনও অনেকের চেতনায় বাস করে সেই পাক জমিনের খোয়াব!

গোঁড়ামি, মুসলিম ও হিন্দু জঙ্গিবাদের প্রসার ও নানা ঘটনার ধারাবাহিক ক্রিয়া ও মিথস্ত্রিয়ায় বাংলাদেশি মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মনোজগতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে ধর্মের সংকীর্ণ বোধ। এই কূপমণ্ডূকতাকে ভেঙেচুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ও উদার মানবিক বোধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, সৃজনশীল সাহিত্য এবং মানবিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রয়োজন, সেটি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্র-নজরুল ছাঁটাইকরণ প্রকল্প। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাদ দিলে বাঙালির থাকে কি?

কয়েক মাস আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজার সময়ে পূজামণ্ডপ ও কয়েকটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা হয়েছে সেটি ছিল নজিরবিহীন, ও মর্মান্তিক। এছাড়া ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ও ৪৭ থেকে ৭১ সময়কালে বিপুল সংখ্যক হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। দেশভাগের সময়ে অনেক মুসলমানও ভারত থেকে বাংলাদেশে (অথবা পাকিস্তানে) চলে আসেন। এরপর ৮০-এর দশক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিদ্বেষ, অর্পিত সম্পত্তি আইন, প্রভাবশালীদের দ্বারা স্থানীয় পর্যায়ে হিন্দুদের জমিজমা দখলের কারণে অনেক হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করতে শুরু করেন। মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের; অথচ ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশে নেমে আসে, এবং ২০১১ সালে এসে সেটি দাড়ায় ৮.৫ শতাংশে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো বাংলাদেশ নানা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায়ের মতো বহুত্ববাদী সমাজ নয়। বাংলাদেশে ৮৯ শতাংশ মুসলিম, ও ৯ শতাংশ হিন্দুসহ বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী, ও দলিত সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও এটি ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক ও একই ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চার কারণে একটি ‘হোমোজেনাস’ বা সমধর্মী সমাজ। কিন্তু হিন্দু-মুসলিমের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মকেন্দ্রিক জীবনাচরণের কারণে বাংলাদেশ এবং ভারতের সমাজ সংগঠনের গভীরে এক ধরনের ‘ইন-বিল্ট’ বিভক্তি কয়েক শ’ বছর আগেও ছিল, এখনও আছে বলে মনে করার পক্ষে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত আছে।

তবে এটিও উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারতে, এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে ৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে পরিকল্পিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের চেতনা ও ভিত্তি ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়, আর  ভারতে এখন সেই একই ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। যাই হোক, ধর্মকেন্দ্রিক গোঁড়ামির কারণে বাংলাদেশ এবং ভারতের সমাজ সংগঠনের গভীরে হিন্দু-মুসলিমের পরস্পরের প্রতি যে ‘ইন-বিল্ট’ ঘৃণা, ও বিদ্বেষ আছে, তারই সমর্থন মিলছে ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বৃন্তান্তে।

ইবনে বতুতা বর্ণিত বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘মুসলমানদের ধর্মের গোঁড়ামি যেমন হিন্দুদের তাদের প্রতি বিমুখ করেছিল, হিন্দুদের সামাজিক গোঁড়ামিও মুসলমানদের তাদের প্রতি সেরূপ বিমুখ করেছিল। হিন্দুরা মুসলমানদের অস্পৃশ্য, ম্লেচ্ছ, যবন বলে ঘৃণা করতো, তাদের সঙ্গে কোনও সামাজিক বন্ধন রাখতো না। গৃহের অভ্যন্তরে তাদের প্রবেশ করতে দিতো না, তাদের স্পৃষ্ট কোনও জিনিস ব্যবহার করতো না। তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি চাইলে বাসন অপবিত্র হবে বলে হিন্দু তা দেয় না, ইবনে বতুতা এরূপ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তার সপক্ষে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে হিন্দুরা যেমন নিজেদের আচরণ সমর্থন করতো, মুসলমানরাও তেমনি শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংসের কাজ সমর্থন করত। বস্তুত উভয় পক্ষের আচরণের মূল কারণ একই যুক্তি ও বিচার নিরপেক্ষ ধর্মান্ধতা কিন্তু ন্যায্য, হোক বা অন্যায্য হোক পরস্পরের প্রতি এরূপ আচরণ যে উভয়ের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপনের দুস্তর বাধা সৃষ্টি করেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক দিন ধরে অভ্যস্ত হলে অত্যাচারও গা-সওয়া হয়ে যায়, যেমন- সতীদাহ বা অন্যান্য নিষ্ঠুর প্রথাও হিন্দুর মনে একসময়ে কোনও বিকার আনতে পারতো না। হিন্দু-মুসলমান ও তেমনি এসব সত্ত্বেও পাশাপাশি বাস করেছে কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃভাব তো দূরের কথা, স্থায়ী প্রীতির বন্ধনও প্রকৃতরূপে স্থাপিত হয়নি।’ (রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, পৃষ্ঠা- ৩২৪, ৩২৫। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন সম্প্রতি তার এক কলামেও এ তথ্য উদ্ধৃত করেন)।

ছয়শ’ বছর আগে চতুর্দশ শতকে হিন্দু-মুসলিমের পারস্পরিক সম্পর্কের যে বিবরণ ইবনে বতুতা দিয়েছেন, সেটি ছিল বিদ্বেষ, বৈরিতা ও ঘৃণার। এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান, যেটি একদার অবিভক্ত ভারত, সেখানে এই বৈরিতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা কতটা হ্রাস পেয়েছে? একশ’ বছর আগেও নজরুল হিন্দু নারী প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এবং কৃষণ চন্দরের ‘গাদ্দার’-এও আমরা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মর্মান্তিক বর্ণনা পাই। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কারণে মহাত্মা গান্ধী অবিভক্ত ভারত প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সুভাষ বসুও আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে অবিভক্ত ও অসাম্প্রদায়িক ভারত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ‘দ্বি-জাতি’ তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভাজন যখন অনিবার্য, তখন সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু ও আবুল হাসিমরা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরা নিয়ে বৃহত্তর বাংলা গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

শত বছর ধরে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে যে বৈরিতা ও বিদ্বেষ ছিল এবং আছে, তা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে ভারতে, এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে এটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেহরু ও মাওলানা আজাদসহ একদল পরিপক্ব নেতা, বাংলাদেশে এটির নেতৃত্বে ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভারতে বেশ কয়েক দশক ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হলেও, বাংলাদেশে সেটি বেশি দিন করা যায়নি। তবে বাংলাদেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ায়, নানা প্রতিকূলতা ও আপস সত্ত্বেও এই চেতনাটি এখনও জারি আছে।

অস্বীকার করা যাবে না, ৬০, ৭০, এমন কি ৮০-এর দশকেও বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনাটি যতটা শক্তিশালী ছিল, এখন চেতনার সেই জোরও নেই, চেতনার সমর্থকদের সংখ্যাও কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। তবে জোর দিয়ে বলতে চাই যে, ভারত ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোজগতে ধর্মীয় গোঁড়ামি জারি থাকলেও, রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং শিক্ষা, ও সংস্কৃতির চর্চায় মানবিক বোধ, ও বিজ্ঞান-মনস্কতার কোনও বিকল্প নেই। ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে ঠিক রেখে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও মানবিক বোধে পূর্ণ সংস্কৃতির চর্চাকে শক্তিশালী করা গেলে জঙ্গিবাদ দুর্বল হবে বা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদ শক্তিশালী হলে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল চেতনা– ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিরন্তর ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকবে।  

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ