X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঢাবিতে শুধু আসনই নয়, কমাতে হবে বিভাগও’

কাবিল সাদি
০৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:২৪আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:২৫

কাবিল সাদি সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির আসন সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত ১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবকাঠামোগত মহাপরিকল্পনার আগে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে সূত্রেই আসন কমানোর কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।

বিষয়টি নিয়ে পক্ষে- বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন অনেক শিক্ষা অনুরাগী, শিক্ষাবিদ, ছাত্র-শিক্ষক এমনকি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরাও।

যদিও এই সময়ে এসে এমন পরিকল্পনা অনেকের কাছে কিছুটা বিভ্রান্তিকর অথবা অন্তর্নিহিত কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেই পারেন। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আসন সংখ্যা কমানোর পেছনের কারণগুলো মতামত বিশ্লেষণে অত্যন্ত যৌক্তিক এতে কোনও সন্দেহ নেই। এই চিন্তাও হয়তো সাম্প্রতিক নয়, তবে নানা কারণেই এই সংস্কারের চিন্তা আলোর মুখ দেখেনি। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের অনেকেই এখনও হয়তো এই সংস্কার পরিকল্পনা মানবেন না বা মানতে চাইবেন না। তারাসহ বাম ঘরানার অনেক ছাত্র সংগঠন বা এই ধারার অনেক শিক্ষকও এর বিরোধিতা এখন থেকেই শুরু করবেন ‘শিক্ষার পথ সংকুচিত করা হবে’ এই বিষয়কে সামনে রেখে।

আমি এই মতামতের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম আজ থেকে আরও এক দশক আগে। বিভাগীয় পাঠের অংশ হিসেবে মাঠ গবেষণার কাজে আমার বিভাগের প্রয়াত একজন অধ্যাপকের সঙ্গে (প্রয়াত হওয়ায় তার নাম উল্লেখ সমীচীন মনে করছি না) এই প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি শ্রদ্ধেয় স্যারকে বললাম, আমাদের দেশে একসময়  গুরুত্ব থাকলেও এখন আর উর্দু-ফার্সির সেভাবে প্রচলন নেই, একইভাবে পালি, সংস্কৃতের প্রায়োগিক জায়গা বা প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে। তাছাড়া এগুলো শুরুতে একীভূত বিভাগ ছিল; বিশেষ করে উর্দু ও ফারসি এক বিভাগ এবং বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত। সে ক্ষেত্রে এই বিভাগগুলোর চাহিদা না বাড়লেও বিশেষ কিছু কারণে হয়তো বাড়ানো হয়েছে। এখন তো সেগুলো একীভূত করে আবার আসন সংখ্যা অর্ধেকে আনা যায়। কিন্তু তিনি আজকের বিশেষজ্ঞদের মতোই বললেন, উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হবে এবং আমাকে ভর্ৎসনাও করলেন এমন চিন্তার জন্য। কিন্তু আমি তাকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারলাম না যে যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের মান বৃদ্ধি না পেয়ে আরও সংকুচিত হচ্ছে তার কী হবে।

তাছাড়া সব শ্রেণির মেধাবীই কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। উচ্চ শিক্ষার জন্য আরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি একই মানে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রতিযোগিতা করে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঐতিহ্য বা স্বাতন্ত্র্য কোথায়, কেন আমরা তাকে নিয়ে আলাদাভাবে গর্ব করবো। যাহোক, সেই আলোচনা আর এগোয়নি আর আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের কেউ নই, বরং একজন নবীন শিক্ষার্থী। তাই এই আলোচনা সংস্কার টেবিলে যায়নি বা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

তবে দেরিতে হলেও এই বিষয় নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাসহ আসন কমানোর কারণগুলো যেহেতু যৌক্তিক এবং ইতোমধ্যে কম/বেশি সবাই জানেন, তাই এ নিয়ে নতুন করে আর আলোচনায় না গিয়ে বরং এই আসন সংখ্যা হ্রাস করলেই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য  তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষায় সফল হবে কিনা সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি।

এই যে এক হাজার আসন কমানোর কথা বলা হচ্ছে এটাই কি মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দেবে? যেখানে বছর বছর নামে বেনামে নতুন বিভাগ আমদানি হচ্ছে সেখানে আগামী দশ বছরে এই এক হাজার আসনের বিপরীতে নতুন এক হাজার যোগ হয়ে আগের সংখ্যায় ফিরে যাবে। গত এক দশকের পরিসংখ্যান দেখলেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে অবকাঠামো ব্যবস্থার উন্নয়ন না করেই নামসর্বস্ব অনেক বিভাগ খোলা হয়েছে। যদি উদাহরণ স্বরূপ শুধু প্রিন্টিং অ্যান্ড বাইন্ডিং বিভাগের কথাই ধরি তাহলে প্রকৃত অবস্থা সহজেই অনুমেয় হবে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিশ্বের অনেক ভাষার বিভিন্ন মেয়াদি ভাষা কোর্স চালু আছে সেখানে জাপানিজ স্টাডি নামে আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে এবং আশা করা যায় আগামী এক দশকে চাইনিজ, ফ্রেঞ্চ, হিন্দি, স্পেনিশ বা রুশ ভাষার মতো আরও কিছু ভাষার আলাদা বিভাগের যাত্রা শুরু হবে।

প্রথমে অল্প সংখ্যক আসন নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও দুয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে যায়; সেই ক্ষেত্রে যুক্ত হবে আরও হাজার খানেক আসন। তখন হয়তো তাদের জায়গা দিতে পুরাতন বিভাগের আসন কমানোর দিকে নজর দেওয়া হবে কিন্তু প্রকৃত যে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে তা সেই শুভঙ্করের ফাঁকিই রয়ে যাবে।

অনেকেই এর পেছনের যুক্তি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা খুঁজবেন, বৈশ্বিক শিক্ষার উদারতার কথা বলবেন, কিন্তু অবকাঠামোগত সেই সক্ষমতা নেই তা কেউ স্বীকার করতে চাইবেন না। এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকা সত্ত্বেও আবাসিক হলে একই রুমে ১০-১৫ জন থাকছেন অথচ থাকার কথা বা অবকাঠামো নির্মিত ৪ জনের।

একই অবস্থা লাইব্রেরিতেও। বিভিন্ন প্রতিবেদন বা সংবাদমাধ্যমে সে কথা উঠে এসেছে বারবার। এমনকি শুধু পড়ার জন্য একটি সিট পেতে লাইব্রেরি বা হলের রিডিং রুমে এখনও নিত্যদিন মারামারি পর্যন্ত হয়, যা হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে তা মর্মান্তিক বা লজ্জাকর বার্তাই আমরা পাই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান আবাসন সক্ষমতা, একাডেমিক পরিসর, ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ও গবেষণার সুবিধা বিবেচনায় না নিয়েই অপরিকল্পিতভাবে কিছু বিভাগ খুলে সেগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়েছে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া এখনও চলমান।

বিভাগীয় প্রধান হওয়ার বাসনা নিয়ে অথবা ক্ষমতাসীন যখন যে সরকার থাকে তার অনুসারী কিছু শিক্ষক তাদের শিক্ষক সমিতির ভোটার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নতুন বিভাগ করে শিক্ষক নিয়োগ দেন, এমন কথাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বারবার। অন্যদিকে শিক্ষকদের একটি বড় অংশেরই নজর সান্ধ্যকালীন কোর্সের পরিধি বাড়ানোর দিকে, যা মূলত শিক্ষা সেবার নামে শিক্ষা বাণিজ্য বললেও অতিরিক্ত বলা হবে না।

এসব পদক্ষেপের আদৌ কোনও যৌক্তিকতা নেই অন্তত এই অপ্রতুল অবকাঠামো নিয়ে শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়টির। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; বরং দেশের ভাষার অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের অগ্রনায়ক।

তাই, মানসম্মত শিক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে শুধু শিক্ষার্থী ভর্তির আসন সংখ্যা কমানোই একমাত্র সমাধান নয়, বরং ব্যক্তিস্বার্থে নতুন বিভাগ সৃষ্টি বা বিভাগ বাণিজ্য, সাদা-লাল-নীলের ভোটার বাড়াতে রাজনৈতিক বিবেচনায় দক্ষতা ও যোগ্যতাহীন শিক্ষক নিয়োগও বন্ধ করে নতুন আবাসন বৃদ্ধিসহ শিক্ষার্থীদের গবেষণার ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহ্যের বাকিটুকুও হারিয়ে ফেলবে বলে আমি মনে করি।


লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা।

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ