X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. সেলিম হতে পারতেন এক দুর্দান্ত ‘মোটিভেশন-বিক্রেতা’

ডা. জাহেদ উর রহমান
০৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:৩৫আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:৩৫
ডা. জাহেদ উর রহমান খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) শিক্ষক ড. সেলিম আবার আলোচনায় এলেন। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী অভিযোগে ৪৪ জন ছাত্রকে নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়ার খবর কয়েক দিন আগে এসেছে আমাদের সামনে। খবরটি দেখে মুহূর্তেই স্মৃতিতে চলে এসেছিল তার মর্মান্তিক মৃত্যুর সময়টির কথা।

ড. সেলিমের বাবার নাম শুক্কুর আলী। নাম নিয়ে আমাদের এক ধরনের স্টেরিওটাইপ ধারণা থাকে। নাম ব্যক্তির আর্থসামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা দেয়, অন্তত আমরা অনেকেই মনে করি তেমনটা। লজ্জিত বোধ করলেও কথাটা আমি স্বীকার করছি– জনাব সেলিমের বাবার নাম জেনে আমার মনে হয়েছিল তিনি একজন প্রান্তিক মানুষ। তাই কৌতূহলবশত এই সংক্রান্ত খবর প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খুঁজেছিলাম।

কয়েকটি খবরে সেলিমের বাবাকে অকপটে বলতে দেখেছি, তিনি গরিব মানুষ, নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেটিকে লেখাপড়া করাতে চেষ্টা করেছিলেন। এরপর দেশের একটি পত্রিকা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিল আরও অবিশ্বাস্য এক সংগ্রামের গল্প। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

কুয়েটের শিক্ষক ড. সেলিমকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী এবং বাবা-মা। খুব বেশি দিন পার হয়নি, তাই আশা করি ঘটনাটি আমাদের মনে আছে। তবু আবার একটু সংক্ষেপে বলে নিই।

কুয়েটের একটি হলের প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক ড. সেলিম। সেই হলের ডাইনিংয়ে নিজেদের পছন্দের ম্যানেজার দেওয়ার জন্য ড. সেলিমের ওপরে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ। একদিন সেলিম বেরিয়ে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের একদল কর্মী তাকে চাপ দিয়ে ধরে তার রুমে নিয়ে যায়। আধঘণ্টার বেশি সময় পর তিনি বেরিয়ে যান।  ঘটনাগুলো আমরা দেখেছি সিসি ক্যামেরায় রেকর্ডকৃত ভিডিওতে। রুমের ভেতর যেহেতু সিসি ক্যামেরা ছিল না, তাই আমরা জানি না সেখানে কী হয়েছে। তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা দেবে।

বাসায় ফিরে সেলিম ভীষণ মন খারাপ করে তার চিরায়ত অভ্যাস, আদরের কন্যাটিকে আদর না করে বাথরুমে চলে যান। সেখানেই দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে বের হচ্ছেন না দেখে একপর্যায়ে তার স্ত্রী দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করে ভেতরে ঢুকে দেখেন তিনি প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে আছেন। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমে তার ওপর কী হয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই আমরা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করতে পারছি।

জনাব সেলিমের মৃত্যুর পেছনে যে ছাত্রলীগের দায় আছে সেটা স্পষ্ট হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং এর ভিত্তিতে নেওয়া পদক্ষেপেও। ৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ চার জনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। এদেরসহ বিভিন্ন রকম শাস্তি দেওয়া হয়েছে মোট ৪৪ জনকে।

এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কুয়েট ছাত্রলীগের পরিকল্পনা ছিল না জনাব সেলিমকে হত্যা করার। কিন্তু সেলিমের বিরুদ্ধে করা তাদের ভীষণ অন্যায় আচরণের প্রভাবে তার এই মৃত্যু হয়েছে। এটাও ফৌজদারি অপরাধ, যেটাকে বলা হয় ‘কাল্পেবল হোমিসাইড’। এটাও সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার মতো বড় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পরিবারের সদস্যকে হারানো তীব্র আবেগ আপ্লুত ড. সেলিমের পরিবারের সদস্যদের মতো এটাকে সরাসরি হত্যা আমি বলছি না, কিন্তু এটাও তার কাছাকাছি একটা ব্যাপার এটা মোটামুটি নিশ্চিত।  ন্যূনতম আইনের শাসন থাকা দেশে শুধু বহিষ্কারেই থেমে থাকতো না, ফৌজদারি মামলা চলে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হতো।

আসা যাক ড. সেলিমের পরিবারের সংগ্রামের কথায়। এক জাতীয় পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারি, জনাব সেলিমকে পড়াশোনা করানোর জন্য বাবা তার সর্বস্ব বিনিয়োগ করেছিলেন। সেলিম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালে শেষ দুই বছর তার বাবা শুকুর আলী ঘরের কাঁসার ঘটিবাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও পেরে ওঠেননি পুরোপুরি। একটা পর্যায়ে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য গার্মেন্টে চাকরি নেন তার দুই বোন তার শিউলি ও শ্যামলি।

এই দরিদ্র পরিবারটির অবিশ্বাস্য লড়াই ব্যর্থ হয়নি। সফল হয়েছিল, সত্যি বলতে এতটাই সফল হয়েছিল যতটা সফল হয় না অনেক সামর্থ্যবান পরিবারের ক্ষেত্রেও। সেলিম একজন প্রকৌশলী তো হয়েছিলেনই, দুর্দান্ত ফলাফল করে হয়েছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এবং পরে অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরে চালিয়ে যাচ্ছিলেন তার অসাধারণ সফল ক্যারিয়ার। অধ্যাপক হয়েছিলেন। হয়েছিলেন একটি হলের প্রভোস্টও।

আমাদের দেশের একসময়কার বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমায় দেখা যেত নায়ক ভীষণ প্রান্তিক অবস্থা থেকে দুর্দান্ত পড়াশোনা করে সামাজিকভাবে অসাধারণ প্রতিষ্ঠিত হন। এসব নিয়ে আমরা সমালোচনা করি, কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এটার জন্য আসলে উপযোগী ছিল না। এই দেশে পড়াশোনা করে ভালো ফলাফল করে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বহু দিন থেকেই যথেষ্ট ব্যয়বহুল একটি ব্যাপার। কিন্তু ড. সেলিম বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার সেই নায়কটিই হয়ে উঠেছিলেন।

একটা ব্যর্থ, হতাশাগ্রস্ত জাতির জন্য এক জরুরি ‘নেশা’ হচ্ছে যেকোনও মূল্যে আশার আলো দেখা। তাই ‘তুমিও পারবে’ ধরনের কথা বলে যে কাউকে যেকোনও পরিস্থিতি থেকে অসাধারণ বড় কিছু হবার মোটিভেশন দেওয়ার বাজার খুব ভালো। এমন বহু  ‘মোটিভেশন-বিক্রেতা’ বিরাট সেলিব্রেটি এই সামাজিকমাধ্যমের যুগে। ড. সেলিম হতেই পারতেন অসাধারণ মোটিভেশন-বিক্রেতা।

এক কন্যা নিয়ে সেলিম দম্পতির সুখের সংসার ছিল। শুধু তা-ই নয়, যে পরিবারটি থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন, যে পরিবারটির সর্বস্ব ত্যাগের বিনিময় তিনি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন, সেই পরিবারটিকে আগলে রেখেছিলেন তিনি।  চাকরি পাবার সঙ্গে সঙ্গে দুই বোনকে গার্মেন্টসের চাকরি থেকে নিয়ে আসেন, বিয়ে দেন। গ্রামে বাড়ি করছিলেন তিনি। প্রায় পুরো নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি নিয়ে গুরুতর অসুস্থ বাবার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করছিলেন তিনি।

একটা মৃত্যু কখনোই শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু না। সেলিমের মৃত্যুতে আমরা হয়তো আফসোস করছি তাকে নিয়ে। আমরা কি ভেবে দেখি তার যে শিশুকন্যা বেড়ে উঠছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার মতো একটি পরিবেশে, তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে? বাবা তার জীবনে যেমন ছায়া হয়ে থাকার কথা, সেই ছায়া কি দিতে পারবে আর কেউ?

সেলিমের ভীষণ অসুস্থ বাবার সামনে অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা। তার কিডনি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যাবে পুরোপুরি। তাকে তখন ডায়ালাইসিস কিংবা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসার কথা ভাবতে হবে। আদৌ কি আর সম্ভব সেসব এখন? যে বোনেরা ভাইয়ের পড়াশোনার জন্য গার্মেন্টে কাজ নিয়েছিলেন, সেই বোনদের নিজস্ব পরিবার হয়েছে। কিন্তু এই ভাইটি তাদের জন্য হয়ে থাকবার কথা ছিল এক বড় আশ্রয়ের জায়গা, যা আর থাকলো না।

ড. সেলিম মোটিভেশন ফেরি করে বেড়াননি। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তার বহু ছাত্র তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হতো নিশ্চয়ই আরও অনেকে। এক অসাধারণ সফল লড়াই দেখা থেকে বঞ্চিত হলো আরও কত ছাত্র।

ড. সেলিমের মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু না। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে ভীষণ প্রান্তিক একটি পরিবারের তিল তিল করে গড়ে তোলা অসাধারণ লড়াইয়েরও। একজন প্রতিভাবান সন্তানকে আঁকড়ে ধরে, অবলম্বন করে সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। আহা!
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ