X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মনুষ্য সমাজে একজন হিরো আলমের কথা

ডা. জাহেদ উর রহমান
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৫২আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৫২

ডা. জাহেদ উর রহমান হিরো আলম আলোচনায় আসেন, আলোচনায় থাকেন প্রায় নিয়মিত বিরতিতেই। কখনও তিনি সিনেমা বানিয়ে আবার কখনও নানা ভাষার ভাইরাল গান নিজে গেয়ে আলোচনায় আসেন। সম্প্রতি আবার এসেছেন আলোচনায়। সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়ে আলোচনায় এলেন, সেটা দেখে আমার মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগের একটি ঘটনা।

একাদশ সংসদ নির্বাচন তখন সামনে। আমাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, হিরো আলম সেই নির্বাচনে একজন প্রার্থী ছিলেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ করেছিলেন এবং একপর্যায়ে আদালতে যাবার কথা জানিয়েছিলেন।

একটি টকশোতে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিবের সঙ্গে আমি আলোচনায় উপস্থিত ছিলাম। সেই টকশোতে সচিব একটা পর্যায়ে বলেন, ‘এমনকি হিরো আলমও তাদের মামলার ভয় দেখাচ্ছে’। তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম তখন। বলেছিলাম– হিরো আলম এই দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক, আর সব নাগরিকের সমান সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকার আছে।  কোনও ক্ষেত্রে তার অধিকার হরণ করা হয়েছে মনে করলে তিনি যে কারও বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারেন। হতেই পারে সেটা নির্বাচন কমিশনও। তখন আরও বলেছিলাম, কলোনিয়াল হ্যাংওভারে আক্রান্ত আমলারা বোধকরি টেরই পান না ব্রিটিশরা তো গেছেই, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েও সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন হয়েছে।

সম্প্রতি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে তিনি আলোচনায় আসলেন। হিরো আলমকে সেই সমিতিতে সদস্য করা হয়নি। হিরো আলম নিজের অর্থ খরচ করে ৫টি সিনেমা বানিয়েছেন, সেগুলোতে মূল চরিত্রে নিজেই অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের বয়ানেই জেনেছিলাম, সদস্য হবার শর্ত হচ্ছে কমপক্ষে পাঁচটি সিনেমায় (বিশেষ বিবেচনায় চারটি) উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করা। হিরো আলমের দাবি, তিনি সেই শর্ত পূরণ করেছেন, আমরাও সেই দাবির সত্যতা বুঝতে পারি নিশ্চয়ই। কিন্তু তাকে সেই সংস্থার সদস্য করা হয়নি। হিরো আলমের অধিকার দাবি করা এবং নাকচ করাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কিছু দিন আগে। এটা নিয়ে মূল ধারার মিডিয়ায় সংবাদ হয়েছিল।

সার্বিক পরিস্থিতিতে হিরো আলম কয়েক দিন আগে একটি ফেসবুক লাইভে এসে কিছু কথা বলেন এবং ঘোষণা দেন তিনি আর কখনও সিনেমা বানাবেন না। সেই লাইভে তিনি যা বলেছেন সেটাই মূলত এই কলাম লেখার কারণ। আগেও একই ধরনের কথা তিনি বলেছেন কিংবা আমরা আমাদের আশপাশের মানুষদের, কিংবা সামাজিক মাধ্যমে অনেককে সেরকম কথা বলতে শুনেছি।

হিরো আলম যেদিন থেকে এই জনপরিসরে আসেন সেদিন থেকেই তিনি আমাদের ‘ভদ্রলোক/সুশীল’দের কাছে অচ্ছুত হয়ে ছিলেন। হিরো আলমের মতো একেবারে অজপাড়াগাঁয়ের, অশিক্ষিত, দরিদ্র, অতি খর্বকায় সারা শরীরে এবং মুখে দীর্ঘকালীন তীব্র অপুষ্টির ছাপ থাকা, প্রমিত বাংলায় কথা বলতে না পারা একজন মানুষ শিল্পের রাজ্যে প্রবেশাধিকার চাইছে, আমরা মেনে নিতে পারিনি এটা।

আমরা যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত তারাই মোটামুটি নির্ধারণ করি কে শিল্প করতে পারবে, আর কে পারবে না। আমরা নির্ধারণ করি কারও করা কোনও কিছু শিল্প হচ্ছে কিংবা হচ্ছে না। আমরাই মূল্যায়ন করে বলি অমুকের শিল্প তমুকের শিল্পের চাইতে ভালো কিংবা খারাপ। আমাদের যাদের সামাজিক পুঁজি অনেক বেশি তারাই এসব ক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করি। আমাদের ভূমিকা শুধু নির্ধারক এসে শেষ হয় না।

খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যায়, আমরা যারা সব ক্ষেত্রের নির্ধারক বহু ক্ষেত্রেই তারা পালন করি আর্টের পুলিশের দায়িত্বও। আমরা সিদ্ধান্ত দিয়ে ক্ষান্ত হই না যে তোমার শিল্প হচ্ছে না কিংবা তোমার শিল্প নিচুমানের। আমরা ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাই যাকে আমরা শিল্পের রাজ্যে অচ্ছুত মনে করি।

হিরো আলমের ফেসবুক লাইভে তিনি জানান, বহু মানুষের মধ্যে বসে থাকা অবস্থায় তাকে জোরপূর্বক বের করে দেন একজন পরিচালক। শুধু সেটা নয়, হিরো আলম করেছেন আরও ভয়ংকর অভিযোগ।

মূল ধারার মিডিয়াতেই রিপোর্ট দেখেছি, এবার শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগে হিরো আলম যখনই এফডিসিতে গেছেন, তখনই বহু মানুষ তাকে ঘিরে ধরেছে। এমনকি ভিড়ের চাপে তিনি কিছুটা আহতও হয়েছিলেন। বহু মানুষের তার প্রতি আগ্রহ একেবারেই স্পষ্ট। তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার।

হিরো আলমের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ আমাদের সহ্য না হবারই কথা, হয়ওনি সেটা। মানুষ হিরো আলমের প্রতি কেন আগ্রহী এটারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই ‘ভদ্রলোক’ পরিচালক, যিনি হিরো আলমকে সভা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তার মতে, হিরো আলম ‘বানর’, যেহেতু তিনি খেলা দেখাবেন, তাই তার পেছনে এত মানুষ ঘোরে। এটা শুধু একজন পরিচালক বলেছেন ব্যাপারটা এমন নয়। হিরো আলমকে নিয়ে কোনও সংবাদের ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য পড়লে দেখা যায় তাকে এভাবে দেখি আমরা অসংখ্য মানুষ। যে ফেসবুক লাইভের কথা বললাম সেটা যে মূলধারার টিভি চ্যানেলের ফেসবুক পেইজ থেকে আমি দেখেছি তাতে ৫৮ হাজার রিঅ্যাকশনের মধ্যে ১৭ হাজার হা হা রিঅ্যাকশন।

সিনেমার, মিডিয়ার জগৎটা ভীষণ রঙিন, অন্তত বাইরে থেকে সেটা মনে হয়। সেই রঙিন জগৎ অনেককেই হাতছানি দিয়ে ডাকে, অনেকেই হয়ে ওঠেন মন্ত্রমুগ্ধ। জীবনে অনেক বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করে, ভীষণ বড় বাজি ধরে এই জগতে জায়গা করার চেষ্টার অনেক গল্প আমরা জানি। হিরো আলমের মতো আর্থসামাজিক অবস্থার, দৈহিক গঠনের একজন মানুষ এমন স্বপ্ন দেখবেন আর সেটা অর্জন করার জন্য লড়াই করবেন, এটা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু তিনি করেছেন।

এক ভদ্রলোক পরিচালকের দৃষ্টিতে হিরো আলম ‘বানর’। কিন্তু আমার কাছে হিরো আলম ভীষণ শক্তিমান একজন মানুষ। তিনি প্রচলিত চিন্তা, প্রচলিত সব মানদণ্ডকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সমাজে নিজের জায়গা করার লড়াই করেছেন। আমরা ভদ্রলোকেরা সর্বস্ব দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি, বের করে দিতে চেয়েছি তাকে।

সার্বিক পরিস্থিতিতে হিরো আলম স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্তবোধ করছেন। বিধাতার কাছে সামাজিক বৈষম্যের বিচার দিয়েছেন। সুশীল সমাজের প্রত্যাখ্যানের মুখে কেন তাকে গরিব এবং অসুন্দর করে বানিয়েছেন সেই অভিমান করেছেন স্রষ্টার কাছে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে সিনেমার জগৎ ছেড়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন। মজার ব্যাপার, কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই সিনেমা জগৎ ছেড়ে যাবার সংবাদ নিয়েও নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হয়েছে। অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তার উপদ্রব থেকে বাঁচলেন বলে।

হিরো আলমের সিনেমা আমার ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি তার কোন গানও। যেমন ভালো লাগেনি বহু ভদ্রলোক/সুশীল পরিচালকের সিনেমা কিংবা সংগীতশিল্পীর গান। হিরো আলমের সিনেমা কিংবা গান যাদের ভালো লাগে তারা দেখুক, শুনুক। সমাজে এই স্পেসটুকু লাগবেই। এটুকু না হলে তো এই সমাজ একেবারেই অসুস্থ।

আশা করি সিনেমা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত আবেগের বশে নিয়েছেন তিনি। আবারও তিনি ফিরে আসবেন এই জগতে। কিন্তু যদি কখনও আর তিনি ফিরে নাও আসেন, হিরো আলমের লড়াইটা আমাদের ইতিহাসে থেকে যাবে। ভদ্রলোকদের নিজেদের মতো করে তৈরি করা তাদের জন্য একটা আরামদায়ক বাস্তবতাকে একেবারে ভয়ংকরভাবে ভেঙেচুরে, দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ