X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন নির্বাচন কমিশন: শেখ হাসিনার দায় বেড়ে গেলো

স্বদেশ রায়
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:১৯আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৫১

স্বদেশ রায় রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন আমলা। বাকি চারজন কমিশনারের একজন বিচার বিভাগের অপর তিনজনের দুই জন বেসামরিক আমলা একজন সামরিক আমলা। সার্চ কমিটি যে নামের তালিকা প্রকাশ করেছিলো তা দেখে সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন, নির্বাচন কমিশন এমনই হবে। সেখানে বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের প্রাধান্য থাকবে। সত্য হলো এই দুই শ্রেণি ছাড়া বাকি সকল পেশার মানুষ ক্রমেই সমাজ থেকে অপসৃয়মান হয়ে যাচ্ছে। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে অপর পেশার মানুষরা। এমনকি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে যে রাজনীতিকরা তারাও যেন দিন দিন এই দুই শ্রেণির কাছে গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, আর রাষ্ট্র সমাজের জন্যে এটা কতখানি ভালো তা এ মুহূর্তে বিবেচনা করার সময় কারো হাতে নেই। তার ওপরে কোভিড-১৯ পরবর্তী জীবন শুরুর একটা তাগিদ তো আছে। তবে এ বিষয়টি পাকিস্তান আমলেও ঘটেছিলো।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একদিন আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, তাঁর জীবনের ইচ্ছে ছিল শিক্ষাকতা করার কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পরে জেলে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, জীবনে যদি ক্ষমতা ভোগ করতে হয় তাহলে সরকারি আমলা হতে হবে। আর সেখান থেকেই তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। তিনি সিএসপি পরীক্ষা দিয়ে জীবনের পরিবর্তন ঘটান। আবুল মাল আবদুল মুহিত পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান আমলে যেটা বুঝেছিলেন সেটা আবার এখনকার ছাত্ররা অনেক বেশি বুঝছে। কারণ, কোটা আন্দোলনের নামে বাংলাদেশে ছাত্রদের যে বড় আকারের আন্দোলন হয় ও সরকারকে তার দাবি মেনে নিতে হয়, তা ছিল মূলত সরকারি চাকরিতে যাওয়ার জন্যে আন্দোলন। যে আন্দোলনের ভয়াবহতা ও হিংস্রতা দেখে, শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, শুধুমাত্র সরকারি চাকরির জন্যে এভাবে রাস্তাঘাট বন্ধ করে ছাত্ররা আন্দোলন করতে পারে সেটা তিনি ভাবতে পারেন না।

বাস্তবে পাকিস্তান আমলের এই ধারাটি বদল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ষাটের দশকের আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর আন্দোলনটিকে আজ যতই শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন বলা হোক না কেন, তিনি মূলত নিজেকে ও দেশকে ষাটের দশকে একটা পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই মূলত তাঁর আন্দোলনের সামগ্রিক রূপ ছিল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের। যে কারণে এ সমাজের সকল স্তরের একটা উন্নয়ন ঘটেছিলো। মর্যাদাবান হয়ে উঠেছিলো প্রতিটি শ্রেণি ও পেশার মানুষ। দেশের সংস্কৃতি নিয়ে তখন সাংস্কৃতিক নেতারা কথা বলছেন বা ভাবছেন, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা নিয়ে শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিরা, মতপ্রকাশ নিয়ে সাংবাদিকরা। রাজনীতি নিয়ে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা। সব জ্ঞান, সব যোগ্যতা তখন রাষ্ট্রক্ষমতার অধিষ্ঠিত পদের থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি বের করে এনেছিলেন। আর জনগোষ্ঠীর তেমন একটি অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিলো। কিন্তু সত্য হলো, স্বাধীনতার পরে থেকে নানান পেশা ও শ্রেণির লোভের ফলে ওই সমাজের একটু একটু করে মৃত্যু ঘটতে থাকে।  এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে যে উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছে তার থেকে আর দেশকে ফেরানো হয়নি বা হবারও কোনও সুযোগ নেই। জাতিকে ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

তবে এ মুহূর্তের সব থেকে বড় বিষয় হলো এই নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশের এ মুহূর্তের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা তাতে কেউ-ই জোর করে বলতে পারবেন না যে এই নির্বাচন কমিশন না হয়েও যদি অন্য নির্বাচন কমিশন হতো- তাহলে তাদেরকে সব রাজনৈতিক দল মেনে নিতো। এবং তাদের অধীনে নির্বাচনে যেতো। তবে তারপরেও একটা বিষয়, যা বাংলা ট্রিবিউনে আগেও লিখেছি বা সার্চ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা কালে বলেছিলাম;  এবারের সার্চ কমিটিতে যেহেতু দেশের একটি বড় দল বিএনপি, সব থেকে প্রাচীন দল কমিউনিস্ট পার্টি সহ বেশ কিছু দল আসছে না। তাই লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি বিষয় অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সে বিষয়টি হলো, নির্বাচন কমিশনে এমন মানুষ দিতে হবে যাদের সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চরিত্র ও দক্ষতা থাকে। তারা সেভাবে সবাইকে বুঝিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারবেন। জাতীয়ভাবে তাদের সে ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আছে।

যাহোক, তা ঘটেনি। বরং বর্তমানের নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দেখে ড. জাফরুল্লাহ বলেছেন সব দলকে এই নির্বাচন কমিশন মেনে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভালো করবেন।  কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে, ডা. জাফরুল্লাহর এই কথা হালে পানি পাবে না। কিন্তু এটা সত্য যে আগামীতে সব দলের অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া দেশে একান্ত দরকার। এ মুহূর্তে দেশের অনেকে এমনও মনে করেন যে, যেমন তেমন নির্বাচনের ভেতর দিয়ে একটা স্থিতিশীল সরকার হলেই বা কঠোর সরকার হলেই চলবে। এ মুহূর্তে দরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এই ধারণাটি দেশে এসেছে মূলত এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে গণতন্ত্রের মৃত্যুর ফলে এবং নানান আকৃতিতে নানান ধরনের স্বৈরতন্ত্রী সরকারের জন্মের ফলে।

কিন্তু এ সব স্বৈরতন্ত্রী সরকারের আমলে উন্নয়ন হয় ঠিকই তবে একদিকে ধীরে ধীরে দেশের সব ধরনের সামাজিক শক্তির মৃত্যু ঘটে অন্যদিকে কোনও বিরোধী দল না থাকায় দুর্নীতি একেবারে নিম্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে সরকারি দলে তখন সৎ রাজনীতিকের বদলে দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদীদের স্থান ওপরে উঠে যায়। যার শেষ পরিণতি দেশ থেকে রাজনীতি বিতাড়িত হওয়া।

তাই আগামী নির্বাচন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হতে হবে দেশের স্বার্থে। আর সে দায় এখন বাস্তবে গিয়ে পড়েছে শেখ হাসিনার ওপরে। গতবার যেমন তিনি সকল দলকে নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সবাইকে নির্বাচনে আনতে পেরেছিলেন, এবারও সে কাজ তাকে করতে হবে। গতবার অবশ্য শেখ হাসিনার জন্যে বিষয়টি কিছুটা হলেও সহজ করে দিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বিরোধী ঐক্যজোটের নেতা হওয়াতে সংলাপটি অনেক সহজে হয়েছিলো। কারণ, আর যাই হোক, ড. কামাল হোসেনের বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ট্রেনিং আছে। তিনি জানেন, রাজপথের থেকে গোলটেবিলও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজনীতি যেমন রাজপথে করতে হয় তেমনি আলোচনার টেবিলেও করতে হয়।

এবার বিএনপি কোনোরূপ ঐক্যজোটের মাধ্যমে নির্বাচনে যাবে নাকি এককভাবে যাবে তা অবশ্য এখনও তারা প্রকাশ করেনি। আর বিষয়টি এ মুহূর্তেরও নয়। ভবিষ্যতই বলে দেবে, কারা কীভাবে নির্বাচনে যাবে। তবে এটা ঠিক, আগামী নির্বাচনে সকলকে আবার কীভাবে সবাইকে এক টেবিলে বসাবেন,  সুন্দর পরিবেশে আলোচনার মধ্যদিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেখ হাসিনা সব দলকে নিয়ে নির্বাচনে যাবেন- সেটা এখন তাঁর ওপরই নির্ভর করছে। আর সেই কাজের ওপরই নির্ভর করছে  দেশের ভবিষ্যতে আরও ভালো গণতন্ত্রের পথে হাঁটা। কারণ, সকলকে মনে রাখতে হবে, একটি ভালো নির্বাচন অর্থাৎ ১৯৭০ এর নির্বাচন আর গণতন্ত্র এ দুটোই বাংলাদেশের অন্যতম ভিত। একে রক্ষা করতেই হবে।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে ১৭ মে বিক্ষোভ করবে ইসলামী আন্দোলন
স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে ১৭ মে বিক্ষোভ করবে ইসলামী আন্দোলন
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বাসদ
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বাসদ
কাল যুবদলের সমাবেশ, থাকবেন মির্জা ফখরুল
কাল যুবদলের সমাবেশ, থাকবেন মির্জা ফখরুল
নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ চলছে
নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ চলছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ