X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারী ও শিশুর সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

সৈয়দা রুবিনা আক্তার
০৮ মার্চ ২০২২, ২০:০৫আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ২০:০৫

সৈয়দা রুবিনা আক্তার ২০১৭ সালে যখন গ্লোবাল টোব্যাকো অ্যাটলাসের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তখন তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে নারীদের হার ছিল শতকরা ২৫.২ শতাংশ। ২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নানান উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে তামাক ব্যবহারকারী; বিশেষ করে ধূমপায়ীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। কিন্তু খোলা চোখে কেন যেন মনে হয়, নারী তামাক দ্রব্য ব্যবহারকারীদের জন্য আলাদা উদ্যোগ, আলাদা কর্মসূচির প্রয়োজন। পাশাপাশি, সার্বিকভাবে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারলে, উক্ত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে অনেক কিছুই সম্ভব কার্যকর ও সময়োপযোগী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধন করতে পারলে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং-এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাননীয় সংসদ সদস্যরা তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কাজ করছে।

আমি আশাবাদী, কেবল আইন সংশোধন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমেই পর্যায়ক্রমে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সম্ভব।

সংশোধিত আইনে কয়েকটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা জরুরি। এরমধ্যে উন্মুক্ত স্থানে (পাবলিক প্লেস) ধূমপান নিষিদ্ধ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ করা, ই-সিগারেট বাজারজাত বন্ধ করা, তামাকজাত পণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর আকার বাড়ানো, সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) নামে সিগারেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা এবং তামাকজাত দ্রব্য বিক্রির স্থানে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন বন্ধ করা উল্লেখযোগ্য।

তামাক নিয়ন্ত্রণের নানান দিকগুলোর পাশাপাশি নারী ও শিশুদের নিয়ে আলাদা করে ভাবা দরকার। আগে থেকেই ভৌগোলিক অবস্থান ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল। এ দেশের শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগে থাকেন। তার মধ্যে পরোক্ষ ধূমপান ও প্রত্যক্ষভাবে তামাক ব্যবহারকারী নারী ও শিশুদের আরও ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তামাক ব্যবহারের কারণে নারীদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অন্যান্য তামাকজনিত রোগের পাশাপাশি, জরায়ু ক্যানসারসহ, নারীদের গর্ভধারণ ক্ষমতা দ্রুত লোপ পায় ও ঋতুস্রাবের জটিলতা দেখা দেয়। এছাড়াও কম ওজনের বা মৃত শিশু জন্মদান, অকাল প্রসব এবং কম স্মৃতিসম্পন্ন সন্তান প্রসব করার সম্ভাবনাও তামাক সেবনের ফলে হতে পারে।

গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান না করেও বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্ষেত্রে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তার প্রমাণও মিলছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকী অনুযায়ী ‘‘বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার’ শীর্ষক এক জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকার ৯৫ শতাংশ শিশু কোনও না কোনোভাবে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। বছরে ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু (১৫ বছরের নিচে) পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগে ভুগছে। আর বিভিন্ন বয়সী মিলে বছরে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ (গ্যাটস, ২০১৭)।

অন্যদিকে, ধূমপানে নারীরা পুরুষদের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও; জর্দা ও গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারে নারীদের অংশগ্রহণের হার পুরুষদের চাইতে বেশি, যা অত্যন্ত ভীতিকর। উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা)- এর একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতকরা ২০.৬ ভাগ (২ কোটি ২০ লাখ)। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে বেশি (২৮%)। ধোঁয়াবিহীন তামাক কারখানায় শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৬ শতাংশ, যা নারী স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এক্ষেত্রে বারবার এ খাত থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয়ের কথা বলা হয়। তামাক কোম্পানিগুলো এই খাত থেকে বছরে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদানের কথা উল্লেখ করলেও তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার বিষয়টি বেমালুম চেপে যায়। বলা হয় লাখো বিড়ি শ্রমিকের কথাও।

প্রথমত, এই তথ্যের যেমন সঠিক কোনও ভিত্তি নেই; তেমনি নেই শ্রম আইনের বাস্তবায়ন। পাশাপাশি তামাক খাতে নারী শ্রমিকদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিও সেভাবে আমলে আসে না। সে কারণেই তামাকবিরোধী নানান ফোরামে আমরা বারবার বলে আসছি, যে খাত আমাদের মৃত্যুর কারণ; যে খাত আমাদের উন্নয়নের পথে বাধার শামিল; সেই খাত না থাকলে খুব বেশি কিছু আসে যায় না। বরং আমাদের এমন কোনও বিকল্প টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা করা উচিত, যার মাধ্যমে তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্ব আয়ের পরিমাণ আমরা পুষিয়ে নিতে পারি।  

আমাদের তামাকপণ্যের মোড়কের দিকে; বিশেষ করে সিগারেটের প্যাকেজিংয়ের দিকে কড়া নজর দিতে হবে। কোম্পানিগুলো যেন সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রকাশে গাফিলতি না করে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির মাধ্যমে শহরে ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তামাক সংশ্লিষ্টরা পরোক্ষভাবে তামাকের বিজ্ঞাপন করে। রেস্টুরেন্টসহ ট্রেন, বাস, লঞ্চ ইত্যাদি সব পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করা জরুরি। তবে নতুন ধূমপায়ী প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হবে খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধের মাধ্যমে। যারা ইতোমধ্যে ধূমপায়ী; তাদের চেয়ে যারা নতুন ধূমপায়ী হওয়ার পথে বা তামাক কোম্পানির ভাষায় ‘পটেনশিয়াল কাস্টমার’; তাদের আটকানোটা বেশি জরুরি।

বাংলাদেশ ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)- এ স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ, তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঠিক দিকনির্দেশনা ও দূরদর্শিতায় আমরা সে পথেই হাঁটছি। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি অনেক তামাকবিরোধী সংস্থা এ বিষয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। এর সবই আমাদের জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও ইতিবাচক পথেই হাঁটছে বলে আমি বিশ্বাস করি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরামের একটি আয়োজনে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী তামাক আইন সংশোধনের বিষয়ে একমত হয়েছেন। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলও (এনটিসিসি) আমাদের প্রস্তাবনায় একাত্মতা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, আমরা সবাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে কাজ করছি। কেবল দেখার বিষয়, সংশোধিত আইনে সব প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কিনা?

তাহলেই আমাদের সব চেষ্টা সফল হবে। তবে, কাঙ্ক্ষিত তামাক আইন সংশোধনের পর শতভাগ বাস্তবায়নেও নজর দিতে হবে।

লেখক: অ্যাডভোকেট; সংসদ সদস্য। (সদস্য, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং)

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত, যা জানা গেলো
নিউইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি যুবক নিহত, যা জানা গেলো
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৩৩ সদস্য আটক
বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রশংসা করলেন ডোনাল্ড লু
বাংলাদেশি আমেরিকানদের প্রশংসা করলেন ডোনাল্ড লু
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
মেটা-ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের ডিজিটাল সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ