X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাশিয়া বেলারুশ আর বাংলাদেশের রাজনীতির ‘ডিজিটাল মাঠ’

রুমিন ফারহানা
৩০ মার্চ ২০২২, ১৯:২৮আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২২, ২০:৪১

ইউক্রেনের ওপরে রাশিয়ার আগ্রাসন আমাদের সামনে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে রাশিয়ার রাজনীতি, তাদের কর্তৃত্ববাদের ধরন, মানবাধিকার হরণ, বিরোধী মতকে দমনের মতো বিষয়গুলো। এই সংকটে আলোচনায় আছে রাশিয়াকে অন্ধ সমর্থন দেওয়া, এমনকি ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে নিজের ভূমি ব্যবহার করতে দেওয়া বেলারুশও।

এই দেশটিও আসলে আরেক ‘রাশিয়া’ যার কর্তৃত্ববাদের ধরন, মানবাধিকার হরণ, বিরোধী মতকে দমনের কৌশল ঠিক রাশিয়ারই মতো।

দেশের আকার, অর্থনৈতিক আর সামরিক শক্তিতে রাশিয়া আর বেলারুশের পার্থক্য বিশাল, তাই রাশিয়ার পুতিন বৈশ্বিক পর্যায়েও যতটা ‘খেলতে’ পারেন, তার কাছাকাছিও পারেন না বেলারুশের লুকাশেঙ্কো। কিন্তু দেশের ভেতরে দুজনই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন দীর্ঘকাল। পুতিন ২২ আর লুকাশেঙ্কো ২৬ বছর ধরে আছেন ক্ষমতায়। শুধু তাই নয়, তাদের ক্ষমতার প্রতি তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জের ধরন এবং সেটাকে দমন করার কৌশলও অভিন্ন।  

দীর্ঘকাল একেবারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা বজায় রেখে দেশ শাসন করতে গিয়ে পুতিন কিংবা লুকাশেঙ্কোর মতো মানুষদের খুব বেশি ঝামেলায় পড়তে হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মানুষকে নানা রকম নিপীড়নের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে এতটাই ভীতি তৈরি করতে পেরেছেন তারা যে সরকারের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে মাঠে নেমে আসার সাহস সে দেশের মানুষের হয় না। তবে এই দুই স্বৈরশাসক এক নতুন দুনিয়ায় আছেন, তাই আগের সব স্বৈরশাসকের মতো এতটা নিশ্চিন্ত তারা থাকতে পারেন না মাঠ ফাঁকা দেখেও। এখন রাজনীতির মাঠ আর প্রথাগত মাঠে সীমাবদ্ধ নেই, এর ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে বহু দূর।

ডিজিটাল মাঠ এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এসব স্বৈরশাসকদের জন্য।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া আর ভ্লাদিমির পুতিন বেশ আলোচনায় ছিল অ্যালেক্সেই নাভালনির জন্য। পুতিনের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টিকারী নাভালনিকে কারান্তরীণ করা থেকে শুরু করে নানান রকম অত্যাচার করেও যখন থামানো যায়নি, তখন তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা হয়। কোমায় চলে যান নাভালনি এবং শেষে জার্মানিতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। আর দেশে ফেরামাত্র গ্রেফতার হয়ে নিশ্চিতভাবেই কারাগারে যাবেন, এমনকি এরপর হত্যাকাণ্ডের শিকার হবার বিরাট সম্ভাবনা থাকার পরও অবিশ্বাস্যভাবে তিনি রাশিয়ায় ফিরে যান।

নাভালনি পুতিনের মতো প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্টের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন ডিজিটাল মাঠে বিচরণ করেই। নিজের ইউটিউব চ্যানেল ব্যবহার করে নাভালনি পুতিন এবং তার গোষ্ঠীতন্ত্রের প্রভাবশালী সদস্যদের (অলিগার্ক) দুর্নীতি উন্মোচন করতে থাকেন। এমনকি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করার মাধ্যমেই মানুষকে রাস্তায় নেমে আসার জন্য সংগঠিতও করেছেন তিনি।  

সার্গেই তিখানোভস্কি অনলাইনে, বিশেষ করে ভিডিও ব্লগিংয়ের মাধ্যমে বেলারুশের গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো এবং তার অলিগার্কদের লুটপাট আর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে ভিডিও তৈরি করতেন। সঙ্গে মানুষকে তার গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে সচেতন করে তুলেছিলেন। এটা তাকে ভীষণ জনপ্রিয় করে তোলে। ২০২০–-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার দুদিন পরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার স্ত্রী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রার্থিতা ঘোষণা করেন, যদিও চরম কারচুপির সেই তথাকথিত নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি।      

জগতে একমাত্র পরিবর্তনই স্থির। প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে সবকিছু। কোথাও পরিবর্তনটা দ্রুত, তাই নজরে আসে তাড়াতাড়ি। কোথাও পরিবর্তনটা ধীর, অলক্ষেই ঘটে চলে। দ্রুত হোক কিংবা ধীর, পরিবর্তন কিন্তু চলছেই। বদলায় মানুষ, বদলায় সমাজ-রাষ্ট্র, সেই সঙ্গে বদলে যায় রাজনীতির ধরন। আর তাই গতকাল রাজনীতির যে রূপ ছিল চিরচেনা, অনেকেই ভাবতাম এর পরিবর্তন বুঝি অসম্ভব, সবকিছু বদলের ধাক্কায় একদিন দেখা যায় রাজনীতির সেই চিরচেনা ধরনটাও পাল্টে গেছে আমূল।

রাজনীতিতে এতদিন জনমত গঠন, নির্বাচনি কলাকৌশল ঠিক করা, দলের বয়ান তৈরি এবং তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করতেন রাজনীতিবিদরা। কিছু দিন আগে পর্যন্ত কেউ কল্পনাও করেনি এই কাজগুলো দল বা রাজনীতির বাইরের কেউ করতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতেও ধীরে ধীরে বহুজাতিক কোম্পানির মতোই মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে পদক্ষেপ নেবার বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। এই যেমন ভারতের প্রশান্ত কিশোরের কথাই ধরা যাক। বাঘা বাঘা সব রাজনীতিকদের সরিয়ে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো দলের নির্বাচনি কৌশল ঠিক করছে ৪৪ বছরের কিশোর, যার সঙ্গে দলীয় রাজনীতির তেমন কোনও সম্পর্কই নেই।  

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ‘মাঠ’ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এতদিন মাঠ বলতে রাজনীতির চিরচেনা মাঠকেই বোঝানো হতো। মাঠের কর্মী মানেই ছিল রাজপথের কর্মী, যারা থাকতো মিছিল, সভা, সমাবেশের অগ্রভাগে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতির মাঠকে কি আর কেবল সনাতন মাঠে আবদ্ধ রাখা সম্ভব? ভীষণ রকম একটা পরিবর্তন কি রাজনীতির এই ‘মাঠ’কে ঘিরেও ঘটে যায়নি? জন্ম হয়নি কি সম্পূর্ণ নতুন এক মাঠের, যাকে আমরা বলি ‘ডিজিটাল মাঠ’? নতুন এই মাঠটিও কি দেশে দেশে নতুন ভয়ের জন্ম দেয়নি স্বৈরশাসকদের মনে? এই মাঠ দমনের জন্য আইন তৈরির পাশাপাশি নানা ধরনের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়নি?  

পাঠক, একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন গত কয়েক বছরে রাজনীতির শক্তিশালী মাঠ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ‘ডিজিটাল মাঠ’ যার মধ্যে আছে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া, আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আছে কলাম লেখা, মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টক’শো বা আলোচনা। রাজনীতির চিরচেনা শাশ্বত যে রূপ, তা অনেকটাই এখন ভেঙেচুরে একাকার। যারা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি করতে চান, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা আছে তারাই মূলত আছেন এই নতুন মাঠের নেতৃত্বে। ফলে রাজনীতিতে বহু বছরের মেধার যে খরা আমরা দেখেছি, সেখান থেকে বের হবার একটা পথ সম্ভবত তৈরি হয়েছে।      

রাজনীতিতে ‘ডিজিটাল মাঠ’ তৈরি হয়েছে আরও আগেই। কিন্তু গত কয়েক বছরে এর প্রসার ঘটেছে মারাত্মক। হাতে হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের প্রসার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সরব উপস্থিতি বিষয়টিকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। রাজনীতির মূল বিষয়ই হলো মানুষকে কানেক্ট করা। একটা জনসভায় যত মানুষ জড় হয় তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ একজন প্রিয় আলোচকের টিভি টকশো দেখে বা একটা জাতীয় দৈনিকের কলামে চোখ বুলায়। ফলে মানুষকে কানেক্ট করা যায় সহজেই। একটা জনসভা আয়োজনের যে খরচ আর চাপ, সেই তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির এই মাঠটা প্রায় বিনা খরচের।

বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরি রাজনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নতুন বয়ান তৈরি করে সেটি সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে পড়তে-লিখতে পারে না, এমন মানুষ আছে অনেক, সেখানে লেখার (লিফলেট, বুকলেট, পোস্টার) মাধ্যমে রাজনৈতিক বয়ান প্রচারের চাইতে কথা বলে প্রচার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ক্ষেত্রেও ডিজিটাল মাধ্যম অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকা পালন করতে পারে। একটা জনসভায় কয়েক হাজার লোক জমায়েত করা যেখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে ডিজিটাল মাধ্যমে মুহূর্তেই একজন রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য পৌঁছে যাচ্ছে কয়েক লক্ষ মানুষের কাছে।  

আমাদের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ দেশে ডিজিটাল মাঠের এই রাজনীতিটাও আসলে যুদ্ধই। অনেক ক্ষেত্রে এটা সনাতন মাঠের যুদ্ধের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের এক ভয়ংকর অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি একটা কার্টুন পর্যন্ত কতটা ভীতির কারণ হয়ে উঠতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। ওদিকে শোনা যাচ্ছে নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এক লাখ কর্মী ছেড়ে দেওয়া হবে ডিজিটাল মাঠে, যাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে।

পরিবর্তনের শাশ্বত রূপের সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্য, রাজনীতির প্রচলিত যে মাঠ সেখানে ন্যূনতম কাজ করার কোনও স্পেস সরকার গত কয়েক বছরে একেবারেই রাখেনি। মাঠের রাজনীতির চিরচেনা যে রূপ মিছিল, জনসভা, মানববন্ধন তা সরকার আর প্রশাসনের অনুমতির নানা বেড়াজালে আটকে বিলুপ্ত প্রায়। এমনকি বিরোধী দলের ঘরোয়া সভাতেও সরকারের কড়া নজরদারি। বাদ নেই দোয়া মাহফিলও; সেখান থেকেও কর্মী গ্রেফতারের নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে।

প্রচলিত মাঠের রাজনীতি আর আজকের ডিজিটাল মাঠ একটি অপরটির প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরিপূরক। এর প্রমাণ মেলে আমাদের দেশে নিরাপদ সড়ক, কোটা সংস্কার, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন কিংবা আরব বসন্তে। এর সবগুলোই ডিজিটাল মাঠে শুরু হয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল প্রথাগত মাঠে।  

সরকারি দমন-পীড়নের কারণে রাজনীতির প্রচলিত মাঠ তার জৌলুস হারাচ্ছে প্রতিদিন; আর সেই সঙ্গে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, ক্ষমতাবান হয়ে উঠছে ডিজিটাল মাঠ। এটা রাশিয়া, বেলারুশের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সত্য আমাদের দেশের জন্যও।

 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ