X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডানা ভাঙা বৈশাখ

জোবাইদা নাসরীন
১৮ এপ্রিল ২০২২, ১৬:১২আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২২, ১৬:১২

জোবাইদা নাসরীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ের একটি বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, তিনি বলেছেন, ‘কিছু লোক ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ সৃষ্টি করতে চায়। এটা মোটেও সঠিক নয়। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। আমরা একসঙ্গে উৎসব পালন করে থাকি।’ আমার মতো অনেকের মনেই হয়তো এই বক্তব্যকে ঘিরে নানা ধরনের প্রশ্ন জেগেছে। তবে বক্তব্যটি আশা জাগানিয়া।

নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে যতটুকু জানি তা হলো জীবনযাপনের সবকিছুই সংস্কৃতির উপাদান। অর্থাৎ ধর্মও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এবং আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আদলও সংস্কৃতি নির্ধারণ করে।  কিন্তু বাংলাদেশে এটি উল্টোভাবে চলছে। অর্থাৎ ধর্মের দোহাই দিয়ে সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং এর ওপর খবরদারি চালানোর চেষ্টা বেশ কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে। কী প্রক্রিয়ায় এটি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে?

গত দুই বছর পহেলা বৈশাখের আনন্দ, উৎসব কিছুই হয়নি। সেটার কারণ ছিল করোনাভাইরাস। এ দেশে মানুষের এমনিতেই উৎসবে নিজের মতো করে বের হওয়া, ঘোরাঘুরি করার ফুরসৎ কম। বিশেষ করে নারীরা উৎসবগুলোতে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে খাবার-দাবার তৈরিতে এবং অতিথি আপ্যায়নে। এই নববর্ষের উৎসবেই ঢাকায় বসবাস করা মধ্যবিত্ত নারীদের অনেকেই ঘর থকে বের হয়। রমনার বটমূলে যায়, গান শোনে, পান্তা-ইলিশ খায়, তাদের অনেকেই হাত পাখা, মাটির পুতুল কিংবা চুড়ির রিনিঝিনিতে খিলখিলিয়ে ওঠে।

এবারের দুই বছর পরে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলেও সেই আমেজ ছিল না। ভয়, আতঙ্ক আর কেমন যেন দম বন্ধ করা পরিবেশেই উদযাপিত হয়েছে পহেলা বৈশাখ। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে লোকজনের আনাগোনা তেমন ছিল না। বসেনি জমজমাট কোনও মেলা, নাগরদোলার আয়োজন।  পাঁচ ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে মোড়া ছিল এই উৎসবের র‍্যালি। কেন একটি স্বাধীন দেশে একটি আনন্দ উৎসবের র‍্যালিতে পুলিশ ঘেরাও দিয়ে রাখবে? এ রকম একটি দৃশ্য সম্ভবত ১৯৮৯ সালে দেখা গিয়েছিল। এবং সে বছরই এই র‍্যালি প্রথমবারের মতো স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে কাজ করেছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, পহেলা বৈশাখ শুধু নতুন বর্ষবরণের দিন হিসেবেই আমাদের জীবনে আসে না। এটির একটি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। সম্রাট আকবরের সময় থেকে সূচিত এই বাংলা নববর্ষ। চৈত্র মাসের শেষ, খাজনা দেওয়াকে কেন্দ্র করেই মূলত ছিল এই উৎসব। খাজনা দেওয়া, হালখাতা, বৈশাখী মেলার মধ্য দিয়েই এটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব সামনে আসতে থাকে।

ষাটের দশকে যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল তখন এই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট পহেলা বৈশাখের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। সেই অনুষ্ঠান সে সময় হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক হাতিয়ার। তাই পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব আমাদের সবসময়ই স্মরণে রাখতে হবে।

এবারের পহেলা বৈশাখ এসেছে রমজানে। সেদিক থেকে হয়তো এবারের বৈশাখ ভিন্ন রকমের আবহ তৈরি করছে। তার সঙ্গে চলছে তীব্র গরম। শুধু এই কারণেই যে এবারের বৈশাখ ভিন্ন ছিল তা নয়। রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েও যদিও শুরু হয়েছিল বৈশাখের সকাল। ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রসহ র‍্যালি। কিন্তু সেই শোভাযাত্রা এবং র‍্যালি ছিল পুলিশে ঘেরা। এর আগেই ডিমএমপি থেকে বলা হয়েছে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বিকাল সাড়ে তিনটার মধ্যেই শেষ করতে হবে। এ যেন এক ডানা কাটা বৈশাখ। আনন্দের রশি কে যেন ধরে রেখেছে! কিন্তু কেন এই নির্দেশ সেই বিষয়ে কোনও ধরনের ব্যাখ্যা ছিল না।

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের উৎসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তবে এবার পহেলা বৈশাখের আগে থেকে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা পহেলা বৈশাখের উৎসবে যেন বাড়তি সতর্কতা তৈরি করেছে। যেমন, বৈশাখের আগে নারীর টিপ পরা নিয়ে ঘটে যাওয়া বিতর্ক, বৈশাখ পালন নিয়েও নানা ধরনের বাহাস– সব মিলিয়ে বৈশাখ উৎসব হিসেবে মন খারাপ করাই ছিল।

এখন ফিরে আসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে। এর আগেও সরকার থেকে ঘোষণা এসেছিল– ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন তাহলে উৎসবের সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপন করা হবে? এটি কি আসলে একদিনেই হচ্ছে? কিংবা হঠাই ঘটছে?

নিশ্চিতভাবেই এর উত্তর হবে– ‘না’। এটি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কিছুই নয়।  প্রধানমন্ত্রী সংস্কৃতি এবং ধর্মকে আলাদা থাকার কথা ঘোষণা দিলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং অতিরিক্তপনা যে এই ধরনের অবস্থার জন্য দায়ী সেটি  সবাই কম বেশি জানি। তাই আজকে কী হচ্ছে সেটি নিয়ে আলোচনা বিশ্লেষণের চেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে কেন এসব হচ্ছে সেই বিষয়ে তদন্ত করা। এই পরিস্থিতিতে দেশে একদিনে হয়নি। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে সংস্কৃতির আদল পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন তারা কিন্তু সংখ্যায় কম। কিন্তু তাদের আমরা ভয় পাচ্ছি। আসলে কি আমরা ভয় পাচ্ছি? আসলে আমাদের ভয় ভোটের, ক্ষমতা হারানোর। তাই আমরা সবসময় ধর্ম ব্যবসায়ীদের তোয়াজ করে চলি।

আমাদের এই অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল দায়ী। আমাদের মনে রাখতে হবে একটি ঘটনা ঘটলেই সেটি নিয়ে হাহাকারের চাইতে কি প্রক্রিয়ায় সেটি সংঘটিত হয়েছে সেই বিষয়ই আমাদের মনোযোগী হতে হবে সবচেয়ে বেশি। তাই প্রধানমন্ত্রীকে বিনীতভাবে জানাতে চাই, রাজনৈতিকভাবে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করলেই আসলে বন্ধ হবে অনেক কিছুই। সেদিকেই দেশকে পরিচালিত করুন।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ