X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় কী বার্তা দিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী?

ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে
১৪ মে ২০২২, ১৬:০৪আপডেট : ১৪ মে ২০২২, ১৬:০৬

গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সভায় দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সেখানে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাঁর বক্তব্যের বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন যা আওয়ামী লীগের আগামী দিনের রাজনীতি এবং বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

তাঁর বক্তব্যে এক দিকে যেমন কেন্দ্র থেকে স্থানীয় নেতৃত্বের প্রতি কড়া বার্তা রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আগামী নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা হয়েছে। অতএব তাঁর এই বক্তব্যটি বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ–এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা শক্তভাবে বলেছেন যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নিজেদের মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে যারা নির্বাচন করেছে তাদেরকে দলীয় সকল কার্যক্রম থেকে দূরে রাখতে। একই সঙ্গে যে সকল কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থনে কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এই বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি ফুটে ওঠে সেটি হচ্ছে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে থেকে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনৈক্য মেটানো সম্ভব হয়নি।  ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় মনোনীত প্রার্থীরা হেরেছে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রেক্ষিতে এটি হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, কিন্তু ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই বিষয়টি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।

এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন কারণ নির্বাচনকেন্দ্রিক যে অনৈক্য তৈরি হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে সেটি খুব সহসাই হয়তো মিটবে না। আর এর মূল কারণ হচ্ছে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং অনেক ক্ষেত্রে এমপিদের মধ্যে বিভাজন। প্রত্যেকে চেষ্টা করেছে নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করবার জন্য। আর এই কারণেই অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতাদের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ফলে এই বিষয়ে যদি শক্ত অবস্থান এখনই না নেওয়া যায় তবে আগামীতে এই বিষয়টি দলের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে। এ প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্লেষণ করলে দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নির্দেশনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ কথা ঠিক যে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো যোগ্য নেতৃত্ব মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি এটিও মাথায় রাখতে হবে দলের সাংগঠনিক নির্দেশনা মেনে চলা সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর দায়িত্ব। যদি কেউ মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে থাকেন, তবে দলের নির্দিষ্ট ফোরামে তিনি তা উল্লেখ করতে পারতেন। কিন্তু দলের নির্দেশনা না মেনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টির উপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জোর দিয়েছেন তা হলো আগামী নির্বাচনে দলের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং যোগ্য নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি যে  অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্য এবং জনগণের কাছে থাকা ব্যক্তিরা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নির্দেশনা মেনে যদি সকল নির্বাচনে-বিশেষত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে-দলের যোগ্য মানুষটিকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিতে পারে, তাহলে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া তাদের জন্য অনেক সহজ হবে। আমরা জানি যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে যাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত তথ্য সংগ্রহ করেন। তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে তা দলের জন্য সুফল বয়ে আনবে। আর যারা দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অপকর্ম করেছেন এবং দলকে বিভাজিত করেছেন-সেই সকল নেতা-কর্মীদের যদি মনোনয়ন না দেওয়া হয় তাহলে সেই সিদ্ধান্তকে দলের সমর্থকরা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িত নেতাকর্মীদের  জন্য এটি একটি শক্ত বার্তা হবে যা দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আরও যে কথাটি বলেছেন সেটি হচ্ছে আগামী নির্বাচন হবে সকলের অংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ নির্বাচন। তিনি চান দেশে একটি স্বচ্ছ এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসুক। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাঁর এই বক্তব্যেকে বিরোধী দলগুলোর ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৩ বছরে যে উন্নয়ন সাধন করেছে তা জনগণকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছেন জনগণের কাছে। তবে নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করার দায় শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নয় যে বিষয়টি তিনি সঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তব্যে।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল। এই দলের হাত ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব হচ্ছে সম্মিলিতভাবে কাজ করে নির্বাচনি বৈতরণী পার করা। সকল বিষয়েই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ওপরেই নির্ভর করতে হবে-এটি কখনোই কাম্য নয়। তিনি এক দিকে যেমন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী,  ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। অতএব তাঁর একার পক্ষে দল এবং দেশের সকল বিষয় পরিচালনা করা কখনোই সম্ভব নয়। এই নির্ভরতা যদি তৈরি হয়ে যায় তবে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যাবে। আর এই বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিধায় তিনি সকলের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করেছেন এই জন্য যে সকলে যেন নিজ নিজ অবস্থা থেকে দলের জন্য কাজ করে।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর আরেকটি কথা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি  বলেছেন যে তিনি দেশের জনগণের জন্য অনেক কিছু করেছেন। জনগণ তাকে কি দেয় এটি তিনি এখন দেখতে চান। আমি বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে তাদের শেষ ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচনা করে। তবে আমরা বিভিন্ন সময়ে মীরজাফরের বংশধরদের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেছি বাংলাদেশে।  যে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে নিশংসভাবে। এটা ঠিক যে জনগণ হলো রাজনীতিবিদদের সকল আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু পাশাপাশি এটিও ঠিক যে একটি মহল বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করে চলেছে। আমাদের সকলের প্রত্যাশা জনগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। পাশাপাশি আমাদের সকলের উচিত সকল ধরনের অপরাজনীতিকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা যাতে এই গোষ্ঠী যেন জনগণকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে না পারে।

পরিশেষে, গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছেন তা আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। তাদের মাথায় রাখতে হবে যে সময় পাল্টেছে এবং বাংলাদেশে এখন পৃথিবীর মানচিত্রে একটি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী হতে হবে। আর দলকে শক্তিশালী করতে হলে আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা দলকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করেছে এবং যারা সাংগঠনিকভাবে দলে দুর্বল করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হবে এবং আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ