X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসির স্ব-আরোপিত অসহায়ত্ব আর নির্বিকার সরকার

রুমিন ফারহানা
১৫ জুন ২০২২, ১৬:০৮আপডেট : ১৫ জুন ২০২২, ২১:৪৪

ঘটনার ক্ষেত্র কুমিল্লা শহর। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জনাব বাহাউদ্দিন বাহার নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, এমন অভিযোগ করছিলেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জনাব মনিরুল হক সাক্কু। জনাব সাক্কুর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে এবং অভিযোগের সত্যতা পায়। তারই ভিত্তিতে কমিশন জনাব বাহারকে সিটি করপোরেশন এলাকা ত্যাগ করতে চিঠি দেয়। সেই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিলেন জনাব বাহার। সেখানেই ছিলেন তিনি এবং চালিয়ে গিয়েছিলেন তার যাবতীয় সব নির্বাচনি কর্মকাণ্ড।

কুমিল্লার এই পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই তুমুল আলোচনা তৈরি হয়। আর তার জবাব দিতে হয় নির্বাচন কমিশনারদের। নির্বাচনের তিন দিন আগে নির্বাচন নিয়ে আয়োজিত এক কর্মশালায় কমিশনার আহসান হাবিব খানের কাছে ‘কমিশনের চিঠির পরও কীভাবে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান করছেন’ প্রশ্ন রাখা হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত আপনি (সংসদ সদস্য)। এ ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতা হয়ে আপনি নিজেই ব্যর্থ হলেন। এরপরে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে নেবেন বাংলাদেশের মানুষ। যেখানে ভোটের পরিবেশ নেই, সেই কেন্দ্র বন্ধ হবে।’

নির্বাচন কমিশনের পিছু হটা নিয়ে আরেক কমিশনার রাশেদা সুলতানা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আইনি কাঠামো যেভাবে আছে, সেভাবে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। উনি (বাহাউদ্দিন) আইন মানেন না, আইনপ্রণেতা। আমাদের ব্যর্থ বলেন কেন আপনারা? একজন সম্মানিত লোককে টেনেহিঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়।’

এখানে এটা স্পষ্ট এই দুই নির্বাচন কমিশনার এই প্রশ্নে অটল আছেন যে জনাব বাহার নির্বাচনি আইন ভঙ্গ করেছেন। আমরা, সাধারণ নাগরিকরা এই প্রশ্ন করতেই পারি, একজন সংসদ সদস্য যদি রাষ্ট্রের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান, তাহলে তিনি কি আর ‘সম্মানিত লোক’ থাকেন? যদি সেটা থাকেনও তবু যে অপরাধ তিনি করেছেন, সেটার শাস্তি কি তার প্রাপ্য নয়?

দুই কমিশনার অবশ্য অনুসরণ করেছেন তাদের প্রধান, সিইসি’র দেওয়া গাইডলাইন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জনাব বাহারের এলাকায় থেকে যাওয়া নিয়ে বলেন, ‘ইসির নির্দেশনা পাওয়ার পর একজন সংসদ সদস্য এটাকে অনার না করলে কমিশনের তেমন কিছু করার নেই। আমাদের এমন কোনও ক্ষমতা নেই যে কাউকে জোর করতে পারি। আমরা তো আর কাউকে কোলে করে নিয়ে যেতে পারি না।’

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রধান যখন ‘কোলে করে সরানো’ কিংবা আরেকজন কমিশনার ‘টেনেহিঁচড়ে নামাতে’ পারার অক্ষমতার কথা বলছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই একেবারে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে, নির্বাচন কমিশনের কি তাহলে কিছুই করার ছিল না? এত অক্ষমতা নিয়ে একটা নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচন করবেন কী করে? পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বাংলাদেশের সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় সংসদ নির্বাচন হয় অর্থাৎ ৩০০ জন সংসদ সদস্য তাদের নির্বাচনি এলাকা চষে বেড়াবেন আগামী নির্বাচনের সময়। তাই অনিবার্যভাবেই প্রশ্ন এসেছে, একজন এমপিকে সামাল দিতে ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের সময় ৩০০ জন এমপিকে সামাল দেবে কীভাবে?

অনেকেই দেখলাম নির্বাচন কমিশনের সুরে সুর মিলিয়ে বলছেন কোনও এমপি যদি এলাকা না ছাড়ে তাহলে কমিশনের কি-ই বা করার আছে। কমিশন কী করতে পারে এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণীত হয় ২০১৬ সালে। সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬-এর ২২ ধারা মতে, সরকারের একজন সুবিধাভোগী হিসেবে ওই সংসদ সদস্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণায় বা নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এই ধারা লঙ্ঘন করলে নির্বাচন কমিশন ওই বিধিমালার ৩২ ধারা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক লিখিত আদেশ দ্বারা যে প্রার্থীর পক্ষে সংসদ সদস্য প্রচারণা চালিয়েছেন, কাজ করেছেন কিংবা প্রভাব বিস্তার করেছেন, তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারেন। এমনকি নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারেন। অথচ নির্বাচন কমিশন বারবারই তাদের অসহায়ত্ব জানিয়ে বলছেন এমপি বাহারের এই নির্বাচনি আদেশ পালন না করায় নির্বাচন কমিশনের নাকি কিছুই করার নেই। স্ব-আরোপিত আসহায়ত্ব আর কাকে বলে!  

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন কী করতে পারতো তার একটা চমৎকার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এক-এগারোর সময়কার নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘বাহারকে নির্বাচনি এলাকার বাইরে পাঠাতে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। বাহার যদি না যান, তাহলে কমিশন চাইলে নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারতো। সেটা করেনি। আমরা কমিশনে যখন ছিলাম, তখন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে এই প্রক্রিয়ায় এলাকার বাইরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলাম। তিনি সেখানে গিয়ে দরবার বসিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলাম, আপনি সরে না গেলে নির্বাচন স্থগিত করে দেবো। তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। তখন তো এই সরকারই ছিল।’’

জনাব সাখাওয়াতদের কমিশন জনাব নাসিমের মতো ক্ষমতাসীন দলের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং জনাব বাহারের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাকে চাপ দিয়ে তাদের আদেশ মানতে বাধ্য করেছিলেন। এমন উদাহরণ থাকার পরও বর্তমান কমিশন একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতার বিরুদ্ধেই অকল্পনীয় ভীরুতা দেখিয়েছে।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা নিয়ে চারদিকে নানা আলাপ-আলোচনা চলেছিল। আমরা চাই বা না চাই, মিডিয়া হাইপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এই আলোচনা থেকে বাইরে থাকা কারও পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। বিএনপি সঠিকভাবেই বলেছিল, নির্বাচনকালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে কোনও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। তাই নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথা নেই। তবে বিশেষ করে সরকারি দলের নেতারা এবং সরকার সমর্থক ‘সুশীলরা’ বারবার বলছিলেন,  নির্বাচন তো সরকার করে না, করে নির্বাচন কমিশন। এবং নির্বাচন কমিশনের নাকি অগাধ ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতার নমুনা তো কুসিক নির্বাচনে দেখা গেলো।

আমাদের অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলার চেষ্টা করছিলেন বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে তার কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা উচিত হবে। তারা এটাও বলছিলেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে তাদের প্রথম পরীক্ষা। ফলে মিডিয়ার চোখ ভালোভাবেই ছিল এই নির্বাচনের ওপরে। 

তাত্ত্বিকভাবে ধরে নিই, বর্তমান নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের মতো জনাব বাহারকে এলাকা থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অসাধারণ সুন্দর হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলেও কি আমরা মেনে নিতাম এই কমিশনের অধীনে একটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন হতে পারে?

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর নির্বাচন কমিশন, সদ্য বিদায়ী নুরুল হুদা কমিশনের অধীনেও গত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি খুব ভালো হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের নামে কী হয়েছে, সেটা কি আমরা দেখিনি?

এটুকু বোঝার জন্য আদৌ বেশি রাজনৈতিক জ্ঞানের দরকার নেই, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই আমরা বুঝতে পারি একটা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু একটা জাতীয় নির্বাচন, যেখানে কারও ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া নির্ভর করে, সেখানে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগের প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচন হতেই পারতো সরকারের দিক থেকে ‘আইওয়াশ’ দেওয়ার দারুণ সুযোগ।

আলোচনার খাতিরে ধরে নিই, জনাব বাহারকে নির্বাচনি এলাকা থেকে সরানোর ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ছিল না। তারপরও কি দল বা সরকারের উচ্চ পর্যায় পারতো না চাপ প্রয়োগ করে বাহারকে সেই এলাকা থেকে চলে আসতে বাধ্য করতে? সরকারের সেই চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা আছে যে চাপ প্রয়োগ করলে এমপি বাহারের এলাকা থেকে না সরে উপায় থাকতো না। অর্থাৎ সরকার সেটা চায়নি বা করেনি। একটা জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটা সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচনের আইওয়াশেরও প্রয়োজন বোধ করছে না সরকার।

 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ