X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
২৫ আগস্ট ২০২২, ১৪:৪৪আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২২, ১৪:৪৪

আজ রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর পূর্তি। আমি প্রতি বছর আগস্টের ২৫ তারিখ বাংলা ট্রিবিউনে রোহিঙ্গা ঢলের বছরপূর্তি উপলক্ষে একটি নিবন্ধ লিখি এবং সেখানে বিগত বছরগুলোর সূত্র ধরে গত এক বছরের প্রধান এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাই। পাশাপাশি কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি, সেগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকি।

এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমরা যখন রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর লিখি, তার অর্থ এ নয় যে, কেবল পাঁচ বছর আগেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে শরণার্থী হিসাবে রোহিঙ্গারা প্রথম প্রবেশ করে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফা প্রবেশ করে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। সর্বশেষ মোটাদাগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে ২০১৭ সালে। এবং ২০১৭ সালে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ কারণেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা প্রবেশের ঢল নামে মূলত ২০১৭ সালে। সে হিসাব অনুযায়ী আজ রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর পূর্তি কারণ ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জেনোসাইড থেকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ২৫ আগস্ট থেকে প্রায় দুইমাস এ ঢল অব্যাহত ছিল। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, অমানবিক নির্যাতন এবং গণহারে অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা কোনোরকম ‘জানটা’ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যা ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়, ২৫ আগস্ট থেকে প্রথম দুই মাসে কমেবেশি ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়; প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় গ্রহণ করে; প্রায় ১৯০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়, এবং প্রায় ৪ শত গ্রাম পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। তাই, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্টকে ‘জেনোসাইড স্মরণ দিবস’ (জেনোসাইড রিমেম্বারাস ডে) হিসাবে পালন করে। এবছরও বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টরা আজ ‘জেনোসাইড স্মরণ দিবস’ পালন করছে।

গত এক বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে মোটাদাগে পাঁচটি: মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড, সিক্স মার্ডার, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা, ভাসানচরে জাতিসংঘের নতুন করে সম্পৃক্ততা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের করা আপত্তি খারিজ। এর বাইরেও সারা বছর জুড়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানান খবর মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।

গত বছর রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্বব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মহিবুল্লাহর একটা খ্যাতি এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল দেশে এবং বিদেশে। তাছাড়া, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সহযোগী হিসাবেও তার একটা পরিচিতি ছিল। রোহিঙ্গা নেতা হিসাবে মহিবুল্লাহ পাদপ্রদীপের আলোয় আসে ২০১৯ সালে যখন রোহিঙ্গা জেনোসাইডের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার জমায়েত হয় মহিবুল্লাহর নেতৃত্বে। তাছাড়াও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পাওয়া প্রভৃতি মহিবুল্লাহর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার স্বাক্ষ্য বহন করে। ফলে, ২০২১ সালে সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ যখন মহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়, তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এর বিপুল কাভারেজ দেওয়া হয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে যথাযথ বিচার দাবি করে বিবৃতি প্রদান করে।

এ ঘটনা রোহিঙ্গাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্থ করার জন্য এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। 

ঠিক এর পরপরই ‘সিক্স মার্ডার’ বা ছয়-হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রোহিঙ্গাদেরকে পুনরায় খবরের শিরোনামে পরিণত করে। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর মইন্যার ঘোনা  ক্যাম্প-১৮তে অবস্থিত দারুল উলুম নাদাউয়াতুল উলামা আল-ইসলাম মাদ্রায় হামলা করে ছয়জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনা শরণার্থী শিবিরে অস্ত্রের এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার একটা উদাহরণ হিসাবে সামনে চলে আসে। সারা দেশে এ ঘটনা নিয়েও তুমুল আলোচনা হয় এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে কিনা তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা শুরু হয় সর্বত্র। বিশেষ করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

২০২১ সালে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একটি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নবনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিয়ানমারের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর সমস্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশ ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিলেও সেটা মিয়ানমারের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা কারণে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন আর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু আলোচনাটাও শুরু করা যায়নি। এরই মধ্যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করায়, পরিস্থিতি পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের জুনে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে  মিয়ানমার সীমিত আকারে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ করে। বাংলাদেশও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য জোর দাবি জানায়। কিন্তু এরপর আমরা এর কোনও অগ্রগতি দেখিনি।

এবছরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ভাসানচরের রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ভাসানচরে এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরিত করা নিয়ে শুরু থেকেই নানান বিতর্ক জনপরিসরে এবং মিডিয়ায় আলোচিত হয়েছে। নানান সমালোচনা হয়েছে এ ভাসানচর প্রকল্প নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমালোচনা ছিল, ভাসানচর প্রকল্পে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত না-করা। আর জাতিসংঘের অসম্পৃক্ততার কারণে ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যেও নানান ধরনের ভয় ও সংশয় কাজ করেছে শুরু থেকে। যেহেতু শরণার্থীদের ভরণ-পোষণে জাতিসংঘ এবং এর বিভিন্ন অংশ সংগঠন অন্যতম অংশীজন, সেহেতু জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত না-করে রোহিঙ্গাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত আখেরে বাংলাদেশের জন্য  কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ফাইনালি জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে ভাসানচরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং ভাসানচর ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে নীতিগত ভাবে জাতিসংঘকে রাজি করিয়েছে। আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের একটা বড় অর্জন।

যদিও এটার স্থানিক তাৎপর্য নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আশাবাদি নই, তথাপি রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের দেওয়া আপত্তি খারিজ হয়ে যাওয়া। ২০২২ সালের জুলাইয়ের ২২ তারিখ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এক রায়ে ‘বিচারের করার এখতিয়ার নিয়ে’ মিয়ানমারের দেওয়া আপত্তি খারিজ করে দেয়। ২০১৯ সালে নভেম্বরে গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংঠনের অভিযোগ এনে একটি মামলা করে। এবং মিয়ানমারের পক্ষে সে মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণ করে তৎকালীন স্টেট কাউন্সিলের উপদেষ্টা অং সান সু চি’র নেতৃত্বে একটা প্রতিনিধি দল। আদালতের শুনানিতে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার গাম্বিয়ার করা মামলাকে এক ধরনের আইনি বৈধতা দেয়। কিন্তু ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর, মিয়ানমারের সামরিক সরকার গাম্বিয়ার করা মামলা পরিচালনা করার এখতিয়ার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নেই দাবি করে একটি আপত্তি তুলে। সে আপত্তির ওপর দীর্ঘ শুনানি হয় এবং শুনানি শেষে গত ২২ জুলাই মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করে দেওয়া হয়। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, মিয়ানমার কতৃক সংঘটিত রোহিঙ্গা জেনোসাইডের অপরাধে বিচার এখন চলবে এবং এর আর কোনও আইনি বাঁধা নাই। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ খারিজের ঘটনাকে অত্যন্ত সাধুবাদ জানিয়েছে।

বিগত এক বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এ পাঁচটি হচ্ছে মোটাদাগে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু সবচেয়ে মৌলিক কাজ হচ্ছে দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। ২০২২ সালের জুনে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা হলেও এখনও পর্যন্ত আমরা তার কোনও অগ্রগতি দেখি নাই। রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান যেহেতু নিহিত আছে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা এবং সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে, সেহেতু প্রত্যাবাসন ইস্যুতেই বাংলাদেশকে অধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে। রোহিঙ্গারাও শেষ বিচারে এর দ্বারা লাভবান হবে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ