X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুপত্নী হয়েও ফজিলাতুন নেছা হয়ে উঠেছিলেন সাহসী ও পরিপক্ব এক মানুষ

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
৩০ আগস্ট ২০২২, ১৫:২৫আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২২, ১৫:২৭

বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ফজিলাতুন নেছা সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য এ কলামের অবতারণা। তবে আমি তাকে ফজিলাতুন নেছা মুজিব বলেও সম্বোধন করছি না, বা তার নামের আগে মহীয়সী নারীও ব্যবহার করছি না। কেননা, তাকে আমার মনে হয়েছে সাহসী ও প্রজ্ঞাবান একজন রাজনীতিক, অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা এবং একই সঙ্গে সংসার ও উত্তাল রাজনীতির লাগাম ধরে থাকা একজন শক্তিমান কাণ্ডারি। ফজিলাতুন নেছা তাঁর সাহস, প্রজ্ঞা, ও সজ্ঞা নিয়ে একজন মানুষ হিসেবে সমহিমায় বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছেন।  

ফজিলাতুন নেছার জন্ম ও মৃত্যু হয় একই মাসে । ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট জন্ম এবং মৃত্যু ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ জহুরুল হক ও হোসনে আরা বেগমের এক পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে ছোট সন্তান ছিলেন বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা। ডাকনাম রেণু। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা আর পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারানোর পর রেণুর দেখভাল করতেন দাদা শেখ কাশেম। ফজিলাতুন নেছার দাদা একদম শিশুকালে রেণুকে শেখ মুজিবের কাছে বিয়ে দেন। ফজিলাতুন নেছার দাদা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই ফজিলাতুন নেছার সঙ্গে শেখ মুজিবের বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। রেণুর বয়স তখন বোধহয় ৩ বছর হবে। পরে ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯ বছর বয়সে এবং বেগম ফজিলাতুন নেছার ৯ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়।

শত শত বছর ধরে আমরা যে বাংলার গ্রাম দেখি, সেই গ্রামবাংলার একজন সাধারণ নারী হিসেবে শেখ ফজিলাতুন নেছা যে ধৈর্য, পরিপক্বতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, সেজন্য ব্যক্তি-স্বকীয়তায় জাজ্বল্যমান একজন সাহসী মানুষ হিসেবে নির্মিত হওয়া উচিত তাঁর আলাদা আইডেনটিটি, যাতে তাঁর আত্মত্যাগ, সাহস ও সংগ্রাম যেকোনও পুরুষ অথবা নারীকে সমানভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

দুই.

স্ত্রী হয়েও ফজিলাতুন নেছা হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু, কমরেড ও কনসালট্যান্ট। ফলে বঙ্গবন্ধু পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সব বিষয় শেয়ার করতেন স্ত্রীর সঙ্গে। রেণুও তার নিষ্ঠা, সাহস ও পরিপক্বতা দিয়ে সহধর্মী মুজিবুর রহমানের সহকর্মী হয়ে উঠেছিলেন। কখনও কখনও ফজিলাতুন নেছা স্ত্রীর যে ভূমিকা তার ঊর্ধ্বে উঠে সংকটময় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সময় গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন এবং সেটি বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত নজরদারি করেছেন বঙ্গবন্ধুর ওপর। উদাহরণ হিসেবে ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও ৭ মার্চের ভাষণের সময়ে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া ফজিলাতুন নেছার পরামর্শের কথা উল্লেখ করা যায়। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে শেখ ফজিলাতুন নেছার সজ্ঞাপ্রসূত সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।  

যেকোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামলে নেওয়ার মতো বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য ও সাহস ছোটবেলা থেকেই ছিল ফজিলাতুন নেছার। আর ব্যক্তিত্বের এসব ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন তাঁর পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে। শেখ ফজিলাতুন নেছা পড়ালেখা খুব বেশি করেননি। তবে স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। গান ভালোবাসতেন। অবসরে বই পড়তেন। মাসের পর মাস জেলবন্দি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরিবার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভালসহ রাজনৈতিক সংকট সামলাতেন তিনি সুনিপুণভাবে। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি, সেই সময়েও তিনি নিজের দুই ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন। কন্যা শেখ রেহানার বয়ানে ফজিলাতুন নেছা চিত্রিত হয়েছেন এভাবে–

“…গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তার ধৈর্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। এত লোক বাড়িতে খাচ্ছে-দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোনও মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে, সব সামলাচ্ছেন। এরমধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলবি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি — সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত।”

তিন.  

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দি হন শেখ মুজিবসহ অনেকে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এর শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠে গণ আন্দোলন। এ সময়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি থাকা শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি। একদিকে নেতাকর্মীদের উৎসাহ দিয়ে মনোবল চাঙা রাখতেন, অন্যদিকে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে বঙ্গবন্ধুকেও অনুপ্রাণিত করতেন। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাহোর গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্ত পছন্দ ছিল না শেখ ফজিলাতুন নেছার। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্ভবত ইঙ্গিত পেয়েছিল যে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। তাই বঙ্গমাতার পরামর্শে বঙ্গবন্ধুও প্যারোলে মুক্তি নিতে রাজি হননি।

দেখতে দেখতে শেখ মুজিবসহ কারাবন্দিদের মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন পরিণত হয় গণ অভ্যুত্থানে। আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের দিন শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয় বাঙালি জাতি। প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার বিষয়ে বঙ্গমাতার সেই সিদ্ধান্তকে ইতিহাস সঠিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পেছনেও রয়েছে পরিপক্ব ফজিলাতুন নেছার উৎসাহ ও প্রেরণা।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস অসীম সাহস ও ধৈর্য নিয়ে ফজিলাতুন নেছা বন্দিদশায় সব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি অর্জন করে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর সহধর্মিণী ও সহযোদ্ধা বেগম ফজিলাতুন নেছা তৎপর হয়ে ওঠেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। বীরাঙ্গনাদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য তাদের বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি এবং সহায়তা করেন তাদের আর্থিক পুনর্বাসনে। সরকার প্রধানের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দামি আসবাবপত্র, অলংকার, শাড়ির প্রতি ছিল না কোনও লোভ। বরং নিজের গহনা বিক্রি করে দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তা করার নজির রয়েছে তার। খুবই সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন শেখ ফজিলাতুন নেছা।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, যেটি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য এক প্রামাণিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সেই গ্রন্থটিও বেগম ফজিলাতুন নেছার দূরদৃষ্টির ফসল। কেননা, বঙ্গবন্ধুর মাথায়ও এ ধরনের একটি গ্রন্থ লেখার চিন্তা আসেনি। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ফজিলাতুন নেছা একদিন জেলগেটে বসে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনি।’ বঙ্গবন্ধুর বয়ানে আমরা এ কথাগুলো জানতে পারি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন – “হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কী? সময় তো কিছু কাটবে। আমার স্ত্রী, যার ডাক নাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।”

চার.

নিজের সংসার সামলানো, ছেলেমেয়ে মানুষ করার বাইরে শেখ ফজিলাতুন নেছা বৃহত্তর শেখ পরিবারের নানা বিষয়-আশয় তদারক করেছেন, কারাগারে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খোঁজ-খবর রেখেছেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়েছেন। এসবই তিনি করেছেন ট্রাডিশনাল বাঙালি স্ত্রীর ভূমিকার বাইরে গিয়ে। কেননা, আমরা একজন গতানুগতিক বাঙালি স্ত্রীকে দেখি তিনি ঘর-সংসার সামলাচ্ছেন এবং ছেলেমেয়ে মানুষ করছেন। এর বাইরে খুব কম স্ত্রীকেই আমরা বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তৎপর হতে দেখি। অথচ ফজিলাতুন নেছা গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে গ্রামে জন্মগ্রহণকারী একজন সাধারণ নারী হয়েও গতানুগতিক জেন্ডার রোলের ঊর্ধ্বে ওঠে স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। আর এখানেই শেখ ফজিলাতুন নেছা হয়ে গেছেন অনন্য; হয়ে উঠেছেন মুক্তি-সংগ্রামের এক সাহসী মানুষ; পরিপক্ব ও প্রাজ্ঞ এক নেতা।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ