X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

 বিএনপির জন্ম নিয়ে কয়েকটি কথা

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:২৯আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:২৯
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ১৯৭৮ সালের ০১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অবৈধ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে। জিয়াউর রহমান জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও একজন অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পরই আকস্মিকভাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। বন্দুকের নলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হন। তার ক্ষমতা দখল পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত দ্বারা অবৈধ ঘোষণা করা হয়।  জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠজন ও তার সময়কার বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস-মার্শাল তোয়াব বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে ১৯৭৯ সালে জার্মানির ফ্র্যাংফুর্টে প্রদত্ত এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারেও বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন।

তোয়াবের ভাষ্যমতে- ‘যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এবং মানবিক দিক দিয়ে চিন্তা করলেও মুজিব হত্যার ব্যাপারে জিয়া সবচেয়ে বড় অপরাধী”। (সাপ্তাহিক জনমত, লন্ডন, ১ এপ্রিল ১৯৭৯)।

‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেজ’ (বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি) নামে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম লিখেছেন, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তে আমি জিয়াকে বলি, আমি যেহেতু নির্বাচন করে যেতে পারলাম না, আমি তাঁকে অনুরোধ করবো যেন তিনি নির্বাচন দেন। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। শুনে আমি খুশি হই। কিন্তু, আমি তখন ভাবতে পারিনি যে নির্বাচনে তিনি নিজেই অংশ নেবেন। সেরকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করবেন এমন চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি।’

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের পর জটিল পরিস্থিতিতে  বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি বঙ্গভবন ত্যাগ করেন।

রাষ্ট্রপতি সায়েমের বিশেষ সহযোগী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে উপদেষ্টা কাউন্সিলের কতিপয় সিনিয়র বেসামরিক সদস্য ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার অনুরোধ করেন। তারা জানান, তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে তারা  কাজ করতে চান। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম লিখেছেন, ‘এরকম দুর্দশায় পড়ে আমি ভাবছিলাম, কোনোরূপ সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না করে আমি কীভাবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে আসতে পারি। কারণ, আমি আমার পদত্যাগপত্র যাকে সম্বোধন করে লিখবো, সেরকম কেউ ছিল না। (সূত্র-বাসস, ৩১ আগস্ট ২০২২)

১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট সায়েমকে পদচ্যুত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করে জিয়া সরকার। ওই ফরমানে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নাগরিকরা অতঃপর বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হবে।’  জিয়ার এই অপচেষ্টা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। [সূত্র– ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়’, আবদুল মতিন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী]

ক্ষমতায় বসার পর জিয়াউর রহমান দল গঠন করার প্রতি আগ্রহী হন ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে। গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতাও নেন। ক্যান্টনমেন্টে নিয়মিত মিটিংও করেছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বইতে এ নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়।  এখানে উল্লেখ করছি দৈনিক প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত অংশ– “বিএনপি গঠনে রাজনীতিকেরা প্রথম বৈঠক করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান সেনানিবাসের বাড়িতেই। বৈঠকগুলো হতো গভীর রাতে। এসব গোপন বৈঠক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানো হতো ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে। জিয়াউর রহমানের পক্ষে এ কাজ করতেন প্রয়াত মশিউর রহমান যাদু মিয়া। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) করতেন। তাঁকে প্রধানমন্ত্রিত্বের টোপ দেওয়া হলেও কথা রাখেননি জিয়া। এমনকি তাঁর মৃত্যু আজও পরিবারের কাছে রহস্যাবৃত। (দৈনিক প্রথম আলো তারিখ: ১৯-০৯-২০১০)

১৯৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি ফ্রন্ট ঘোষণার কথা বলেন। অতঃপর ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি নিজে এই দলের নেতৃত্বে না থাকলেও উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে এই দল গঠিত হয়। কিন্তু জাগদল সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ায় জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে অন্যান্য দলের সমন্বয়ে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ গঠন করেন।

১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়া নিজেকে নিজেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে দেন এবং ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৮ সালের ২৮ আগস্ট বিচারপতি সাত্তার ফ্রন্টের অন্যতম শরিক জাগদল বিলুপ্তির ঘোষণা করেন। ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে আইন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের আবেদন জানিয়ে ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। ৩১ আগস্ট বিএনপি সরকারি অনুমোদন পায়। ১৯৭৮-এর ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোঁরা প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। জাগদল তারই উৎসাহে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও আরেকটি নতুন দল গঠনের কী প্রয়োজন সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ৩রা জুনের নির্বাচনের পরেই সবাই আমরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে ভেবেছি এটাই শ্রেয়। দ্রুতগতিতে জাতীয় ঐক্য আরো সুসংগঠিত করা ও জাতীয় কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে হলে নতুন ও ব্রডবেজড জাতীয় দল গঠন করাই উত্তম। . . .

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে বিএনপির ৭৬ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। (সূত্র-বিএনপি সময়-অসময়, মহিউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা-১২২২-১২৩)।

তখনও জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান। একজন সেনাপ্রধানের নেতৃত্বেই জন্ম হয় বিএনপির। কার্যত, জন্মগতভাবেই বিএনপি স্বৈরশাসন ও গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের উত্তরাধিকার। শুরুতেই শাহ আজিজুর রহমানের মতো যুদ্ধাপরাধীরা বিএনপিতে যুক্ত হয়ে যায়।

রাজনীতির তিনকাল বইয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন, “ . . . ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হওয়ার পরেই রাজনীতিবিদের বৈঠক শুরু হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিভিন্নভাবে প্রভার বিস্তার করে জিয়ার পক্ষে রাজনীতিবিদ অনেককে আনতে সক্ষম হয়।  এসব রাজনীতিবিদকে নিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে প্রধান করে ৭৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে জাগদল নামে একটি রাজনৈতিক ফোরাম গঠন করা হয়। . . .

. . .এ সময় ১১ অক্টোবর বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করে জিয়া ঘোষণা দেন, তার রাজনীতির ভিত্তি হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। ২৫ অক্টোবর বঙ্গভবনে এক সমাবেশে জাতীয় শিল্প সংস্কৃতি পরিষদ গঠন করে জিয়া বলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদই হবে শিল্পী সংস্কৃতির প্রেরণা।” (রাজনীতির তিনকাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৮৩)

রাজনীতির তিনকাল বইয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী আরও লিখেছেন, “রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজের জন্য পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৯৫ মিনিটের এক সুদীর্ঘ বেতার ও টিভি ভাষণের মাধ্যমে জিয়া রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা দেন।. . . জিয়া জাতীয় ঐক্যের নামে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ উভয় শিবির থেকেই লোক সংগ্রহ করেন। বামপন্থি বলে দাবিদার, মুসলিম লীগ এবং ইসলামের পছন্দওয়ালারা এই নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শরিক হন। ’৭৮-এর ৯ এপ্রিল সামরিক বাহিনী থেকে পদত্যাগ না করে জিয়া নতুন রাজনৈতি দলে যোগদানের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।. . . সরকার ১৪ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে  স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সময় সরকারের প্রতি সমর্থন জোগানের লক্ষ্যে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু বেসামরিক ব্যক্তি একটি ছাত্র সংগঠন করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। এ নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে। এমনকি একপর্যায়ে ২৬ অক্টোবর টিএসসি চত্বরে ছাত্রদের হাতে স্বয়ং জিয়াও লাঞ্ছিত হন। শেষ পর্যন্ত বহু চেষ্টার পর ছাত্রদল নামে একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম দেওয়া হয়। আজকের ছাত্রদল সেই ধারাবাহিকতার ফসল। এদের অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মোকাবিলা করার জন্য সরকারি মদতে অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। যা প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে অস্ত্র সংগ্রহের মারাত্মক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে। (রাজনীতির তিনকাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা-১৮৪ ও ১৮৫)

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নিজের ভাষ্যেই তাঁর স্মৃতিকথামূলক ‘চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা-১৯৮৩-১৯৯০’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ছয়টি দলের সমন্বয়ে বিএনপি গঠিত।

১) জিয়াউর রহমানের গঠন করা জাগদল (এতে ছিল দলছুট কতিপয় রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবীরা।

২) রাজাকার খান এ সবুর ও শাহ্ আজিজুর রহমানের মুসলিম লীগ।

৩) রাজাকার মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও আনোয়ার জাহিদের চীনাপন্থী ন্যাপ।

৪) রাজাকার মাওলানা মতিনের ন্যাশনাল লেবার পার্টি।

৫) শাহ্ আজিজের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত শ্রীযুক্ত রশরাজ মণ্ডলের শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন।

৬) কাজী জাফর আহমদ-রাশেদ খান মেনন-হায়দার আকবর খান রনো’র চীনাপন্থী দল ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, সংক্ষেপে ইউপিপি।

যদিও পরে কয়েকজন বের হয়ে যায়। মেনন-রনো ফ্রন্টে থাকেননি। আনোয়ার জাহিদ বের হয়ে গেলেও পরে বিএনপি যখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তখন আবার যোগ হন।

মওদুদ আহমদ আরও লিখেছেন- “বিএনপির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এই দলের জন্ম কোনও স্বাভাবিক সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়নি।. . .

. . . একদিকে ছিল সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী, গণবিরোধী, স্বার্থপর এবং রাজনৈতিকভাবে সমাজে ধিক্কৃত ব্যক্তিরা।. . . বিএনপির জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে।” [চলমান ইতিহাস: জীবনের কিছু সময় কিছু কথা-১৯৮৩-১৯৯০, পৃষ্ঠা-১৫৯-১৬০]

এদিকে বিএনপির জন্ম নিয়ে লেখক মহিউদ্দীন আহমদ ‘বিএনপির সময় অসময়’ বইয়ে লিখেছেন- “জিয়া বিএনপি তৈরি করেছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে। ওই সময় যারা বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তারা যে বিএনপির আদর্শের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তা হয়তো বলা যাবে না। প্রাপ্তিযোগের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সন্দেহ নেই। তবে আদর্শের ব্যাপারটা যে একেবারে ছিল না তা নয়। যারা আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট রাজনীতি পছন্দ করেন না তাদের তো একটা অবলম্বন দরকার, বিএনপি হয়ে দাঁড়ালো ওই রকমের একটা প্ল্যাটফর্ম।” [পৃষ্ঠা-৩১৯]

বিএনপির প্রতিষ্ঠা, জিয়ার রাজনীতি ও স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন, বিদেশে চাকরি প্রদান ও রাজনীতি করতে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া নিয়েও আরও কিছু তথ্য এখানে উল্লেখ করছি।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর ‘হ্যাঁ/না’ ভোট করেছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম, যিনি পরে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের আইনমন্ত্রী হন। ‘হ্যাঁ/ না’ ভোটে অনেক স্থানে শতভাগের বেশিও ভোট কাস্ট দেখানো হয়।

১৯৭৮ সালের ২১ এপ্রিল এক ঘোষণার মাধ্যমে ৩ জুন ১৯৭৮ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা দেয় জিয়াউর রহমান। জিয়া বিরোধী দলগুলোকে মাত্র ৪০ দিনের নোটিশে নির্বাচনে আহ্বান করেন এবং মাত্র ২৩ দিন তাদের প্রচারণার সুযোগ দেন। সেসময় জেনারেল জিয়া একাধারে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ছিলেন।

স্বয়ং জিয়া কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ-১৯৭৮ অনুযায়ী ওই ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী হতে পারবেন না যিনি সরকারি চাকরি করেন এবং এতে বেতন গ্রহণ করতে থাকেন। জিয়া এই অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ১৯৭৮-এর নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অবৈধ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পরে ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া এক ফরমান জারি করে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টের হাতে প্রায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর নির্বাচনি প্রচারের স্বল্প সুযোগ দিয়ে ১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। এ সময় আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল আপত্তি জানায়। আপত্তির মুখে ২৭ জানুয়ারির পরিবর্তে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হয়। জিয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত কারচুপির এ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পায় বিএনপি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন তার ‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১’ গ্রন্থে বলেছেন, জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে জনতাই ক্ষমতার উৎস বললেও তার মৃত্যু পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীই তার ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র এক আদেশে ১৯৭২ সালে দালাল আইন বাতিল করে। দালাল আইন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি এক অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী দালালদের বিচারের জন্য সারা দেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়।

১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি সামরিক আইন প্রশাসক জিয়া এক ফরমান জারি করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘কোলাবরেটার’ আইন বাতিল ঘোষণা করে। এই ফরমানে বলা হয়, যাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তাদের সবাইকে রেহাই দেওয়া হবে। যারা ইতোপূর্বে দণ্ডিত হয়েছে, তারা দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করতে পারবে।  এমনকি ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি দেশত্যাগী পাকিস্তানি নাগরিকদের নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়।

৩ মে ১৯৭৬ জিয়াউর রহমান এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নষ্টপথ উন্মোচন করেন। Second Proclamation Order No. 3 of 1976 জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিক করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলি তুলে দেওয়া হয়।

পাশাপাশি জিয়াউর রহমান Ordinance No. 63 of 1975 -এর মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্ভর ’৭৫ সালে দালাল আইন বাতিল করেন। একই তারিখে ঝবপড়হফ Second Proclamation Order No. 3 of 1975 এর প্রথম তফসিল থেকে দালাল আইনের সেফগার্ড তুলে দেন।

১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলি তুলে দিয়ে Second Proclamation Order No. 3 of 1976 জারি করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। Second Proclamation জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের (যুদ্ধাপরাধী) ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেন। রাজাকার গোলাম আযমকে ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে স্বয়ং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোটিশ জারি করে। ১৯৭৬ সালের জুন মাসে এক ঘোষণা বলে ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটর্স আদেশ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বাতিল করে সকল যুদ্ধাপরাধীদের মামলা তুলে নেওয়া হয়। দালালরা যাতে সংসদে নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন সেজন্য ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু শর্ত তুলে দেওয়া হয় Proclamation Order No. 1 of 1977 জারি করে। যার ফলে স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিপি, নেজামে ইসলামসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িক দলসমূহ তৎপরতা শুরু করে। পুনর্বাসিত হয় যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে গোলাম আযম ঢাকায় আসেন তিন মাসের ভিসা নিয়ে। তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও জিয়া সরকার তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। গোলাম আযম আড়ালে থেকে জামায়াত দলের কাজ চালিয়ে যান। একসময় গোলাম আযমকে জামায়াত দলের আমির বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার আমলে গোলাম আযমের নাগরিকত্বের বৈধতা দেওয়া হয়।

১৯৮৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে মেজর (অব.) নাসিরউদ্দিন বলেন, “জিয়ার আমল ছিল বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভোগময় এবং মারাত্মক ক্ষতিকর। অসহায় বিপন্ন জাতিকে তিনি একের পর এক আঘাত হেনেছেন। তিনি নির্দ্বিধায় মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত সকল মূল্যবোধের মূলোৎপাটন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গলাটিপে হত্যা করেছেন। এমন একটা ভাব ছিল যেন ‘আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ দুটো কথা তিনি অকাতরে বারবার বলেছেন- ‘‘I will make politics difficult for the politicians’ Ges ‘I will not allow politicians to do politics.’ (আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন করে তুলবো এবং আমি রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করতে দেবো না।) এ দু’টো কথাই তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। এ দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে তিনি ধূলিসাৎ করে গেছেন অত্যন্ত নির্মমভাবে। এই জাতিকে যার মূল্য দিতে হবে বহু বছর ধরে। তিনিই রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন চিহ্নিত ঘাতক এবং যুদ্ধাপরাধীদের।” (অজয় বিশ্বাস কর্তৃক গৃহীত মেজর (অব.) নাসিরউদ্দিনের সাক্ষাৎকার, মাসিক নিপুণ, ডিসেম্বর ১৯৮৬)।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপির প্রতিষ্ঠা সেনা ছাউনিতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি যেখানে যুক্ত হয়েছিল দলছুট নেতারা, পাকিস্তানপন্থি ও উগ্র ডানপন্থি লোকজন, যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি, তাদের দোসর এবং পাকিস্তান-ফেরত সামরিক অফিসার-সিপাহী ও সিভিল আমলা, ভারতবিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি। সেই ধারা এখনও অব্যাহত রেখেছে বিএনপির নেতৃত্ব। কারণ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর অবৈধ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও পরবর্তীতে তার স্ত্রী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যেভাবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা ও পুনর্বাসন করেছে তেমনি বিএনপি-জামায়াত জোট চেষ্টা করেছে ২১ আগস্টের খুনিদের রক্ষা করতে।

বিএনপির ২০১৬ সালের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও যুদ্ধাপরাধী ও তাদের বংশধরদের পদ দেওয়া হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুকে এবারও সহ-সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কারাবন্দি লুৎফুজ্জামান বাবরকেও সদস্য করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সালাউদ্দিন কাদেরের পুত্রকে সদস্য এবং সাকার ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ দেওয়া হয়েছে। আবার যুদ্ধাপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে মৃত্যুবরণকারী আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীমকে নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান যেমন যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করেছিল, খালেদা জিয়াও যুদ্ধাপরাধীদের বংশধরদের পুনর্বাসন করে যাচ্ছেন।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ