X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণ

প্রভাষ আমিন
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:২৪আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:২৪
সকালে অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তায় মোবাইলে ব্রেকিং নিউজের ‘টুংটাং’। এত সকালে কীসের ব্রেকিং নিউজ! খুলতেই বুকটা ভেঙে গেলো। গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। একসঙ্গে বুকের ভেতর উথালপাথাল, আমার পুরো ছেলেবেলা। আমাদের দেশপ্রেমের অনুভূতি কাব্যিক ব্যঞ্জনা পেয়েছে যার গানে, সেই মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। বয়স মাত্র ৭৯। তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, এমন খবরও পাইনি। পরে জানলাম মাত্র দু’দিনের অসুস্থতায় তিনি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। ৭৯ বছর বাংলাদেশের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি, কারও কারও বিবেচনায় যথেষ্ট বয়স। কিন্তু গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মতো সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য ৭৯ অনেক কম বয়স।

আমার বয়সের চেয়ে বেশি তাঁর সৃষ্টিশীলতার বয়স। আমার পুরো ছেলেবেলাজুড়ে আছেন তিনি। বলা ভালো তার গান শুনেই বড় হয়েছি আমরা। এখন তালিকা খুঁজতে গিয়ে দেখি আমার অনেক অনেক প্রিয় গানের গীতিকার তিনি, যেগুলো আগে জানতামই না।

আমি খুবই সৌভাগ্যবান গাজী মাজহারুল আনোয়ার কুমিল্লার দাউদকান্দির সন্তান। তাঁর মতো কিংবদন্তির বাড়ি আমাদের উপজেলায়, এটা ছেলেবেলা থেকেই আমাকে গর্বিত করেছে। আরেক কারণে তাকে আপন মনে হয়। তিনি যে কলেজে পড়েছেন, আমিও সেই ভিক্টোরিয়া কলেজেরই ছাত্র। কিন্তু আমি খুবই দুর্ভাগা, তাঁর সাথে আমার কখনোই দেখা হয়নি। দেখা না হওয়ার দায় পুরোটাই আমার। এমন নয় যে তিনি বিশাল তারকাসুলভ দেয়াল তুলে রেখেছিলেন। কিন্তু আমার কাছে তিনি এমন দূর আকাশের তারা ছিলেন, কখনও কাছে যাওয়ার, ছুঁয়ে দেওয়ার সাহস পাইনি। গত বছর একুশে ফেব্রুয়ারি তারকা বিনোদন সাংবাদিক অভি মইনুদ্দীন ফোন করে বললেন, গাজী ভাই কথা বলবেন। কোন গাজী ভাই, জানতে চাওয়ার আগেই ভরাট কণ্ঠ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলছি। আমি তখন গাড়ি চালাচ্ছিলাম। চমকে স্টিয়ারিংয়ে হাত আলগা হয়ে গেলো। শেষ মুহূর্তে সামলে নিলাম। পরদিন মানে ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁর একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। আমন্ত্রণ জানাতেই তিনি ফোন করেছিলেন। আমি লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে গেলাম। গাজী মাজহারুল আনোয়ার আমাকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন! কিন্তু ঢাকার বাইরে থাকায় আমার মতো নাদান সে সৌভাগ্যকেও বরণ করতে পারিনি। তবে অটোগ্রাফসহ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বিখ্যাত গান সৃষ্টির নেপথ্য গল্প ‘অল্প কথায় গল্প গান’ বইটি আমার সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছে।

আমি নাদান বলে দাউদকান্দি বা ভিক্টোরিয়া কলেজ দিয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে গণ্ডিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু গাজী মাজহারুল আনোয়ার দেশ-কালের ঊর্ধ্বে। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, বাংলা ভাষার সম্পদ। তিনি শুধু এই কালের নয়, সর্বকালের মানুষ। গাজী মাজহারুল আনোয়ার ৩১টি ছবি প্রযোজনা করেছেন, ২১টি ছবি পরিচালনা করেছেন। তার পরিচালিত ও প্রযোজিত ছবিগুলো ব্যবসা সফল হয়েছে। আমার ধারণা, ছবি প্রযোজনা বা পরিচালনা তার রুটি-রুজির জন্য। তবে তিনি একজন কবি। তবে কাব্যের খুব অবহেলিত ধারায় তার সিংহাসন। কারও কবিতা গান হয়ে গেলে, আমরা তাকে বলি গীতিকবি। সমস্যা হলো, গীতিকবিকে কবিরা তাদের দলে নিতে চান না। আবার গানের জগতে মানুষ কণ্ঠশিল্পীকে যতটা চেনে, গীতিকারকে ততটা নয়। তবে গাজী মাজহারের প্রতিভা এমন সর্বগ্রাসী, সর্বব্যাপী; তাঁকে উপেক্ষা করার, অবহেলা করার দুঃসাহস কারও হয়নি, হবেও না। আবদুল গাফফার চৌধুরী যেমন একুশের গান লিখে অমরত্ব পেয়েছেন। তেমনি এক জয়বাংলা, বাংলার জয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে অমরত্ব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারতো। কিন্তু তিনি গান লিখেছেন ২০ হাজারেরও বেশি। তার শত শত গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে, ফিরবে অনন্তকাল, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ততকাল। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান আছে তিনটি, যে সৌভাগ্য আর কারও নেই। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ তো আছেই, আছে ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ এবং ‘একবার যেতে দে না, আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’। আপনি যদি দেশকে ভালোবাসেন কোনটাকে বাদ দেবেন? অন্য সব গান বাদ দিন, দেশের গানে গাজী মাজহারুল আনোয়ারই সেরা, তার ওপরে কেউ নেই। তার মতো করে বাংলাদেশকে আর কেউ চিত্রায়ণ করতে পারেননি।

‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, যেথায় কোকিল ডাকে কুহু, দোয়েল ডাকে মুহুর্মুহু, নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়, পিদিম জ্বালা সাঝেঁর বেলায়, শান বাঁধানো ঘাটে, গল্পকথার পানসি ভিড়ে রূপকাহিনির বাঁকে, মধুর মধুর মায়ের কথায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়’। গানের কী রূপকল্প, কী স্মৃতি-মেদুরতা! তাঁর গানের লাইনের পর লাইনে উঠে এসেছে আবহমান বাংলার রূপ।

শুধু দেশের গান নয়, বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ স্বর্ণালি ব্যঞ্জনা পেয়েছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায়। পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, ডোরা কাটা দাগ দেখে, বাবারে বাবা কই দিলা বিয়া, চলে আমার সাইকেল, ঢাকা শহর আইসা আমার’এর মতো মজার গান যেমন লিখেছেন; আবার চোক্ষের নজর এমনি কইরা, খোদার ঘরে নালিশ করতে দিলো না আমায়, তুমি আরেকবার আসিয়া, সবাই বলে বয়স বাড়ে, আছেন আমার মোক্তার’এর মতো অন্যরকম গানও লিখেছেন। আবার খোকন সোনা বলি শোনো, ওগো মা তুমি শুধু মা, বাপের চোখের মণি নয়, হারজিৎ চিরদিন থাকবে’র মতো পারিবারিক আবেগের গানও লিখেছেন তিনি। তবে দেশের গানের পর গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে অমরত্ব দিতে পারে প্রেমের গান। চোখ যে মনের কথা বলে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ইশারায় শিষ দিয়ে, এই মন তোমাকে দিলাম, গানেরই খাতায় স্বরলিপি, পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয়, তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো... তালিকা লম্বা করলে এই লেখা শেষ হবে না। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানের কাব্যগুণ বিশ্লেষণ করার সাধ্য আমার নেই। আমি আরেক গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের দ্বারস্থ হই। ‘অল্প কথায় গল্প গান’এ মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান লিখেছেন, ‘‘গানের কবিতায় আমরা কাব্য বলতে কী বুঝি? আমাদের সবারই দৃষ্টি আছে, আমরা দেখি। আমরা যেভাবে দেখি এবং অনুভব করি, তার প্রকাশ হয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু সেই একই বিষয়কে কবি এমনভাবে প্রকাশ করেন, যা শুনলে প্রথমত চমকে যেতে হয়, পরে ভাবনা আসে। এমনভাবেও অনুভব করা বা অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো যায়? আমরা সবাই দেখি আকাশ নীল, বাতাস প্রবাহিত হয়, তাতে কোনও না কোনও গন্ধ থাকেই। রাতের ঝোঁপঝাড়ে জোনাকি জ্বলে নথ প্রবাহিত হয়ে যায়। কিন্তু যখন শুনি, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ, রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি, তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ’ তখন এই প্রকাশটা স্বাভাবিকভাবেই চমকে দেয়। একটা ভিন্ন রকমের ভালোলাগা হৃদয়কে দুলিয়ে দেয়। কবি এবং সাধারণ মানুষের ভাবনার পার্থক্য এখানেই। কাব্যে উপমা রূপক চিত্রকল্প, এখন বহু কিছুরই সম্মিলন ঘটে এবং সেটিও কিন্তু অকারণ নয়।’ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অনেক গান নিয়ে এমন আলাদা আলাদা অভিসন্দর্ভ রচনা করা যাবে। আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’এর কবি শেষ জীবনে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবে তাঁর প্রতিভাকে রাজনীতির ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আটকে রাখা সম্ভব নয়। তাই তো ২০০২ সালে বিএনপি শাসনামলে একুশে পদক পাওয়া গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০২১ সালে স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। রাজনীতিবিদদের উদার হতে বাধ্য করেছেন তিনি। এটা তাঁর অর্জন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা শতাধিক। তবে এসব নয়, সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তার কোনও তুলনা নেই। দেশপ্রেমে, প্রেমে, বিরহে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করবে তার গানে- তোমাদের সুখের এই নীড়ে, আমাকে ডেকো না বন্ধু।
 
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ