X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা জরুরি

রাজন ভট্টাচার্য
২৯ অক্টোবর ২০২২, ১৭:৩৫আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ১৭:৩৫

দীর্ঘমেয়াদী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বই খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে পারে। বিশ্ব ব্যাংক থেকে শুরু করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গত কয়েকমাস ধরেই এরকম পূর্বাভাস দিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে, ২০২৩ সাল থেকে খাদ্য সংকট শুরু হতে পারে। যুদ্ধ ও কোভিড পরিস্থিতি উভয়ই মূলত এই সংকটের জন্য দায়ী।

আর্থিক ও খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশ যে একেবারেই নিরাপদ, এমন ভাবনার কারণ নেই। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্ব নেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে আগামী বছরে খাদ্য সংকটের কথা তুলে ধরে সবাইকে উৎপাদনমুখি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ কৃষি উৎপাদন বাড়ানোই নিজেদের সুরক্ষিত রাখার একমাত্র উপায়। তাই তিনি এক ইঞ্চি জমি পতিত না রেখে ফসল আবাদ করার পরামর্শ দিয়েছেন সবাইকে।

এটা তো সত্যি, টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতিতে সব দেশই নিজেদের সুরক্ষার কথা আগে ভাববে। সংকট হতে পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ ইউক্রেন আর রাশিয়া হলো শস্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেখানে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফসল উৎপাদন কমেছে। উৎপাদিত পণ্যের রফতানি কমে যাওয়ায় সংকটের মুখে বিভিন্ন দেশ। যা কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না বলেই স্ব-স্ব দেশগুলোতে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

তাই ইচ্ছা থাকলেও প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য আমদানি করতে পারবে না যে কোনও দেশ। দেশে দেশে চাহিদার কারণে বেড়েছে খাদ্য পণ্যের দাম। তাই ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’– এই নীতিতে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনশীল দেশগুলো দিন দিন আরও কঠোর হবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

খাদ্য, জ্বালানি, ডলারসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী কিন্তু ইতোমধ্যে সফল হতে শুরু করেছে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে সবাই সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নেবে এটাই যৌক্তিক।

যখন আমাদের দেশকেও খাদ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নেওয়ার সময়; ঠিক তখন ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর থাবা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে-কয়ে আসে না, এটা ঠিক। আবার এরকম দুর্যোগ প্রতিরোধের সাধ্যও কারও নেই। তাই এবারের দুর্যোগটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতোই। আমন ফসল কাটার ঠিক আগ মুহূর্তে এরকম মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে কৃষকদের। যা গোটা জাতির জন্য ক্ষতি।

একদিকে প্রলয়ংকরী ঝড়ে অন্তত ৩৫ জন মানুষের প্রাণ গেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ১০ হাজার বাড়িঘর। উপকূলের প্রায় ১৫ জেলা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড।  দুর্যোগের ক্ষত চিহ্ন এখন কিন্তু দেশজুড়েই। অর্থাৎ উপকূলীয় অঞ্চল বলে কথা নয়, এবারের ঝড়ে সারাদেশের ফসলের কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া ১০ লাখের বেশি মানুষ কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। বেশি ক্ষতির মুখে উপকূলের মানুষ এতে কোনও সন্দেহ নেই।

কৃষি অর্থনীতি নির্ভর দেশে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে এক্ষেত্রে একটি ফসল নষ্ট হওয়া এমনিতেই চিন্তার কারণ বটে। যখন খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ সুখকর নয়, ঠিক তখনই এই বিপদ এলো। ঝড়ের দু’দিন পরেও উপকূলের অনেক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে পারেননি। অনেকে স্বজন হারানোর শোকে পাথর। সেই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম তো আছেই। এরমধ্যে যারা ফসল হারিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই অর্থনীতির বাড়তি চাপে থাকবেন।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে খাবি খাওয়ার মধ্যে এই বছরই বাংলাদেশে বন্যা পৌনে লাখ কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। বন্যা বিদায়ের কয়েকমাসের মধ্যেই আঘাত হানল ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। ঝড় কাটার পর ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক চিত্র না মিললেও এতে যে হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে, তা অনুমেয়। কেন না দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির হিসাব দিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। 

আম্পানের মূল ধাক্কা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে গেলেও সিত্রাং পুরোটাই গেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। তবে এর ধ্বংস ক্ষমতা আগের ঝড়টির চেয়ে কম ছিল। আম্পানে ১৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেলেও সিত্রাংয়ে নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে ৩৫ ছাড়িয়েছে, আরও কয়েকজন নিখোঁজও রয়েছেন।

আম্পানে আমের বেশ ক্ষতি হয়েছিল, আর সিত্রাংয়ের সময় ক্ষেতে ছিল আমন ধান। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের মূল জোগানই আসে আমন থেকে। পরিপক্ব এই ধান কাটার সময় যখন হচ্ছিল, তখন ঝড়ের তোড়ে অনেক স্থানেই গাছ নুয়ে পড়েছে। উপকূলে অনেক মাছের ঘেরও ভেসে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্য বলছে, ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি এবং ১ হাজার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ঝড়ে। গবাদি পশুর তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। মোট ৪১৯টি ইউনিয়নে ঝড় ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে। কিছু স্থানে সড়ক ভেঙেছে, বাঁধও ভেঙেছে।

এই পরিস্থিতি সামলে ওঠাও কিন্তু সরকারের জন্য একটা বড় রকমের ধাক্কা। কারণ সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে যেতে সরকারকে প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগ করতে হবে।

পত্রিকার সংবাদ বলছে, ফসলের ক্ষতি হলেও পুরোটা নয়। তবে সার্বিক দিক থেকে ক্ষতি কিন্তু অনেক বেশি। তাই সবার আগে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য আর্থিক সহায়তা সবার আগে জরুরি। তারপর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যত সম্ভব- ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিয়ে আসা প্রয়োজন।

দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির বাজারে এমনিতেই সবাই নিত্যপণ্য কিনতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। মাসের ব্যয়ে কাটছাঁট করতে হচ্ছে অনেককেই। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো যেন কোনোভাবেই মানসিক শক্তি না হারায়। সেই সঙ্গে তারা দ্রুত কৃষি উৎপাদনে ফিরতে পারে। তাই আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি যাদের লোনের প্রয়োজন তাদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি সরকার ও এনজিও সংস্থাগুলো বিবেচনা করতে পারে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও অসহায় মানুষের জন্য সেবার হাত প্রসারিত করতে পারে। এরকম দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সহযোগিতা আরও বাড়ানো দরকার। যেন সবার সহযোগিতায় কৃষকরা মানসিক শক্তি ফিরে পেয়ে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ইরি ফসল থেকে শুরু করে সার্বিক কৃষি উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে পারেন।

মনে রাখা প্রয়োজন, এমনিতেই এনজিও সংস্থাগুলো শত বিপদের মধ্যেও ঋণের কিস্তি নিতে গ্রাহকের বাড়ি গিয়ে বসে থাকে। তাহলে তারা কীভাবে বিনা সুদে লোন দেবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে? এই যৌক্তিক প্রশ্নের সমাধান হলো সরকারকেই এনজিওগুলোকে এ ব্যাপারে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে উপকূলে তিনমাস চলমান ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।

কারণ একটি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সামনের ইরি মৌসুম যেন ভালোভাবে উঠে এ ব্যাপারে এখনই ভাবনা ও প্রস্তুতি থাকা দরকার। পাশাপাশি অন্যান্য কৃষি পণ্য তো রয়েছেই। তাই ইরি ফসলের শতভাগ উৎপাদন সুবিধা পেতে হলে সার, তেলে সরকারকে যত সম্ভব ভর্তুকি দিতে হবে। তা না হলে অনেকেই হয়ত আর্থিক মন্দার মধ্যে ধান চাষে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এতে খাদ্য সংকট আরও প্রকট হবে। অন্যান্য ফসল উৎপাদনে ধাক্কা আসবে। তাই সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে বড় রকমের ভূমিকা পালন করতে পারে। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএম/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ