X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

অদক্ষ চালকের হাতে স্টিয়ারিং

সালেক উদ্দিন
০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৮:৫৩আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৮:৫৩

‘অপ্রাপ্ত বয়স্কদের হাতে লেগুনার স্টিয়ারিং’– ২৩ নভেম্বর একটি দৈনিক পত্রিকার চিঠিপত্রের পাতায় প্রকাশিত একটি পত্রে একজন লিখেছেন, রাজধানীতে বেপরোয়া একটি পরিবহনের নাম লেগুনা, যা সরকারি খাতায় হিউম্যান হলার নামে পরিচিত। ২৫১টি রুটের ১৫৯টিতেই লেগুনা চলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেগুনার চালক ও প্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিশোর। লাইসেন্স ছাড়াই চালকের আসনে বসছে  এই  কিশোর ড্রাইভাররা। ফলে যাত্রীরা নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন এই চালকরা ব্যস্ত সড়কগুলোতে লেগুনা চালাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। জিগাতলা টু ফার্মগেট রোড, ফার্মগেট টু ৬০ ফুট, আজিমপুর ট্যানারি টু নিউ মার্কেট, নিউ মার্কেট টু ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর টু শ্যামলী ইত্যাদি রোডে অবারিত চলাচল এসব লেগুনার। এদের কেন যেন থামাচ্ছে না ট্রাফিক পুলিশ!

পত্রলেখক লেগুনা পরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রশাসনের কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন। পত্রে বর্ণিত ঘটনাটি ঢাকা শহরের অতি পরিচিত ঘটনাগুলোর একটি। সড়কের এসব অব্যবস্থা ও দুর্ঘটনা এবং এর প্রতিকার নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনেই ‘উল্টো পথে চলছে গাড়ি'সহ আমার বিভিন্ন কলামে উল্লেখ করেছিলাম। শুধু আমি একা নই। অনেক কলামিস্ট এ বিষয়ে লিখেছেন। কাজের কাজ কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না।

সড়কে নৈরাজ্যকর অবস্থা নিরসনকল্পে এই কয়েকদিন আগে অক্টোবর মাসের ২২ তারিখে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপিত হলো নিরাপদ সড়ক দিবস। এবারের স্লোগান ছিল ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’। দিনটি উদযাপনকালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তুমুল প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ পাস করা হয়েছিল। ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিতে সে সময় সড়ক ছেড়ে ঘরে ফিরেছিল শিক্ষার্থীরা। আর সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

সমাজের সর্বস্তরে নিয়ম ভাঙার নিয়ম দেখতে দেখতে নিরাপদ সড়ক দিবস এবং তার প্রতিপাদ্যের বিষয় নিয়ে এ বছর আর লিখিনি। পত্রলেখকের আবেদন দেখে মনে হলো বিষয়টি নিয়ে কিছু লেখা দরকার।

একটি দেশের রাজধানী শহরে যদি লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ড্রাইভার বিনা বাধায় লেগুনার মতো একটি পরিবহন অবাধে চালাতে পারে তাহলে সে দেশের  অন্যান্য পরিবহন চলাচলের চিত্র অবশ্যই ভিন্ন নয়। জানুয়ারি ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালে দেশব্যাপী সংঘটিত ৫ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬ হাজার ২৮৪ জন মানুষ। আহত হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৮ জন ।

এই দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা আরও ভয়াবহ হলেও আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই নেই। এসব দেখার জন্য বাইনোকুলারের প্রয়োজন হয় না। কোনও জরিপের প্রয়োজন হয় না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বন্ধ চোখটা খুললেই যথেষ্ট। খালি চোখে যেখানে আমরা দেখতে পাই অপ্রাপ্ত বয়স্ক লাইসেন্সবিহীন শিশু-কিশোররা লেগুনার মতো একটি পরিবহন বেপরোয়াভাবে চালাচ্ছে; এই দৃশ্যটি ট্রাফিক পুলিশের চোখে পড়ে না? তারা তো আরও কাছে! ট্রাফিক রেড সিগন্যালে লেগুনা দাঁড়াচ্ছে। আবার গ্রিন সিগন্যালে লেগুনা দৌড়াচ্ছে বেপরোয়াভাবে। এখানে ট্রাফিক পুলিশ কি আইনি দায়িত্ব পালন করছেন? কেন করছেন না? ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’‌- প্রতিপাদ্যের বাস্তবায়ন কোথায়? আর প্রধানমন্ত্রী যে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য ছয় দফা প্রবর্তন করলেন তারই বা কি হলো!

লেগুনার মতো আরেকটি মারাত্মক বাহনের নাম মোটরসাইকেল। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো ও ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে কতজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তা বিবেচনার বিষয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমান নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি এবং এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৯০৩টি। অর্থাৎ সড়কে অবৈধভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে ১৪ লাখেরও বেশি চালক। অপ্রাপ্ত বয়স্ক লাইসেন্সবিহীন লেগুনার ড্রাইভারদের মতোই লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল চালকরাও বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার মতো মারাত্মক ব্যাধির বাহক।

একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায় ২ হাজার ২১৪ জন। ২০২০ সালের তুলনায় যা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

লেগুনা ও মোটরসাইকেলের মতো বাস ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের সড়ক দুর্ঘটনার নেপথ্যে লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার, অদক্ষ ড্রাইভার এবং দায়িত্বহীনতাই মূল কারণ।

সড়ক দুর্ঘটনায় একটি মানুষের অপমৃত্যু হলে সেই পরিবারের যে কি দুর্বিষহ অবস্থা হয় তা যারা ভুক্তভোগী তারাই জানেন।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠন, সুপারিশকরণ, আইন প্রণয়ন ইত্যাদি বলয়ের মধ্যে আমরা আটকে আছি। এর বাস্তবায়ন নেই। আর বাস্তবায়ন নেই বলেই আজ লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্ত বয়স্করা লেগুনার স্টিয়ারিং, মোটরসাইকেলের স্টিয়ারিং ধরতে পারে। অধিকাংশ যানবাহনের চালকরাই আইন ভাঙার প্রতিযোগিতায় নামতে পারে।

এই অব্যবস্থা নিরসনকল্পে যা যা প্রয়োজন তা-ই করতে হবে। আইনের শতভাগ প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রয়োজন ট্রাফিক বিভাগের সততার, দায়িত্বপরায়ণতার। প্রয়োজন যানবাহনের মালিক চালক এবং সর্বসাধারণের সচেতনতার। আর এই বিষয়গুলো যথাযথভাবে কাজ করলেই লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্ত বয়স্কদের হাতে লেগুনার স্টিয়ারিং যাবে না। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় চলবে না। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানো কমে আসবে। কমবে সড়ক দুর্ঘটনা।

সড়ক অদক্ষ গাড়িচালক মুক্ত হোক- সেটাই কাম্য। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ