X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

৫১ বছরেও রাষ্ট্র চিনলো না তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের

লীনা পারভীন
১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৩২আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:৪৭

কথায় বলে, ‘যার হয় না নয়-এ, তার হয় না নব্বইতে’। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটার জন্ম হয়েছে ৫১ বছর। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া দেশটি আজও সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারছে না কারা সেদিন দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করেছিলো। এদেশের অসংখ্য মানুষ সেদিন কেবলমাত্র নিজের মা রূপি দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে বলে একডাকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাদের একজনও ভাবেননি যে কোনোদিন কেউ তাদেরকে স্বীকৃতি দেবে কী দেবে না। এদেশের ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। নেতার ডাক পেয়েছিলেন দেশকে মুক্ত করতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

তার মানে তো এই না যে নাম পরিচয়হীন হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন এই মানুষগুলো। যারা চলে গেছেন তারাতো চলেই গেছেন কিন্তু যাদের রেখে গেলো তাদেরইবা পরিচয় কী? যেসব পরিবার তাদের একমাত্র সম্বলকে হারিয়েছেন, যেসব সন্তান তাদের জন্মের আগে বা জন্মের পরপরই পিতা বা মাতাকে হারিয়েছেন তাদের কাছে কী জবাব আছে এই রাষ্ট্রের?

দুইদিন পরপর দেখি– ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় নিয়ে নানান ধরনের সংবাদ। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, তালিকা করা নিয়ে এই মঞ্চায়ন যেন শেষই হচ্ছে না। কোনও মুক্তিযোদ্ধা নিজেকে অপমানিত করতে চান না। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন– এটাই তাদের প্রাপ্তি ও তৃপ্তি। মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা, স্বীকৃতি দেওয়া তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এ কাজটি বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে সুষ্ঠুভাবে করতে পারছেন না কেউ।

এই সরকারের সফলতা যদি বলতে হয় তাহলে তালিকার প্রথমেই থাকবে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা। আবার অপরদিকে ব্যর্থতার তালিকা যদি করতে হয় তাহলে সেখানে ওপরের দিকে থাকবে গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে না পারা, খুঁজে বের করতে না পারা ও তালিকাবদ্ধ করে জাতিকে জানাতে না পারা।

‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটা জাতি হিসেবে অত্যন্ত অবমাননাকর ও লজ্জাকর। মুক্তিযোদ্ধা আবার ‘ভুয়া’ হয় কীভাবে?

মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধাই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা নিচু মনের মানুষেরা এই মহান উপাধিটাকেও কলঙ্কিত অরে ফেলেছি কেবল ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ব্যক্তিগত লোভের কারণে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলে একটা আলাদা দফতার আছে, যাদের কাজটা কী সে সম্পর্কে গবেষণার দাবি রাখে। প্রতি বছর মার্চ আর ডিসেম্বর এলেই তাদের একটি করে বক্তব্য পাওয়া যায়। কেন? কারণ এই দুইটা মাসেই আমাদের টনক নড়ে যে আমাদের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধা বলে একদল পাগল মানুষ ছিলেন যাদের চিনে নেওয়াটা জরুরি।

পত্রিকার পাতায় দেখলাম একই পরিবারের পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু তাদের কেউই এখনও স্বীকৃতি পায়নি। অথচ আমরা দেখেছি কত শত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে তালিকায়। একটা সময়তো অনেকের বিজনেস কার্ডে, বাসার গেইটেও মুক্তিযোদ্ধা লেখা দেখা যেতো। ‘শিশু মুক্তিযোদ্ধা’, ‘বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা’ কত শব্দ শুনলাম। অথচ দিনশেষে ফলাফল শূন্য। ডেডলাইন আসে-যায় তালিকার কাজ শেষ হয় না। এরই মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধার জীবনাবসান ঘটেছে। দিন যত যাবে প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা তত কমতে থাকবে। দলিল সংগ্রহের কাজটি কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা কি সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি?

মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো গোটা দেশব্যাপী, তাই মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার কাজটি কোনও নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক হতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কোন ছকে কাজটি করছে জানি না। অগ্রগতি কতটা সে সম্পর্কেও কোনও আপডেট ব্রিফিং দেওয়া হয় না।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চিনে নেওয়াটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এ কথাটি একজন খাঁটি বাংলাদেশি মাত্রই বুঝতে পারার কথা। দেশকে ভালোবাসলে দেশের জন্মের ইতিহাসটিকে সঠিকভাবে জানতেই হবে। অবৈধ ক্ষমতাদখল করা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকেও মুক্তিযোদ্ধা বলা হয় অথচ এ নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। এমন অনেকেই আছেন যারা স্বেচ্ছায় মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়টুকুও এখন দিতে চায় না। এর কারণ বিতর্ক, সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর ধান্দাবাজি।

এই সরকারের কাছেই আমাদের চাওয়ার তালিকা অনেক। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আর কার কাছেইবা চাওয়ার আছে? দেশ স্বাধীনের ৫১ বছরের মধ্যে ৩০ বছর দখল করে রেখেছিলো স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় আমরা সাধারণ মানুষ যেমন আশায় বুক বেঁধেছিলাম তেমনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও বুকে বল পেয়েছিলো। কারণ অন্ধকারের ৩০ বছরে তাদেরকে কেউ খুঁজেনি। অসম্মানিত হতে হয়েছে নানাভাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ মৃত্যু আমরা দেখেছি। বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছেন অনেকেই। রাষ্ট্র খোঁজও নেয়নি।

এমন অবস্থাতো হওয়ার কথা না। অন্তত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এতদিনে একটা মিমাংসা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জাতির মধ্যে বিভক্তির সুযোগ রাখা মানেই স্বাধীনতার স্বপ্ন অর্জিত হয়নি। আমাদেরতো এক জাতি, এক দেশ পরিচয় হওয়ার কথা ছিল। হয়েছি কি? আমরা কি পেরেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দল-মত নির্বিশেষে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে? পেরেছি কি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে? পারিনি। কেন এখনও বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করার সাহস পায়?

বিজয়ের ৫২তম বর্ষ পালন করছি। অথচ এখনও আমাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়া মানুষদের হৃদয়বিদারক ঘটনা পড়তে হচ্ছে, শুনতে হচ্ছে। এ লজ্জা, এ ব্যর্থতা কাদের?

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ বললেন এনসিপি নেত্রী সামান্থা
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ বললেন এনসিপি নেত্রী সামান্থা
মাস্কের নতুন রাজনৈতিক দলকে ‘হাস্যকর’ বললেন ট্রাম্প
মাস্কের নতুন রাজনৈতিক দলকে ‘হাস্যকর’ বললেন ট্রাম্প
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে ড্রাই ডক
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে ড্রাই ডক
ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনে পাঠদান চলছে ৭০০ শিক্ষার্থীর
ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল ভবনে পাঠদান চলছে ৭০০ শিক্ষার্থীর
সর্বশেষসর্বাধিক