সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি পদে জনাব মো. সাহাবুদ্দিনের নির্বাচিত হওয়াকে কেন্দ্র করে একটি আইনগত বিতর্কের উদ্ভব হয়েছে। অনেকের মতে, তিনি ইতোপূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিধায় রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারবেন না। যুক্তি হিসেবে তারা মূলত ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪’-এর ৯ ধারা উল্লেখ করেছেন। উক্ত ধারায় বলা হয়েছে–
‘কর্মাবসানের পর কোনও কমিশনার প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনও লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
তাদের মতে, রাষ্ট্রপতির পদ একটি ‘লাভজনক পদ’ এবং জনাব মো. সাহাবুদ্দিনের দুদক কমিশনার হিসেবে অতীতে দায়িত্ব পালনের দরুন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। এ মতের সমর্থকরা প্রধানত রাষ্ট্রপতির পদ যে একটি ‘লাভজনক পদ’ সে যুক্তি বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন।
সঙ্গত কারণেই আমি উপরিউক্ত ব্যাখ্যার সঙ্গে জোরালোভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। আমি মনে করি যারা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের দোহাই দিয়ে জনাব মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছেন তারা বিষয়টিকে যথাযথ আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে অসমর্থ হয়েছেন এবং সংবিধানের একটি খণ্ডিত ও অতি সরলীকৃত পাঠ উপস্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রপতির পদ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বিতর্কটি লাভজনক পদের সংজ্ঞাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও মূলত তা উক্ত পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রযোজ্য যোগ্যতা-অযোগ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এবং এক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৯ ধারা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ অযোগ্যতা সৃষ্টি করে না। কারণ, উক্ত ধারাটি রাষ্ট্রপতির পদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এছাড়া অন্য কোনও ব্যাখ্যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৯ ধারাকে অসাংবিধানিক হিসেবে প্রতিপন্ন করবে।
আমি আরও মনে করি, রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক কিনা তা নির্ণয় করা সংবিধান কর্তৃক অভিপ্রেত নয়, ফলে আইনগতভাবে নিষ্প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতার কথা বলা আছে। উক্ত দফা অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না, যদি তিনি–
‘(ক) পঁয়ত্রিশ বৎসরের কম বয়স্ক হন; অথবা
(খ) সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য না হন; অথবা
(গ) কখনও এই সংবিধানের অধীন অভিশংসন দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদ হইতে অপসারিত হইয়া থাকেন।’
অর্থাৎ, উপর্যুক্ত শর্তগুলোর ব্যত্যয় রাষ্ট্রপতি পদে কোনও ব্যক্তির নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধান কর্তৃক অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন প্রশ্ন হলো, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ৯ ধারা, যা কিনা একটি সংসদ প্রণীত আইন তার দ্বারা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত যোগ্যতার অতিরিক্ত কোনও শর্ত আরোপ করা যায় কিনা? এর উত্তর হলো– সংসদ-প্রণীত আইন দ্বারা সংবিধানে বর্ণিত কোনও পদের জন্য সংবিধান নির্ধারিত যোগ্যতা বা অযোগ্যতার অতিরিক্ত কোনও শর্ত আরোপ করা যায় না, যদি না সংবিধান স্বয়ং তার অনুমোদন দেয়। কারণ, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং কোনও আইন যদি এই সংবিধানের সাপেক্ষে অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় বর্ণিত শর্তাবলি প্রত্যক্ষভাবে সংসদ-প্রণীত আইনের দ্বারা পরিবর্তন করা না গেলেও এর ‘খ’ উপদফার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সংসদ প্রণীত আইন দ্বারা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য শর্ত আরোপ করা যেতে পারে।
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৪) দফার (খ) উপদফা অনুযায়ী সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য অযোগ্যতা সংক্রান্ত বিধানাবলি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রযোজ্য হবে। আবার ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার (ছ) উপদফা অনুসারে আইন দ্বারা সংসদ নির্বাচনের জন্য অযোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে। অর্থাৎ, সংসদ-প্রণীত আইন দ্বারা সংসদ নির্বাচনের জন্য যদি কোনও অযোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়, তবে তা রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ৯ ধারা সংসদ-সদস্য পদপ্রার্থীর জন্য অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা? যদি হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এজন্য আমাদের দেখতে হবে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৯ ধারায় বর্ণিত ‘প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনো লাভজনক পদ’ কথাটি দিয়ে সংসদ-সদস্য পদ বোঝায় কিনা? যুক্তিগ্রাহ্যভাবে, সংসদ-সদস্য পদ ‘প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনো লাভজনক পদ’ নয়, বিধায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৯ ধারা সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার (ছ) উপদফার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রণীত আইন নয় এবং সেজন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের পূর্বোক্ত ধারাটি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
ওপরের আলোচনা ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য আরও কতগুলো বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, যথা- ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনও লাভজনক পদ’ বলতে কী বোঝায় এবং রাষ্ট্রপতি বা সংসদ-সদস্যের পদ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনও লাভজনক পদ’ হিসেবে গণ্য হবে কিনা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানে ‘লাভজনক পদের’ কোনও সংজ্ঞা নেই, অথচ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ শব্দটির সংজ্ঞা আছে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ বলতে অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার-সংক্রান্ত যেকোনও কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হতে পারে এমন কোন কর্ম বোঝাবে। ১৫২ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত প্রজাতন্ত্রের কর্মের সংজ্ঞার মর্মার্থ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করার জন্য সংবিধানের নবম ভাগে বর্ণিত ১৩৩-১৩৫ অনুচ্ছেদের সাহায্য নিতে হবে। সংবিধানের নবম ভাগের শিরোনাম হলো বাংলাদেশের কর্মবিভাগ বা দ্য সার্ভিসেস অব বাংলাদেশ। এ ভাগের অন্তর্ভুক্ত ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে সংসদ-প্রণীত আইনের দ্বারা কিংবা এর অবর্তমানে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধি দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রিত হবে। ১৩৪ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। আবার ১৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করে বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাবে না।
উপরিউক্ত বিধানসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়, প্রজাতন্ত্রের কর্ম অর্থে সংবিধানের নবম ভাগ প্রযোজ্য হয় এমন সব পদ, কার্য, দায়িত্ব ইত্যাদি বোঝাবে। তদানুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদ’ বলতে সংবিধানের নবম ভাগ প্রযোজ্য হয় এমন লাভজনক পদ বোঝাবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের নবম ভাগ রাষ্ট্রপতি বা সংসদ-সদস্যের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৯ ধারায় বর্ণিত ‘প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনও লাভজনক পদ’ অর্থে সংসদ-সদস্য বা রাষ্ট্রপতির পদ বোঝানোর কোনও সুযোগ নেই। অর্থাৎ দুদক কমিশনার পদে অতীতে দায়িত্ব পালন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হতে পারে না।
সবশেষে রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক কিনা সে প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সংবিধানে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক পদ হিসেবে গণ্য হবে না। তার একটি হলো সংসদ-সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কিত ৬৬ অনুচ্ছেদ। অপরটি হলো সংবিধানে উল্লিখিত কতিপয় বিশেষ পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত ব্যক্তির পারিশ্রমিক, বিশেষ-অধিকার ইত্যাদির শর্ত সম্পর্কিত ১৪৭ অনুচ্ছেদ। বিশেষ করে শেষোক্ত অনুচ্ছেদটি উল্লেখযোগ্য কারণ লাভজনক পদের ধারণার সঙ্গে পারিশ্রমিক ইত্যাদির সম্পর্ক আছে। এসব বিধান থেকে প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রপতির পদের প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংবিধান আইনগত অনুমান বা লিগাল প্রিজাম্পশনের আশ্রয় নিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আইনগত অনুমান বাস্তবানুগ হওয়া অনাবশ্যক। রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক কিনা সে প্রসঙ্গে যেহেতু সংবিধান কর্তৃক নির্দেশিত আইনগত অনুমান বিদ্যমান, তাই তা প্রশ্নযোগ্য বা খণ্ডনীয় নয়। সুতরাং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত যেসব প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে তাদের সমাধান বের করার জন্য রাষ্ট্রপতির পদটি আদৌ লাভজনক পদ কিনা তা নির্ণয় করা আইনগতভাবে একান্তই অপ্রয়োজনীয়।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ।