X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বাংলা ভাষার 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'

বুলবুল হাসান
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৯:৩৭আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৯:৪১

বুলবুল হাসান একুশ- গত ছয় দশকেরও বেশি সময়, আমাদেরকে নানাভাবে বিকশিত করে চলেছে। বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি আজও অনুপ্রেরণা। বায়ান্নোর ফেব্রুয়ারি মাসের বিশেষ ওই দিনটিকে কেবলমাত্র বাংলা ভাষার উত্থানদিবস হিসেবে গণ্য করার সুযোগ নেই; বরং তা ছিলো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্বীকৃত সূচনাপর্ব। একটি অনাধুনিক, হিংস্র ও সামন্তমনা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ভৃত্যের মতো টিকে না থেকে নিজের স্বকীয়তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার অভাবিত এক অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ মানেই অচলায়তন ভেঙে তারুণ্যের জেগে ওঠা; একুশ মানে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর বিপরীতে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। একুশ এলেই হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে অনুরণিত হতে থাকে শেকল ভাঙার গান।
১৯৫০-এর গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলিম সমাজে মননচর্চার একটি বড়ো অংশ জুড়েই ছিলো শিল্পহীন 'পাকিস্তানস্তুতি'। বাঙলা ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর তখন ভর করেছিলো মধ্যযুগের অন্ধকার। আধুনিক জীবনবোধ নয়, বরং 'কায়েদে আজম' নিয়ে পদ্য রচনাই ছিলো পাকিস্তানপর্বের বাঙলা সাহিত্যে কাব্যসৃষ্টির প্রধান অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলন সেই প্রবনতাকে ভেঙেচুরে আধুনিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। যার ছোঁয়া এসে লাগে চিত্রকলা, নাটক ও সঙ্গীতে। তবু গত কয়েক দশকের পথ চলায়, বাঙলা ভাষা পুরোপুরি পরিস্রুত হয়ে উঠতে পারেনি। পাশাপাশি, রাষ্ট্র ও সমাজের শাখা-প্রশাখায় বাংলা আজও তার নিজস্ব শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ইংরেজির আধিপত্য আর আমাদের এক ধরনের দাস মানসিকতার কারণে ভাষা হিসেবে বাংলার প্রত্যাশিত বিকাশ ঘটেনি।
শুরুতেই স্পশ্ট করা দরকার, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কিংবা সেটির ব্যবহারিক বাস্তবতাকে আমি কখনওই অস্বীকার করি না। আমি নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র; নির্দ্বিধায় বলতে পারি- এই ভাষাটা না জানলে হয়তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব সাহিত্যকর্মের অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত। তবে তার অর্থ এই নয় এই ভাষাটা আমাদের মনোজগতে এক ধরনের উপনিবেশ তৈরি করবে। বায়ান্নোর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিলো, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের যাপিত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সেটির চর্চা করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই কাজটি করতে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সমাজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ক্ষমাহীন উদাসীনতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি এখন কেবলমাত্র উদযাপনের একটি উপলক্ষ। কিন্তু বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি কিংবা বিকাশে আমরা কতটা আগ্রহী তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

একটি ভাষাকে তার নিজস্ব শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হলে, সেই ভাষাকে যে জাতি ধারণ করে তাকে আধুনিক ও মননশীল হতে হয়। ইংরেজি ভাষার বিশ্বব্যাপী এই যে আধিপত্য, তার গোড়ায় রয়েছে ইংরেজি ভাষাভাষী রাষ্ট্রসমূহের দীর্ঘদিনের সাধনা এবং মৌলিক চিন্তাধারার প্রকাশশক্তি। এক্ষেত্রে অবশ্য ভাষার বাণিজ্যিক দিকটাকেও অস্বীকার করা যাবে না। ইংরেজি ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নয়া 'ইস্ট ইন্ডিয়া' কোম্পানির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি থেকে শুরু করে জ্ঞানচর্চার প্রায় প্রতিটি স্তরে ইংরেজি ভাষা গত কয়েকশ' বছর ধরে তার অন্তর্গত শক্তি ও সামর্থ্যকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। আর এই জায়গাটিতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এক ধরনের সামন্তমনা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলা ভাষাকে আমরা 'অনগ্রসর শ্রেণি'র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। রাষ্ট্র কিংবা সমাজের উঁচুতলার মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ইংরেজিকেই আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যম বলে মনে করেন। যদিও তাদের অনেকেই দু'লাইন শুদ্ধ ইংরেজি বলতে বা লিখতে অক্ষম!

আমার ব্যক্তিগত ধারণা, একটি বদ্ধ সমাজে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো অনেকটা দূরাশার মতো। মাতৃভাষার চর্চা এবং এর মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা ক্ষমতাকাঠামোর নিয়ন্ত্রকদের রয়েছে রহস্যময় নির্লিপ্ততা। আদালতের রায় থেকে শুরু করে সরকারি প্রজ্ঞাপন-বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার যে মলিন-অসহায় চেহারা প্রতিনিয়তই ফুটে উঠছে, তা আমাদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটিকে লেখা হয়েছে 'বিশ্ব বিদ্যালয়'! পত্রিকার খবরেই জানতে পারি, ভুল বানানে লেখা ওই সাইনবোর্ড গত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শোভা পাচ্ছে। বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও, গত কয়েক দশক ধরেই অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে ভুল বানানের মহোৎসব। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে ঘটা করে যেসব পুষ্পস্তবক নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেও 'শ্রদ্ধাঞ্জলি' লিখতে গিয়ে চলতে থাকে বানান ভুলের বেদনাদায়ক মহড়া।

গত সপ্তাহে বিবিসি রেডিও'র বাংলা সার্ভিসে প্রচারিত হয় বইমেলা নিয়ে একটি প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয়, একুশের বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অপাঠ্য। ভুল বানান, অবিন্যস্ত ভাষার ব্যবহার এবং আধেয় বিবেচনায় ওগুলো কিভাবে বইমেলায় স্থান পেল সেটাই এক বিস্ময়।

আমরা প্রায়শই বলে থাকি, বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে রয়েছে বাংলা ভাষা; অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন। কাজেই বাংলা কেবলমাত্র আমাদের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা আমাদের জীবনচর্চার সঙ্গেও মিশে আছে। বাংলাকে বাদ দিয়ে আমাদের নিজস্বতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরও বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় কিংবা সমাজ জীবনের প্রধান ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণি থেকে শুরু করে শ্রমজীবি সম্প্রদায় শুদ্ধ বাংলা নয়, বরং ভুল ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেও এক ধরনের গৌরব বোধ করেন। গণমাধ্যমে চলছে ইংরেজি ও বাংলার অদ্ভুত এক মিশেল। আমাদের সাহিত্য, বিশেষত কবিতা ও উপন্যাস, বাংলা ভাষাকে যতটা বিকশিত করেছে তা যদি তরুণ-প্রজন্ম গ্রহণ করতো তাহলে হয়তো সংস্কৃতিগতভাবে আমাদেরকে এই বনসাঁই জীবনযাপন করতে হতো না। আমি জানি, ঔপনিবেশিকতার ঘোর কাটতে আমাদের হয়তো আরও কয়েক দশক সময় লাগবে। তবু হঠাৎ, খানিকটা নিভৃতে, নিজের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে- এই ঘোর কাটবে তো?

 

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আইনের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার দরকার: কাজী নাবিল আহমেদ
স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আইনের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার দরকার: কাজী নাবিল আহমেদ
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকছে ভারী অস্ত্র
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢুকছে ভারী অস্ত্র
ছেলের এভারেস্টজয়ে বাবার মুখে হাসি, মা বললেন দুশ্চিন্তায় আছি
ছেলের এভারেস্টজয়ে বাবার মুখে হাসি, মা বললেন দুশ্চিন্তায় আছি
ঋণ খেলাপের দায়ে স্ত্রী-ছেলেসহ স্টিল মিল মালিকের কারাদণ্ড
ঋণ খেলাপের দায়ে স্ত্রী-ছেলেসহ স্টিল মিল মালিকের কারাদণ্ড
সর্বশেষসর্বাধিক