X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জ তামিমের, লাভ বাংলাদেশের

প্রভাষ আমিন
০৮ জুলাই ২০২৩, ২১:২৪আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২৩, ২১:২৪

আফগানিস্তান সিরিজের প্রথম ম্যাচের পরদিন বাংলাদেশের অধিনায়ক তামিম ইকবাল যখন সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন; তখনই ধারণা করা হচ্ছিল বড় কোনও ঘোষণা আসছে। সেই বড়টা কত বড়, তা নিয়ে রাতভর নানান হিসাব নিকাশ চলেছে। সিরিজের বাকি দুটি ম্যাচ নাও খেলতে পারেন, অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে পারেন, এমনকি অবসরের ঘোষণাও দিতে পারেন। শেষ পর্যন্ত কান্নাভেজা সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সেরা ওপেনার শুধু নন, সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল ঘোষণা দিয়ে বসলেন অকাল অবসরের।

তামিম বলেছেন বটে, তিনি অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে বুঝতে কারোই অসুবিধা হয়নি, অবসরের ঘোষণার পেছনে এক সাগর অভিমান আছে। যার কিছুটা চোখের জল হয়ে ঝরেছে সংবাদ সম্মেলনে, যা কাঁদিয়েছে বাংলাদেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীকেও। তামিম ইকবাল অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পাখির চোখ করেছেন বিশ্বকাপকে। তামিমের অবসরের পর আরেক সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল ফেসবুক লাইভে বলেছেন, তামিম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে বলে যাবেন, আমরা বিশ্বকাপ জিততে যাচ্ছি। আরেক সাক্ষাৎকারে তামিম নিজে বলেছেন, ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত খেলার ইচ্ছা তার। ওয়ানডেতে ১০ হাজার রান করার ইচ্ছা তার।

ক্যারিয়ার নিয়ে যার এত পরিকল্পনা, তিনি কেন সিরিজের মাঝখানে অবসর নিয়ে ফেলবেন। বিষয়টা যে অস্বাভাবিক সেটা বুঝতে কারও বেগ পেতে হয়নি। তাই দেশজুড়ে একটা হাহাকার তৈরি হয়। সেই আবেগ ছুঁয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনাকেও। বোর্ডের কেউ যখন তামিমের টিকির নাগালও পাচ্ছিলেন না। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকে এনে অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি তামিম ইকবালকে দেড় মাসের ছুটি দিয়েছেন। এই সময়ে তামিম চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে এশিয়া কাপে আবার দলে ফিরবেন।

তামিম ইকবালকে ২৮ ঘণ্টার টানটান থ্রিলারের সমাপ্তি ঘটেছে। তবে তামিম এমন সমাপ্তি চাননি। অবসরের সংবাদ সম্মেলনে তামিম অনুরোধ করেছিলেন, তার বিষয়টা নিয়ে যেন আর ‘গুতাগুতি’ না করা হয়। পুরো বিষয়টার যেন এখানে ‘দ্য ইন্ড’ হয়। কিন্তু তামিম চাইলেই তো হবে না। বরং তামিমের অবসরের ইস্যু জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর কাড়ে। খেলা বিষয়ক সকল গণমাধ্যমে তামিম ছিলেন শীর্ষ খবর। বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম তো তিনদিন ধরে তামিমময়। এর রেশ চলবে আরও অনেকদিন।

আপাতত মনে হতে পারে, তামিম ইস্যুর ‘মধুরেন সমাপয়েৎ’ হয়েছে। তবে আমার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। প্রথম কথা হলো, পুরো ব্যাপারটায় আবেগ ছিল, কিন্তু পেশাদারিত্ব ছিল না। পরিস্থিতি যাই হোক, একজন অধিনায়ক সিরিজের মাঝখানে অবসরের ঘোষণা দিতে পারেন না। সব অভিমান, ক্ষোভ, বঞ্চনা বুকে চাপা দিয়ে একজন পেশাদারকে পারফর্ম করে যেতে হয়। তামিমের উথাল-পাথাল আবেগের কাছে পেশাদারিত্ব মার খেয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি আবেগতাড়িত মানুষ। তামিমের জায়গায় আমি থাকলেও তাই করতাম। কিন্তু তামিম তো আর আমি নই।

বাংলাদেশের অধিনায়ক। তার কাছ থেকে আমি অন্তত আরও বেশি পেশাদারিত্ব আশা করেছিলাম। তবে তামিম যে আবেগতাড়িত মানুষ সেটা তো আমরা সবাই জানি। আর এই আবেগের কারণেই তামিম আমাদের প্রিয়। লর্ডসে ঘোষণা দিয়ে সেঞ্চুরি করার পর নিজের নাম অনার্স বোর্ডে লিখতে বলা পাগলাটাই তামিম। পরপর চারটা হাফ সেঞ্চুরি করে সমালোচনার জবাব দেওয়ার পর আঙুল গুণে সেটা দেখানোটাই তামিম। তবে ক্রিকেটে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত এক হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে তামিমের ব্যাট করতে নেমে যাওয়া। আমরা ক্রিকেটকে যতটা ভালোবাসি, তারচেয়ে বেশি ভালোবাসি বাংলাদেশকে।

ক্রিকেটের পথ ধরে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হয় বলেই আমরা ক্রিকেটকে এত ভালোবাসি। একসময় বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ফুটবল। সাফল্যের পথ ধরেই ক্রিকেট ফুটবলকে টপকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছে। তাই তামিম যখন এক হাতে ব্যাট করতে নামেন, সেখানে পেশাদরিত্বের চেয়ে দেশপ্রেমটাই গুরুত্ব পায়। তামিমের এক হাতে ব্যাট করায় আবেগই ছিল, পেশাদারিত্ব নয়।

পেশাদারিত্বের কোনও সংজ্ঞাই কাউকে এক হাতে ব্যাট করতে নামাকে অনুমোদন করতো না। তাই তামিমের এক হাতে ব্যাট করতে নামাকে যখন আমরা পেশাদারিত্বের পাল্লায় মাপিনি, এখন কেন তার অবসরের সিদ্ধান্তকে পেশাদারিত্বের নিক্তিতে মাপতে চাচ্ছি।

তামিম তার ঘোষণায় অবসরের কোনও কারণ বলেননি। কিন্তু বাংলাদেশের সবাই কারণগুলো জানেন। একসময়ের ঘনিষ্ট বন্ধু সাকিবের সাথে তার দূরত্ব, তামিমকে কোনঠাসা করে সাকিবকে অধিনায়ক বানানোর চেষ্টা, কোচের সাথে তার দ্বিমত, গণমাধ্যমে তামিমকে নিয়ে বিসিবি প্রধানের উষ্মা প্রকাশ, নিজের ইনজুরি, ফর্মহীনতা- সব মিলিয়েই তামিম সিরিজের মাঝখানে অবসরের মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের আগে দলীয় ফিজিও তামিমকে ফিট ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তামিম নিজে বলেছিলেন, তিনি শতভাগ ফিট নন। আসলে অনেকদিন ম্যাচের বাইরে থাকা তামিম ফিটনেস বলতে শুধু ফিজিক্যাল ফিটনেস নয়, ম্যাচ ফিটনেসের কথাও বলেছিলেন। তাতেই ক্ষুব্ধ হন কোচ হাথুরুসিংহে। ফোন করে কান ভারি করেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের। আর পাপনও তামিমের কোনও কথা না শুনেই মিডিয়ায় তামিমের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিষ উগড়ে দেন। তাতেই এসেছিল এই অকাল অবসর।

একটা দলে অনেক ভালো খেলোয়াড় থাকলেই সাফল্য আসে না। দলটাকে আগে দল হয়ে উঠতে হয়। তাই দলের সিনিয়র মোস্ট দুই খেলোয়াড়ের মধ্যে ঘোষিত দ্বন্দ্ব না মেটালে ড্রেসিং রুমের পরিবেশ ভালো হবে না কখনোই, দলের পারফরম্যান্সেও ভালো হবে না। তাই সাকিব-তামিমের বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনাটা বাংলাদেশের জন্য অতি জরুরি। মাশরাফি হোক, পাপন হোক; কাউকে না কাউকে এ দায়িত্বটা নিতে হবে। কোচেরও উচিত দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাড়ানো। কথায় কথায় বিসিবি সভাপতির কাছে বিচার দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। আর বিসিবি সভাপতিকে হুটহাট মিডিয়ায় কথা বলা, বিশেষ করে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে, চিরতরে বন্ধ করতে হবে। দল নিয়ে বিসিবি সভাপতির নাক গলানো বন্ধ করতে হবে। তামিমের ফিটনেস নিয়ে পাপন মিডিয়াতে যা বলেছেন, তা তামিমকে বললেই তো জল এত দূর গড়াতো না।

বিসিবি যখন তামিমের নাগালই পাচ্ছিল না, তখন প্রধানমন্ত্রীর সম্পৃক্ত হওয়ার আর কোনও বিকল্প ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মাশরাফিকে দিয়ে তামিমকে ডেকে পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ফেলতে পারেননি তামিম। ক্রিকেটে কে অবসর নেবে না নেবে তাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপটা ক্রিকেটের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু যাকে যা দায়িত্ব দেওয়া আছে, তিনি যদি তা না পারেন, তাহলে তো প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিতেই হয়। শেখ হাসিনা ক্রীড়ানুরাগী, বিশেষ করে ক্রিকেটের সব খেলা তিনি দেখেন। ক্রিকেট নিয়ে তার ভালোবাসাও অপরিসীম। কিন্তু ক্রিকেটের ইস্যু ক্রিকেটকেই সমাধান করতে হবে। সব কাজে প্রধানমন্ত্রীকে না টানাই ভালো।

বাংলাদেশের সেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। শুধু ওপেনার নন, পরিসংখ্যান বলবে তিনি বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানও। সব ব্যাটিং পরিসংখ্যানেই তামিমের জয়জয়কার। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান (৮৩১৩), আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান (১৫১৪৮), আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি (২৫), আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৫০ ছাড়ানো ইনিংস (১১৯), ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি (১৪), টি-২০তে বাংলাদেশের একমাত্র সেঞ্চুরি- সবই তামিমের। পরিসংখ্যান আরও অনেক লম্বা করা যাবে। কিন্তু তামিমকে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যাবে না। তামিম যে স্টাইলে ১৫ হাজার রান করেছেন, সেটা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশকে। ২০০৭ সালে ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া ফিফটি, সেই ম্যাচে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেট ছক্কা মারা তামিমকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, এটা ঠিক। বয়স তার আক্রমণের ধার অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে তামিমের ফর্মও তার পরিসংখ্যানের সমান্তরাল নয়। কিন্তু ক্রিকেটে একটা কথা আছে, ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট। তামিমের ক্লাস নিয়ে কারও কোনও সংশয় নেই। ইনজুরি কাটিয়ে ফর্ম ফিরে পেলে তামিম বাংলাদেশের সম্পদ।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অবসর প্রত্যাহার করা তামিমের সামনে এখন বিশাল চ্যালেঞ্জ। তামিমকে মনে রাখতে হবে, এখন তাকে ইনিংস বাই ইনিংস নয়, মাপা হবে বল বাই বল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ হাজার রান করা তামিমের মতো একজন লড়াকুর পক্ষেই সম্ভব সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। অতীতে অনেকবার পারফরম্যান্স দিয়ে সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। সময় এসেছে শেষ লড়াইয়ে নামার। তামিম যদি চ্যালেঞ্জে জেতেন তাতে লাভ হবে বাংলাদেশের।

পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের অনুরোধে অবসর থেকে ফিরে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ইমরান খান। তামিম ইকবাল খান তেমন কিছু না করুক, বিদায়ের আগে বাংলাদেশকে একটা স্মরণীয় বিশ্বকাপ উপহার দিয়ে যাক, এটাই সবার প্রত্যাশা। আহত বাঘ যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তামিম যেন বিশ্বকে সেটাই দেখিয়ে দিয়ে যান।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ