X
রবিবার, ০৪ মে ২০২৫
২১ বৈশাখ ১৪৩২

এশিয়ার জয়রথ দিগ্বিদিক

হায়দার মোহাম্মদ জিতু
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:১৩আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:১৩

আন্তর্জাতিক কূটনীতির মূল উদ্দেশ্য পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও সুরক্ষিত রাখা। এক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দরকষাকষিতে এগিয়ে থাকে। একবিংশ শতকের এই বিশ্ব ব্যবস্থায় বহু মেরুর চল শুরু হয়েছে। কিন্তু এরপরও আমেরিকা তার একাধিপত্য জারি রাখতে চাইছে এবং নিজেদের সাপ্লাই চেইন ধরে রাখতে কৌশল হিসেবে নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে ব্যবহার করছে। এসবই আসলে বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা।

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস নিরীক্ষা করলে, প্রতি ১০০ বছর পর পর বৈশ্বিক ক্ষমতার মেরু বদলেছে। আমেরিকা যে পৌরষত্ব নিয়ে বিংশ শতক শাসন করেছে সেই যৌবন এখন মধ্য গগনে। তাছাড়া ‘কনফ্লিক্ট অ্যান্ড ওয়েপন্স সেল’ তত্ত্ব সম্পর্কেও বিশ্ব বুঝে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা চাঙা করতে আমেরিকার এখন কয়েকটি যুদ্ধের ফ্রন্ট খোলা প্রয়োজন। যেখানে দেদার সাহায্যের নামে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে। আমেরিকা সে জন্যেই প্রথমে ইউক্রেন ও এখন তাইওয়ান পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজেদের দ্বন্দ্ব-সংকট নিজেরাই নিরসন করতে উদ্যোগ নিচ্ছে এবং একটা আঞ্চলিক বাজার ব্যবস্থা তৈরির পথে এগোচ্ছে। প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে, মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ইরাক-ইরান। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধ বন্ধ করে এরা এখন পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছে। ইরান-সৌদি আরব দ্বন্দ্বে যেখানে সিরিয়া, ইয়েমেনসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল, সেখানে চীনের মধ্যস্থতায় তারাও এক টেবিলে বসেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা দূতাবাসগুলোকে চালু করে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বাণিজ্য সহযোগিতায় মনোনিবেশ করেছে।

আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। জাতীয়তাবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গোটা আফ্রিকা এখন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে নিজেদের এত এত সম্পদ থাকার পরও তারা কেন এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে? সাম্প্রতিক নাইজারের অবস্থা সম্পর্কে বিশ্লেষণে জানা যায়, নাইজার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ একটি দেশ। এর থেকে উত্তোলিত ইউরেনিয়াম যেত ইউরোপের পারমাণবিক চুল্লিগুলোতে। যা তারা একেবারে নামমাত্র মূল্যে সংগ্রহ করতে পারতো। এটা করতে পারার কারণ ফ্রান্স। ফ্রান্স তার সাবেক এই কলোনি রাষ্ট্রের সাথে স্বাধীনতা প্রদানের বিনিময়ে চুক্তি করেছিল যে নাইজারের সমস্ত ব্যবসায় সর্বপ্রথম ফ্রান্স অগ্রাধিকার পাবে। যদি কোনও কারণে কোনও ব্যবসা ফ্রান্স করতে না চায়, শুধু সেক্ষেত্রে নাইজার দ্বিতীয় কাউকে চিন্তা করতে পারবে।

স্বাধীন ব্যবসার নামে এ ধরনের কৌশলসম্পন্ন শোষণের খপ্পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ বহু অঞ্চল বের হতে শুরু করেছে। এ জন্য ওই অঞ্চলের দেশগুলো পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে আরও মনোযোগী হয়েছে। ফলে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির বাজার ছোট হয়ে আসছে। এ জন্য আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে রুষ্ট হয়ে তাদের টার্গেট এখন এশিয়া। এই অঞ্চলের মানুষ যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসে বেশি প্রভাবিত। তাছাড়া ঔপনিবেশিক শাসকরা বিতাড়িত হবার পূর্বে সীমানাগত কিছু সমস্যাও রেখে গেছে। সেই পথ ধরেই এগোতে চাইছে অস্ত্র বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই অভিযোগ করেন, জো বাইডেনের নির্বাচনি তহবিলে অস্ত্র বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আছে। এ জন্য সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হলেও জো বাইডেনকে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া এশিয়ার মতো এত বড় একটা অঞ্চল যেভাবে বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থা দখল করছে তাও আমেরিকার জন্য শঙ্কার। অন্যদিকে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা স্কলারশিপ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইতোপূর্বে আমেরিকা যেভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেছে এবং উদ্ভাবনী ব্যবস্থায় একচেটিয়া রাজত্ব করেছে সেও কমে এসেছে। ভারত-চীন-রাশিয়া  নানা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বৈশ্বিক এই ট্যালেন্ট হান্টের প্রতিযোগিতাও প্রায় ধরে ফেলেছে।

জঙ্গিবাদের ধোঁয়া তুলে দেশে-বিদেশে আক্রমণের যে নজির আমেরিকা সৃষ্টি করেছিল সেটাও তার গ্রহণযোগ্যতাকে অনেকাংশে নষ্ট করেছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ হটানোর নামে আক্রমণ এবং কিছুকাল গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ও মানবাধিকারের নামে থেকে শেষমেশ সেই তালেবানদের হাতেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে আমেরিকা যেভাবে রাতারাতি বেরিয়ে এসেছে, সেটাও বিশ্ববাসীর চোখে লেগেছে। বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের কথা বললেও মিয়ানমার নিয়ে সবসময় পাশ কাটিয়ে গেছে। কারণ সামরিক জান্তার সাথে করা অস্ত্রচুক্তি। অর্থাৎ আমেরিকার যে কোনও চিরস্থায়ী নীতি নেই, আছে শুধু স্বার্থ, সেটাও বিশ্ব বুঝেছে।

আমেরিকা চাইলেও এশিয়াকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। কারণ, এশিয়ার প্রায় ৪০০ কোটি জনসংখ্যা বাদ দিয়ে পৃথিবী কল্পনা করা অসম্ভব। এশিয়ার বাজারের প্রভাব কতখানি তার প্রমাণ মিলে ইংলিশ ফুটবল প্রিমিয়ার লীগ থেকে। এই অঞ্চলের সাথে খেলার সময়কে সহনীয় করবার জন্য ইংলিশ লীগও তাদের সময়কে উঠানামা করে। এ অঞ্চলের আগামী নেতৃত্ব দিবে চীন-ভারত-বাংলাদেশ। এই ত্রিদেশীয় সাপ্লাই চেইন হবে বিশ্বশক্তির মূল। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতেও এই অঞ্চল যেভাবে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে, সেটা তার প্রমাণ। সেই সম্ভাবনাস্থল থেকে ত্রিদেশীয় সীমান্ত সমস্যাগুলোকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতি থাকা অবস্থায়ই সমাধান করতে হবে। যেন তা কখনোই কোনও সংঘাত বা সংঘর্ষে রূপ না নেয়।

চীন ও ভারতের মধ্যে বিতর্কিত সীমান্ত তিনটি এলাকায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে লাদাখকে ঘিরে ওয়েস্টার্ন সেক্টর। দ্বিতীয়টি তিব্বতের লাগোয়া হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য নিয়ে তৈরি সীমানা ও তৃতীয়টি অরুণাচল সীমান্তে থাকা ইস্টার্ন সেক্টর। চীনের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র মিয়ানমারের সাথে রয়েছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে চীন তেমন জোরালো ভূমিকা নেয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৪১৫৬ কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে।

প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত ভৌগোলিক, জনসংখ্যা, সম্পদ সবদিক থেকেই শক্তিশালী। প্রতিবেশী শক্তিশালী হলে তা অন্য প্রতিবেশীর জন্য ভালোই হয়, যদি তাদের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক থাকে। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত তো রক্তের অংশীদারিত্বে বাঁধা। কাজেই শুধু বাংলাদেশকে নয়, ভারতকেও মনে রাখতে হবে শুধু তারা নয়, বাংলাদেশও তার তিনদিকে। কাজেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ, অভিন্ন নদীগুলোর পানির যথার্থ বণ্টন অর্থাৎ সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে আসছে সময়টায় সম্পর্কটা আরও ঝালিয়ে নিতে হবে। চীনকেও তাই।

আগামীর বিশ্বনেতৃত্ব ও এই অঞ্চলের জনগণের কথা ভেবে কারও ফাঁদে নয়, বরং নিজেদের মাঝে আঞ্চলিক বাজার ব্যবস্থা, অভিন্ন মুদ্রানীতি ও বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ধরে রাখতে একটা বাণিজ্যরুট করতে হবে। যেন যেকোনও নিষেধাজ্ঞা বা ছলনায়ও এশিয়া তার গতি ধরে রাখতে পারে। এজন্য প্রতিবেশীদের মাঝে পারস্পরিক বিশ্বস্ততার জায়গা আরও পোক্ত করতে হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে: মির্জা ফখরুল
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে: মির্জা ফখরুল
ফিলিপাইনের বিমানবন্দরে গাড়িচাপায় শিশুসহ নিহত ২
ফিলিপাইনের বিমানবন্দরে গাড়িচাপায় শিশুসহ নিহত ২
ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলার ঘটনায় বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা গ্রেফতার
ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলার ঘটনায় বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা গ্রেফতার
সাহিত্য মহৎ মনোচিকিৎসক : ওলগা তোকারচুক
সাহিত্য মহৎ মনোচিকিৎসক : ওলগা তোকারচুক
সর্বশেষসর্বাধিক