X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার ভিসা পাওয়ার নয়া তরিকা!

প্রভাষ আমিন
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৫৮আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৫৬

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। নতুন ভিসানীতিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। ঘোষিত নীতি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

নতুন এই ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কারও কারও মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। যারা পরিবার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করছিলেন, এরই মধ্যে পরিবারের কাউকে কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যারা বাংলাদেশে দুর্নীতি করে কামানো অর্থে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনেছেন, সম্পদ গড়েছেন, আতঙ্কটা তাদের মধ্যেই। নিজেদের উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত; আতঙ্কটা তাদের মধ্যেই। মার্কিন ভিসানীতির ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশে দারুণ বদল এসেছে। বিরোধী দলগুলো এখন অনেকটা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে। মত প্রকাশেও বাধা অনেক কম। তবে মার্কিন এই ভিসানীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও মাথাব্যথা নেই। এই ভিসানীতি বড় জোর কয়েক হাজার মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে। কোটি কোটি সাধারণ মানুষের তাতে কিছুই যায় আসে না।

নতুন ভিসানীতি নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও মার্কিন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের কোটি মানুষের প্রবল মাথাব্যথা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবার কাছেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বপ্নের দেশ। সারা জীবন বাম রাজনীতি করেছেন, এমন কাউকে রাশিয়া এবং আমেরিকাকে বেছে নিতে বললে সবাই একশ’বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বেছে নেবেন। নতুন মার্কিন ভিসানীতি এসেছে মাস চারেক আগে। কিন্তু মার্কিন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের নানা নীতি ও কৌশলের কথা শুনে আসছি ছেলেবেলা থেকেই। আমরা যখন কলেজে পড়ি, তখন বাংলাদেশেন জন্য প্রথম ওপি-১ ভিসা প্রকল্প আসে। আমি ছাড়া আমার হোস্টেলের বাকি সবাই আবেদন করেছিল। অনেকে ভিসাও পেয়েছিল।

সেই ওপি-১, ডিভি-১-এর সূত্রে বিভিন্ন সময়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হয়েছেন, বদলে নিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য। তারও আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বাংলাদেশের মানুষের কাছে সোনার হরিণ। যেকোনোভাবে একবার আমেরিকা যেতে পারলেই হলো। আমেরিকায় যাওয়ার নানা উপায় আছে, ট্যুরিস্ট ভিসায় যাওয়া যায়, ওপি-১, ডিভি-১-এর কথা আগেই বলেছি, আরেকটি উপায় হলো রাজনৈতিক আশ্রয়। ওপি-১, ডিভি-১ তো লটারির মতো।

ট্যুরিস্ট ভিসা পেতে হলে নিজেকে যোগ্য পর্যটক হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়, পর্যটন শেষে তিনি আবার ফিরে আসবেন, বিশ্বাসযোগ্যভাবে তা উপস্থাপন করতে হয়। আমার এক বন্ধুকে দেখেছি, নিজেকে পর্যটক প্রমাণ করতে মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করার আগে ভারত, নেপাল, ভুটানসহ সহজে ভিসা পাওয়া যায়; এমন সব দেশ ঘুরে ফেলেছেন। এর পেছনে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করেও ভিসা পাননি তিনি। অনেকে পর্যটক হিসেবে নিজের আর্থিক সক্ষমতা প্রমাণ করতে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে নিজের অ্যাকাউন্টে জমা রাখতেন। তবে ভারী পাসপোর্ট, মোটা ব্যাংক ব্যালেন্সেও অনেকে ভিসা পেতেন না। আবার কেউ কেউ হয়তো ভিসা পেয়েও যেতেন। কিন্তু তাদের প্রায় সবার পর্যটন হতো ওয়ানওয়ে। বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্ট কাভার করতে গিয়ে ফিরে না আসার উদাহরণও কম নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে সহজ তরিকা হলো রাজনৈতিক আশ্রয়। আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন বাংলাদেশে আপনার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে আপনি হুমকির মুখে; তাহলে আপনি মার্কিন ভিসা পেতেও পারেন। নব্বইয়ের দশকে একদিন হঠাৎ পত্রিকায় দেখি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক নেতার ওপর হামলার খবর। পত্রিকায় ছাপা হলেও হামলার কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেই নেতা এখন আমেরিকায় নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছেন। এ ধরনের ‘ভুয়া’ হামলার খবর সাধারণত ইংরেজি পত্রিকায় ছাপা হতো, যাতে মার্কিন ভিসা অফিসাররা পড়তে পারেন বা মার্কিন আদালতে উপস্থাপন করা যায়। সব হামলার খবর রিপোর্টার্স ইউনিটির সেই নেতার মতো একেবারে বায়বীয় নয়। কিছু কিছু হামলা হতো পাতানো। বন্ধুবান্ধবদের দিয়ে হামলা করিয়ে বা মামলা করিয়ে ইংরেজি পত্রিকায় ছাপাতে পারলেই হতো। ১৯৯৩ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনের এক কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জে আমার মাথা ফেটে গিয়েছিল। সেদিন জাহানারা ইমামসহ জাতীয় নেতাদের অনেকেই আহত হয়েছিলেন। সাংবাদিকদের মধ্যে আহত হয়েছিলাম একমাত্র আমি।

পরদিন ঢাকার সকল জাতীয় দৈনিকে রক্তাক্ত ছবিসহ আলাদা নিউজ ছাপা হয়েছিল। পরে অনেকে বুদ্ধি দিয়েছিল, সেই নিউজসহ মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করার। আমার রাজনৈতিক আশ্রয় নাকি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু আমার কোনও ইচ্ছা ছিল না। ২০১০ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে সে দেশে সফর করেছিলাম। ফেরার আগে জ্যাকসন হাইটসে অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন, ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা করেছি কিনা। প্রথমে বুঝিনি। পরে জেনেছি, যারা যান তারা অধিকাংশই কোনও না কোনও ব্যবস্থা করে আসেন, যাতে পরে এসে থেকে যেতে পারেন। ওপি-১, ডিভি-১, রাজনৈতিক আশ্রয়, ব্যবস্থা, কোনও কিছুই আমার মন টানেনি। আমি রয়ে গেছি এই বাংলায়।

ইদানীং বিষয়গুলো আরও সহজ হয়ে গেছে। জঙ্গিরা একসময় অনেককেই মৃত্যুর হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠাতো। অনেকে তদবির করে হুমকি ম্যানেজ করতেন। জঙ্গিদের মৃত্যুর হুমকি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য খুব সহজ উপাদান। এমনকি ফেসবুকে হুমকি দেখিয়েও অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত অনেক দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন।

২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আগে-পরে ব্লগারদের ওপর জঙ্গি হামলার পর এই প্রবণতা আরও বাড়তে থাকে। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের অনেকেই এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এমনকি সরকার সমর্থকরাও ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’-এর অস্ত্র ব্যবহার করে উন্নত বিশ্বে আবাস গেড়েছেন। কদিন আগে কানাডার আদালতে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাতে বিএনপি সমর্থকদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

আমার এক কানাডা প্রবাসী বন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, বিএনপি সমর্থকদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ায় ক্ষতি বেশি হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। কারণ, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকেই কানাডায় গিয়ে নিজেকে বিএনপি সমর্থক দাবি করে, ভুয়া কাগজ বানিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতেন। ইদানীং কাউকে ফেসবুকে বিপ্লবী হতে দেখলেই আমার সন্দেহ জাগে, এই বিপ্লব বানানো নয় তো। আমার সন্দেহ সত্যি হতে খুবই বেশি সময় লাগে না। হঠাৎ আবিষ্কার করি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে ভেসে আসে বিপ্লবী কণ্ঠস্বর। আহা, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

এতসব তরিকার মধ্যে মার্কিন ভিসা পাওয়ার নতুন তরিকা আবিষ্কার করলেন সদ্য বরখাস্ত হওয়া ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। শুক্রবার সকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, এমরান আহম্মদ ভুঁইয়াকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর এমরান তার স্ত্রী ও তিন কন্যাকে নিয়ে ‘আশ্রয় চাইতে’ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যান। সেখান থেকে পাঠানো এসএমএসে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আমি মার্কিন দূতাবাসে আজকে (শুক্রবার) পুরো পরিবারসহ আশ্রয়ের জন্য বসে আছি। বাইরে পুলিশ। আজকে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে...। আমার ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে গত ৪-৫ দিন ধরে অনবরত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই সরকার ভালোবাসার প্রতিদান দেয় জেল দিয়ে। আমার আমেরিকার কোনও ভিসা নেই। স্রেফ ৩টা ব্যাগে এক কাপড়ে আমার ৩ মেয়েসহ কোনোক্রমে বাসা থেকে বের হয়ে এখানে বসে আছি। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।’

কিন্তু সেখানে তার আশ্রয় মেলেনি। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দূতাবাসের মূল ফটকের পাশের অভ্যর্থনা কক্ষে অবস্থানের পর সন্ধ্যার দিকে পুলিশ পাহারায় বাসায় ফিরে যান তিনি। অথচ আগের দিনও তিনি জানিয়েছিলেন, তার ওপর কোনও চাপ নেই। তাকে বরখাস্ত করা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা করা হয়নি। এখন মনে হচ্ছে সপরিবারে মার্কিন ভিসা পেতেই তিনি ‘বিপ্লব’ করেছেন। কিন্তু তার এই নতুন তরিকা কাজে আসেনি। এমরান আহম্মদ ভূইয়ারও আর বাংলার ‘আসাঞ্জ’ হওয়া হলো না। ভাগ্যিস নতুন এই তরিকা কাজে আসেনি। নইলে রাতারাতি মার্কিন দূতাবাসের ওয়েটিং রুম বাজার হয়ে যেতো।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাঁটাই ও পলিশ বন্ধ হলে কম দামে চাল কিনতে পারবে মানুষ: খাদ্যমন্ত্রী
ছাঁটাই ও পলিশ বন্ধ হলে কম দামে চাল কিনতে পারবে মানুষ: খাদ্যমন্ত্রী
উচ্চশিক্ষা খাতকে ডিজিটালাইজেশনে আনার পরামর্শ ইউজিসির
উচ্চশিক্ষা খাতকে ডিজিটালাইজেশনে আনার পরামর্শ ইউজিসির
বিটুমিন গলে যাওয়া মহাসড়ক পরিদর্শনে দুদক
বিটুমিন গলে যাওয়া মহাসড়ক পরিদর্শনে দুদক
মিয়ানমারের ৩৮ শরণার্থীকে ফেরত পাঠালো ভারত
মিয়ানমারের ৩৮ শরণার্থীকে ফেরত পাঠালো ভারত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ