X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রত্যাশা কী?

স ম মাহবুবুল আলম
০৭ নভেম্বর ২০২৩, ২১:৩৯আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ২১:৩৯

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার হাতবদলের সুযোগ থাকে। সেই হাতবদলে ভাগ্য পরিবর্তনের আশা জনগণকে নির্বাচনে আগ্রহী করে তোলে। রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহার হতে পারে আশা জাগানিয়া পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি। যা জনগণকে করে তুলতে পারে উদ্দীপ্ত। রাজনৈতিক দলটি নির্বাচনি ইশতেহারে কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তার যৌক্তিকতার (মেরিটের) ওপরই জনগণ তার পেছনে সংঘবদ্ধ হবে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি (এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি) ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন পরিকল্পনা দিতে যথাক্রমে ১২৫, ৮৫ ও ১০৩৭টি শব্দ ব্যবহার করে। কোনও দলেরই নির্বাচনি ইশতেহারে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরির মেধা বা দায় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আমরা দেখে এসেছি– বিগত বছরগুলোতে স্বাস্থ্য খাত কোনও সরকারেরই অগ্রাধিকারে ছিল না। উন্নয়নের যত বড় মহাসড়কে উঠি না কেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতকে গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে না তুললে আমাদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না। বিষয়টি উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই।

মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং এতে সরকারের অংশীদারিত্ব হলো যেকোনও দেশের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার টেকসই আর্থিক ব্যবস্থাপনার দৃঢ় সূচক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য মাথাপিছু ব্যয় হবে ১৪৬ ডলার, যার ৮০-১০০ শতাংশ সরকারকে ব্যয় করতে হবে। সেখানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ৪২ ডলার, যার ৭৩ শতাংশ ব্যক্তির নিজস্ব।

নিজের পকেট থেকে আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বা অসুস্থতা জনিত উপার্জনহীন হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে।

২০১২ সালে প্রণীত স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্রে (২০১২-২০৩২) স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করা ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে ২০৩২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সে সময়ে স্বাস্থ্যসেবা পেতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬২ শতাংশ। বিগত বছরে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে না এগিয়ে উল্টোমুখে চলেছে। সরকার  স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়ন পদ্ধতির স্থলে গত ২৪ বছর ধরে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি) আওতায় পরিচালনা করছে। এই কর্মসূচিভিত্তিক পরিকল্পনা স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পেরেছে তার কোনও নির্মোহ বিশ্লেষণ নেই। এ কর্মসূচিতে দক্ষ জনবল তৈরি, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমানোর কোনও উদ্যোগ নেই।

নির্বাচনকে ঘিরে আজকের সংকট, সংঘাত একসময় স্তিমিত হয়ে যাবে। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণকে তার নিজের প্রয়োজনে ভবিষ্যতের যোগ্য নেতৃত্ব ঠিক করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের মেধা ও শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সীমিত সম্পদের মধ্যে উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার এক উদ্ভাবনী রূপরেখা প্রণয়ন করা। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নে এই সুপারিশগুলো রাখা হচ্ছে–

১. আগামী বছরের বাজেটেই স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি’র ২ শতাংশ বরাদ্দের অঙ্গীকার থাকতে হবে। পর্যায়ক্রমিকভাবে পরবর্তী বাজেটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশকৃত জিডিপি’র ৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

২. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে একটি জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্ম (জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা) গড়ে তুলতে হবে। কোনও খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন ‘অ্যাপস’ নয়। একটি সমন্বিত, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্ম– যেখানে তথ্য ও প্রযুক্তি একীভূত হয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবে।

৩. কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্রে রেখে জনবলের পুনর্বিন্যাস এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শক্ত ও কার্যকর ভিত গড়ে তুলতে হবে।

৪. বাংলাদেশের নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক ঘাটতি ও গলদ বিদ্যমান। বর্তমানে স্থানীয় সরকারের ওপরে ন্যস্ত দায়িত্ব তুলে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে অর্পণ করতে হবে। গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিকের আদলে গরিব ও সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা গড়ে তুলতে হবে।

৫. একটি কার্যকর ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে লক্ষ্যে সরকারকে জেলা হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জেলা হাসপাতালকে সকল বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে বিশেষায়িত সেবা প্রদানে সক্ষম হতে হবে। সব জরুরি চিকিৎসা, জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা (আইসিইউ, সিসিইউ) ও রোগ নির্ণয়ের আধুনিক ল্যাবরেটরি ও ইমেজিং পরীক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে। কোনও রোগীকে যেন জেলা হাসপাতালকে পাশ কাটিয়ে টারশিয়ারি কেয়ারে চলে যেতে না হয়। জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচালনায় আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকতে হবে। তারা পুরো জেলার স্বাস্থ্য তথ্য, প্রশিক্ষণ ও জনস্বাস্থ্যের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণসহ জেলাভিত্তিক স্বনির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দিবে।

৬. আমাদের মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত করতে হবে। এ লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমিকভাবে এগুলোকে নন-প্র্যাকটিসিং করতে হবে। প্রতিবেশী দেশে যে সুযোগ-সুবিধা, বাজেট ও বিধি ব্যবস্থা আছে তার আদলে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে পারি। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে স্বাস্থ্য-শিক্ষা, গবেষণার মতো প্রতিষ্ঠানকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বাইরে আনতে হবে সবার আগে।

৭. একটি কার্যকর, দক্ষ ও শক্তিশালী লজিস্টিক সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা দেশের সর্বত্র চিকিৎসা সামগ্রীর মজুত গণনা ও নিরীক্ষণের মাধ্যমে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করবে। স্বচ্ছ এবং সুনিয়ন্ত্রিত ক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মানসম্মত, সাশ্রয়ী পণ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর মান নিয়ন্ত্রণ ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৮. স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতি, সম্পদের বিপুল অপচয় ও জনভোগান্তি জনগণের আস্থা নষ্ট করছে। দুর্নীতি মোকাবিলায় মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি সামগ্রিক ও কৌশলগত উদ্যোগ নিতে হবে। বাজেট বরাদ্দে দুর্নীতির ঝুঁকির ক্ষেত্রসমূহকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে। আইন, প্রবিধান এবং স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোগত বিন্যাস এমন হবে যেন প্রতিটা স্তরে স্বচ্ছতা, তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ ও জবাবদিহি নিশ্চিত থাকে। দুর্নীতি কমাতে ডাটা ও টেকনোলজিকে প্রধান হাতিয়ার করতে হবে। প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে  উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও চিকিৎসকদের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং বদলির ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯. সরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর ভূমিকা সংকুচিত করে আনতে হবে। সেবা প্রদানকারীর মুখ্য ভূমিকা থেকে সরে এসে সরকারি খাতকে স্বাস্থ্যশিক্ষা, গবেষণা, জনশক্তি তৈরি, মান উন্নয়ন ও তদারকিতে উৎকর্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সেবা প্রাপ্তির সুযোগ, সেবার মান ও ব্যয়ের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপ্তি, উন্নতি ও উদ্ভাবনী শক্তি মিশ্র স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় নতুন ধরনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে।

১০.  কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর সহিংসতা প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুখী স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ছাড়া উন্নত সেবা আশা করা যায় না। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জীবনমান, কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

দেশের দরিদ্র জনগণ রোগ-জরায় ভয়ংকর অসহায়। তারা প্রতিনিয়ত অসম্পূর্ণ ও অপচিকিৎসায় শোষিত এবং শারীরিক ও আর্থিকভাবে বিকলাঙ্গ হচ্ছে। তাদের জন্য ন্যূনতম মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ তৈরি করতে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বাস্থ্য খাতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কনসালটেন্ট, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, এভার কেয়ার হাসপাতাল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিষয়ক কলামিস্ট।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ