X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আগামীর সরকারের কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশা

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:১৪আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:১৪

৭ জানুয়ারি, ২০২৪-এ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রত্যাশার জন্ম নিয়েছে। বিরাজমান রাজনৈতিক দৃশ্যপট দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগ আরেকটি মেয়াদে ক্ষমতায় যাচ্ছে। কারণ, নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় বিএনপি অনুপস্থিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও এটা ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা নির্বাচনি ফলাফলে আধিপত্য বিস্তার করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে।

সকল রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে নিজেদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। সরকারি দলের পক্ষ থেকেও প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। একই সাথে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীরা যদি স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় সে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে দলীয় ফোরামে। এই সিদ্ধান্তটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। কারণ, নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য এবং ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার জন্য এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। একই সাথে উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসবে, যা দলের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সহায়ক হবে।

বর্তমান নির্বাচনের জন্য ঘোষিত প্রার্থী তালিকাতে প্রায় ৭০ জন বর্তমান সংসদ সদস্য মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন পরিপক্বতার প্রমাণ দিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে দলের পক্ষ থেকে যে বার্তাটি দেওয়া হয়েছে তা হলো যে সকল সংসদ সদস্য নিজেদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি, তারা নিজেদের কর্মফলের জন্য মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। তবে, বেশ কিছু আসনে দলের ত্যাগী নেতারা নিজেদের মনোনয়ন বঞ্চিত বলে মনে করছেন। ফলে, এই প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছেন। তবে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার অনুমতি দলের মধ্যে দীর্ঘায়িত অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং মেরুকরণে অবদান রাখতে পারে।

যেহেতু রাজনৈতিক দৃশ্যপট ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বলে মনে হচ্ছে, একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠেছে-  নতুন সরকারের কাছে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা কী? নতুন সরকারের কাছে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিভিন্ন প্রত্যাশা থাকলেও সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও, ভোটাররা নতুন সরকারের কাছে এমন নীতি বাস্তবায়নের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করবে এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে। বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল এবং অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন এবং উপার্জনকে ব্যাহত করছে না, বরং শিল্প উৎপাদনশীলতাকেও বাধাগ্রস্ত করছে, এবং ব্যবসার মালিকদের কার্যক্রম টিকিয়ে রাখার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফলে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অবসানের জন্য জনগণের মধ্যে সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। দেশের উন্নয়নে একটি স্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে, সরকারের উচিত ব্যবসার কলেবর বাড়ানোর  জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, যা শিল্পের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং  বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করবে।

বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে অনেক সমস্যার মধ্যে একটি গুরুতর সমস্যা রয়েছে, যা নাগরিকদের জীবন ও জীবিকাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। এই সমস্যাটি হলো দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উত্থান। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কোভিড-১৯-এর গভীর প্রভাব এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা বেড়ে যাওয়া বাজার মূল্যের অস্থিরতায় অবদান রেখেছে। তবে, এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে স্থানীয় সিন্ডিকেটের ঘৃণ্য ভূমিকা, যার ফলে বারবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নীতিহীন অনুশীলন দেশের অভ্যন্তরে মধ্যম, নিম্ন-মধ্যম এবং দরিদ্র সম্প্রদায়ের  মানুষের জীবন ও জীবিকাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

ফলে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরে তাদের প্রথম কাজ হবে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা। বাংলাদেশের জনগণ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের কাছ থেকে কঠিন পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছে। জনসংখ্যার দুর্বল অংশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক বোঝা কমাতে এবং সবার জন্য আরও ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই জীবিকা গড়ে তোলার জন্য এই সমস্যাটির সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি।

জনগণের জন্য শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নের জন্য ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত জনগণ এমন একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রত্যাশা করছে, যা শিক্ষায় জনগণের সকল অংশের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে, শিক্ষার গুণমান উন্নত করবে এবং বিকশিত চাকরির বাজারের সাথে সঙ্গতি রেখে যুবকদের প্রাসঙ্গিক দক্ষতায় সজ্জিত করবে।

নাগরিকদের প্রত্যাশার আরেকটি পুনরাবৃত্ত বিষয় হলো সুশাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি। সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরির জন্য স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন প্রয়োজন। দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার ব্যাপারে নাগরিকরা আশাবাদী। জনগণের প্রত্যাশা সরকার দেশের সম্পদ দক্ষতা ও নৈতিকতার সাথে ব্যবহার করবে।

যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী হুমকির সৃষ্টি করছে, বাংলাদেশের জনগণ পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। টেকসই উন্নয়ন অনুশীলন, সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এবং দূষণ মোকাবিলায় বিভিন্ন উদ্যোগসহ পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের কাছে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপের প্রত্যাশা রাখছে দেশের জনগণ।

বিশ্বব্যাপী অতিমারি দ্বারা সৃষ্ট চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দেশের জনগণ স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। জনগণের বিভিন্ন প্রত্যাশার মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, এবং দুর্বল সম্প্রদায়ের ওপর অতিমারির আর্থ-সামাজিক প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। ফলে দেশের জনগণ এমন একটি সরকার প্রত্যাশা করে যারা সামাজিক সম্প্রীতি এবং অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করবে। ইতোমধ্যে বর্তমান সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে গত ১৫ বছরে। আগামী দিনগুলোতে সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে এবং বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে- এটিই দেশের বেশিরভাগ মানুষের প্রত্যাশা।
নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক আলোচনা আরও জোরদার হবে। ফলে, এটিই প্রকৃত সময় নাগরিকদের প্রত্যাশা তুলে ধরার। ফলে, জনগণের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে জনগণের এই প্রত্যাশাগুলোকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যা জাতির কল্যাণ ও অগ্রগতিতে অবদান রাখবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে জাতি নতুন রাজনৈতিক যুগের ভোরের অপেক্ষায় রয়েছে।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
দায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস আজদায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
শাহীনের বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পাকিস্তানের সিরিজ ভাগাভাগি
শাহীনের বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পাকিস্তানের সিরিজ ভাগাভাগি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ