X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:১৪আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:১৪

দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনের সময় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সকল সংস্থার ওপর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে নির্বাচন কমিশন। বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্বাচন করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সংসদের নির্বাচন আয়োজনের প্রথাগত পদ্ধতি মেনে চলে। আমারা যদি পাশের দেশ ভারতের নির্বাচনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে নির্বাচন কমিশন কার্যকরভাবে নিরপেক্ষ, ন্যায্য এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভারতের নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিতে অটল থেকে পাঁচ বছর পরপর বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে।

ফলে, নির্বাচনের সময় সকল রাজনৈতিক দল কমিশনের ওপর আস্থা রাখে। ভারতের সকল রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।  

ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাঠামো বিদ্যমান থাকার কারণে নির্বাচন কমিশনকে পর্যায়ক্রমে নির্বাচন আয়োজনের চ্যালেঞ্জিং কাজের মুখোমুখি হতে হয়। ধাপে ধাপে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। সকল নির্বাচনি পর্ব শেষ হওয়ার পরেই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। এটি নির্বাচনি প্রক্রিয়ার গোপনীয়তা ও নিরপেক্ষতা রক্ষার কাজকে ব্যাপকভাবে জটিল করে তোলে। তা সত্ত্বেও, ভারতীয় নির্বাচন কমিশন কার্যকরভাবে দেশব্যাপী সমন্বয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে চলেছে।

নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল সেখানে কখনও উদ্বেগ প্রকাশ করে না। একটি বৈধ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নির্বাচন কমিশনে কর্মরত ব্যক্তিদের ওপর আস্থা রাখা। নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর অটুট আস্থা কমিশনে কর্মরত ব্যক্তিদের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালনে অনুপ্রাণিত করে, যাতে তাদের কার্যক্রমের কোনও সমালোচনা না হয় এবং দেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি উপাদান হয়ে উঠেছে যা সময়ের সাথে সাথে আরও সুসংহত হয়েছে। 

দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের সকল রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়। আমরা যদি ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের কথা স্মরণ করি তবে লক্ষ্য করব যে সেই সময় ভারতের সকল রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে তৎকালীন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতেও ভারতের সম্মান ও প্রতিপত্তি সমুন্নত রাখতে সরকারকে আকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা থাকলেও এবং দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে অনৈক্য থাকলেও তারা সব সময় জাতীয় বিপর্যয়ের সময় ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারে।

তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভারতের থেকে ভিন্ন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমতে পৌঁছানোর মানসিকতার অভাব রয়েছে। তবে এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পেরেছে।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বৈরাচারী পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতির পিতার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল এবং জনগণের ঐক্যের কথা আমরা এখনও স্মরণ করতে পারি। তাছাড়া ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য জন্য সকল রাজনৈতিক দল একমঞ্চ থেকে আন্দোলন করেছিল। সেই সময়ের পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার ঘটনা খুব বেশি দেখা যায়নি।

রাজনৈতিক সমঝোতার ক্রমাগত অনুপস্থিতি নির্বাচন কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার প্রধান কারণ। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সর্বজনীন সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে যখন তারা সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়।

প্রতিবার নির্বাচন কমিশনের গঠনের সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনাস্থা প্রদর্শন করে ধারাবাহিকভাবে একটি বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে এই যুক্তি প্রদান করে যে এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করবে যারা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করবে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটি অত্যন্ত পেশাদার ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং সদস্য হিসাবে বাছাই করলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই ব্যক্তিদের মেনে নিতে পারে না। প্রতিবারের মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হবার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। যাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তারা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র পক্ষ থেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে অস্থায় নেওয়া হয়নি। তাই একটি বিশ্বস্ত নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়িত গঠনমূলক পদক্ষেপগুলো বিরোধীদের চিন্তা-চেতনায় অনুকূল প্রভাব ফেলেনি।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এর দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার নিশ্চয়তা প্রদান করা হলেও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে।

প্রকৃতপক্ষে বিরোধী রাজনৈতিক দল-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং যে কোনও উপায় নির্বাচন প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করার কোনও অবকাশ নেই। কারণ বর্তমান নির্বাচনের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে বিভিন্ন সময় তাদেরকে আলোচনায় বসবার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

বর্তমান কমিশন গঠিত হবার পর থেকে দেশে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তারা তাদের আস্থার পরিচয় দিয়েছে। গাইবান্ধা উপ-নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্তের কথা আমরা এখনও মনে করতে পারি। নির্বাচন কমিশনের সেই সিদ্ধান্তে সরকার খুশি হয়নি।

জাতীয় নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করবার জন্য কমিশন ইতোমধ্যেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে যা জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছে। নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অনুঘটক স্থানীয় সরকার প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বহিষ্কৃত বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ এর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার সময় কয়েক দিন আগে তিনি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার প্রশংসা করে কমিশনের কার্যক্রমকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজের সাথে তুলনা করেছেন।

পরিশেষে বলা যায় যে, দেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কমিশনের এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের সমর্থন। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা কমিশনের প্রধান দায়িত্ব। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। যদি নির্বাচন কমিশন কার্যকরভাবে ব্যাপক ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করতে পারে, তাহলে তাদের কর্মকাণ্ডকে দেশের অভ্যন্তরের সকল অনুঘটক এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সাধুবাদ জানাবে। এটিই বাংলাদেশের সকল জনগণের প্রত্যাশা।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফার্নিচার কারখানায় ৬০০ বস্তা চিনি মজুত
ফার্নিচার কারখানায় ৬০০ বস্তা চিনি মজুত
নির্বাচনে অংশ নিতে জাপার ওপর চাপ ছিল: জি এম কাদের
পরাজয় ঢাকতে অভিযোগ তুলছে বিএনপিনির্বাচনে অংশ নিতে জাপার ওপর চাপ ছিল: জি এম কাদের
কুড়িগ্রামে বিএনপির ৩ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার
কুড়িগ্রামে বিএনপির ৩ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার
বাগদাদে ইরাকি টিকটক তারকাকে গুলি করে হত্যা
বাগদাদে ইরাকি টিকটক তারকাকে গুলি করে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ