X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিরোধী দল ও তাদের ভূমিকা নিয়ে যে অস্পষ্টতা

এম আর ইসলাম
১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:২১আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:২১

সংসদীয় গণতন্ত্রের বা ওয়েস্ট মিনস্টার সিস্টেমের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা হয় ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে। ১৬৮৮-এর গ্লোরিয়াস রেভ্যুলেশন ও ১৭০১-এর অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট সৃষ্টি হয়েছিল রাজতন্ত্র বা ব্যক্তির বা রাজপরিবারের বাড়াবাড়ি কমিয়ে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য। সেই থেকে চলমান এই সংসদীয় গণতন্ত্র পৃথিবীর বহু দেশ গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু কার্যকরী সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে বেশিরভাগ রাষ্ট্রই। এই ব্যবস্থা জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, বছরের বিভিন্ন সময় সংসদীয় অধিবেশনের মাধ্যমে সরকারকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। প্রতিপক্ষের সংসদ সদস্যরা একে-অপরকে প্রশ্নবাণে ও রাজনৈতিক মতামতে জর্জরিত করতে পারে। তাই, সরকার খুব বেশি বেপরোয়া হতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায়, প্রতিষ্ঠা করা যায় আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক চর্চা।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি গভর্নর জেনারেলদের (প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম) শাসনব্যবস্থার কুফল আর স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে ১০ মাসের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন, নিজেই রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা বিলোপ করেন, প্রধানমন্ত্রী বা সংসদীয় ব্যবস্থার সূচনা করেন। অথচ, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হবার পরও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ এখনও শক্তিশালী সংসদ ব্যবস্থা গঠন করতে পারেনি।

২০১৪ সাল থেকে এই সংসদীয় ব্যবস্থা খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর অন্যতম কারণ সংসদে শাসক দলের একচেটিয়া আধিপত্য। যদিও একচেটিয়া সংসদীয় আসন দখলের চর্চা শুরু হয় সেই ২০০১ সাল থেকে, এখনও চলছে তা পুরোদমে।

মূলত ২০০১ সাল থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা দেখা যায়। অর্থাৎ, শুধু সরকার চালালেই চলবে না, বরং দলীয় স্বার্থে যেন সময়-সময় সংবিধান পরিবর্তন করে ক্ষমতা নিরবচ্ছিন্ন করা যায়, তেমন প্রবণতা লক্ষ করা গেছে বড় দুই দলের মধ্যে।

২০০৮-এর নির্বাচনে অল্প কিছু সংসদ সদস্য নিয়েও বিএনপি সংসদে খানিকটা ভূমিকা রাখলেও, কারণে অকারণে, ওয়াকআউট করা ও সংসদের বিরোধী নেতার অনুপস্থিতিতে, আওয়ামী লীগকে সংসদে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। মন্দের ভালো যাও ছিল, তাও ক্ষীণ হয়ে আসে ২০১৪ সালে ‘মেকি বিরোধী দলে’র আবির্ভাবের কারণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি ও তার জোট শরিকরা নির্বাচন বর্জন করলে, আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করে। নির্বাচনের আগেই জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের তকমা পায়। এরশাদ সরকার পতনের পর, যে ‘জাতীয় পার্টি’ শুধু নামেই জাতীয় পার্টি থাকলো, [উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকা (এরশাদের জন্মভূমি হবার কারণে) ছাড়া, যাদের সামগ্রিকভাবে কোনও অবস্থানই ছিল না] রাতারাতি দলীয় ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত পদ-পদবি পেয়ে জাতীয় পার্টির তখন পোয়াবারো। আর জনগণের পক্ষে বিরোধীদলের ভূমিকার বারোটা বাজলো।

২০১৮ সালের ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পুনরায় বিরোধী দলে আসার সুযোগ পায় এবং অনেকটা ‘গৃহপালিত’ অবস্থান নেয়।

সেই পরম্পরা থেকে জাতীয় পার্টি বের হতে পারেনি এবারও (২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনে)। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যখন রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা করছে, তখন সরকারের সঙ্গে ব্যাপক দরকষাকষি করে, জাতীয় পার্টি প্রায় ২৬টি সমঝোতার আসন পায়। তাইতো, সেসব আসনে নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী প্রতিদ্বন্দ্বিতা পাশ কাটাতে নির্বাচনের পোস্টারে লেখে ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত’, আর ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত’। এমনকি কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিও ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। অন্যদিকে, বামদল বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃস্থানীয়রা তো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সাহসই দেখায়নি। যদিও তাদের সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক পেয়েও হেরেছে, আর অন্যদিকে রাশেদ খান মেনন নৌকা প্রতীক ছাড়া যে জিততে পারতেন না, তা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। এমনটা ঘটেছে জাসদের ইনুর ক্ষেত্রেও। তিনি নৌকা প্রতীক নিয়েও নির্বাচনে হেরেছেন। এদের বাইরে ‘ডামি প্রার্থী’ বা ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত যারা নির্বাচন করেছেন, তাদের প্রতিটি জনসভায় বলতে হয়েছে যে তারা মূলত ‘আওয়ামী লীগেরই লোক’, ‘তারাও নৌকা’, ‘তাদের কাছে আছে নৌকার বৈঠা’, ‘তারাও জিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে চান’, অথবা ‘আসনটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে চান’। এমন প্রচারণা, সাক্ষাৎকার মূলধারার মিডিয়ায় অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে।

যেহেতু, নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মূলত আওয়ামী ঘরানার নেতাকর্মীদের মধ্যে, তাই প্রশাসনকে অনেক ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ফলস্বরূপ, প্রায় ৬২টি আসনে জিতেছে আওয়ামী লীগেরই ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী, আর অন্যদিকে জাতীয় পার্টি অনেক কষ্টে পেয়েছে মাত্র ১১টি। এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে, সবাই ভাবছে, কে হবে বিরোধী দল। এখন স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ীরা মূলত চেয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। যদিও সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এমনটা করতে চান না। তবে, অনুমান করা যাচ্ছে হয়তো স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ীরা একটা মোর্চা গঠন করতে পারেন। তবে, বাস্তবে সবই নির্ভর করছে সরকারের হাইকমান্ডের গ্রিন সিগন্যালের ওপর।

তবে, দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল যেই হোক না কেন, খুব বেশি সরকারি সিদ্ধান্ত বিরোধী বিতর্ক সংসদে দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। বর্তমানের রাজনৈতিক পরিকাঠামোতে কার্যকরী বিরোধিতা করার মতো সাহস কয়জন দেখাবে তার ওপর নির্ভর করছে সংসদের সাফল্য। যাদের নির্বাচনে জেতার জন্য বারবারই বলতে হয়েছে তারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই লোক, তারা মূলত নৌকার বিরোধিতা করছেন না, করছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর (ব্যক্তির) সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা,  নির্বাচনে জিততে এমন কৌশল ব্যবহারকারীরা, নির্বাচন উত্তরকালে কতখানি তাদের দলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে, তা নিয়ে আছে সংশয়।

‘আম গাছে কাঁঠাল ফলবে, এমনটা ভেবে গোঁফে তেল দেওয়া’র মানুষ হয়তো খুব বেশি নেই। যদিও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ এসব স্বতন্ত্র এমপির ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না, তা সত্ত্বেও এই আইনগত স্বাধীনতার বাস্তব চর্চা করা তাদের জন্য এত সহজ হবে না। কিছু কিছু বিষয়ে বিরোধিতা করলেও তারা নিশ্চয় শব্দ চয়নে খুবই সতর্ক থাকবেন। কার বিরুদ্ধে বলা যাবে, আর কার বিরুদ্ধে বলা যাবে না, এমনটা নিয়ে তাদের হিসাব কষতে হবে ঢের।

এর আগের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে সংসদে গিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সংসদে তেমন একটা করেননি। যদিও এবার বেশ কিছু উপযুক্ত রাজনীতিক বা পেশাগতভাবে সফল ব্যক্তি স্বতন্ত্র হিসেবে এমপি হয়েছেন, কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক আদর্শের জায়গা থেকে ‘সরকারি’ বা ‘স্বতন্ত্র’দের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য নেই, যেহেতু তারা একই দলের লোক, তাই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব যেমন সরকারের ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিপরীতে বা সরকারের নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার কাজ কে করবে, তা এখনও অজানা। সরকারের সিদ্ধান্তের খুব বেশি বিরোধিতা করে, এমপিরা হয়তো নিজেদের ব্যক্তিগত বা স্থানীয় নির্বাচনি এলাকার উন্নয়নের বরাদ্দ কমাতে বা হারাতে চাইবেন না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন মূলত এখন স্থানীয়-সরকার নির্বাচনের মতো হয়ে গেছে। দল বা মার্কা বা আদর্শের প্রতিযোগিতার পরিবর্তে, এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে। অনেকের কাছে আজ এমপি হওয়াটাই চূড়ান্ত প্রাপ্তি। এমন কয়েকজন সংসদ সদস্য হয়তো ব্যস্ত থাকবেন এমপি হিসেবে তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সুবিধা ভোগের দিকে, যেমন ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি, বিভিন্ন ধরনের ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ, প্লট/ফ্ল্যাট আদায়, বিদেশি বিস্কুটের টিন ইত্যাদি।

জনগণের টাকায় চালিত সংসদ ভবনের প্রতি মিনিটের হাজার হাজার টাকা ব্যয়ের জবাবদিহি কবে আসবে, কে জানে? নিশ্চয়, শুধু আনুষ্ঠানিকতার সংসদ দেশবাসী চায় না। সংসদের হওয়া উচিত গণতন্ত্র চর্চার মুক্তভূমি। তবে, উপযুক্ত বিরোধী দল না থাকলে যেমন নির্বাচন প্রকৃত অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় না, তেমনি সঠিক বা শক্ত বিরোধী দল ছাড়া সংসদ কার্যকর হয় না।    

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ওডেসায় একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ৫
ওডেসায় একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ৫
বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ ইউজিসির
বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ ইউজিসির
‘৭ জানুয়ারি নৌকার প্রার্থীকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’
‘৭ জানুয়ারি নৌকার প্রার্থীকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ