X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সংসদ ভেঙে দেওয়ার নিয়ম ও চর্চা

এম আর ইসলাম
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:১৮আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:৩৮

নিয়োগ আর নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য থাকে! আগে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কর্তা, নতুন চাকুরে বা কর্তা স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার পদে বহাল থাকেন। এমন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নতুনকে বেছে নিতে নিয়োগ কর্তাদের কোনও বেগে পড়তে হয় না। কারণ, নতুন যিনি আসবেন, তিনি সাধারণ মানুষের ভোট বা সমর্থন নিয়ে আসবেন না, আসবেন তার যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার বলে। কিন্তু সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রাণভোমরা লুকিয়ে থাকে রাষ্ট্রের সংসদের ওপর। আর সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া কার্যকর সংসদ পাওয়া সম্ভব নয়। সংসদের আস্থার ওপর টিকে থাকে রাজনৈতিক বা দলীয় সরকার।

বাংলাদেশে সংসদ সদস্য থাকে ৩৫০ জন (সংরক্ষিত আসনসহ)। এই ৩৫০ জন সংসদ সদস্য যদিও আইন প্রণয়নের জন্য মূলত নির্বাচিত, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তারা অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারের অনেক দায়িত্ব পালন করেন। এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করার প্রবণতা কোনও কোনও এমপিদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকাংশই দায়িত্ব বা জবাবদিহিতামূলক নয়, বরং ক্ষমতানির্ভর বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক।

মধ্য যুগে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় (কারণ কোনও আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা তখন ছিল না, সেটা ছিল রাজ্য ব্যবস্থা) সংসদ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল মূলত রাজাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তখন রাজা চাইলে সংসদ বসতো, না চাইলে বসতো না। পরবর্তীতে এই সংসদ ব্যবস্থা ভূমিকা নিতে থাকে রাজতন্ত্রকে সীমিত করার জন্য। ব্রিটেনের এই সিস্টেম তার উপনিবেশগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমরা সিস্টেম গ্রহণ করি বা অন্য দেশের আইনের অনুকরণ করি, তবে তার সৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ করি না অনেক ক্ষেত্রেই। অলিখিত সংবিধানের দেশ, ব্রিটেনে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগে, বর্তমান সংসদকে ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি সাংবিধানিক প্রথা আকারে ছিল। কিন্তু সময়ের প্রক্রিয়ায়, সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি তারা লিখিত আকারে আইন করে নিয়েছে ২০১১ সালে। বাংলাদেশেও সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি সাংবিধানিক আইনের অংশ হিসেবে রয়েছে।

গত দুই জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে প্রশ্ন উঠেছে সংসদ ভেঙে না দিয়ে নির্বাচন দেওয়া যায় কিনা! বাংলাদেশের সাংবিধানিক আইনের আলোকে বিষয়টি নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা হতে পারে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২(১) অনুযায়ী- “সরকারী বিজ্ঞপ্তি-দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করিবেন এবং সংসদ আহ্বানকালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করিবেন (parliament dissolved)”।

অনুচ্ছেদ ৭২ (৩) অনুযায়ী- “রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে (parliament stands dissolved)”।

সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- “সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে”।

একই অনুচ্ছেদের প্রভিসোতে (শর্তে) উল্লেখ করা আছে, নতুন নির্বাচিত এমপিরা পূর্বের সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সংসদ সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করবেন না।    

বাংলাদেশের একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক (সেশন) হয় ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ সালে। অর্থাৎ একাদশ সংসদের ৫ বছর মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। যেহেতু সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, তাই ৭ জানুয়ারি ২০২৪-এ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার মধ্যে কোনও সাংবিধানিক ভুল নেই। কিন্তু একাদশ সংসদ যে কবে ভাঙলো, বা আদৌ ভাঙলো কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ধোঁয়াশা আছে। যদিও সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতেই হবে।

সংসদের ৫ বছর মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার ৯০ দিন আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে, এমন আক্ষরিক আইনি বাধ্যবাধকতা সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

সংসদ ভাঙার মূল ক্ষমতা বাংলাদেশ সংবিধান আসলে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন অনুচ্ছেদ ৭২(১) অনুযায়ী। এই অনুচ্ছেদের প্রভিসোতে উল্লেখ আছে, ‘এই দফার অধীন তাহার দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক লিখিতভাবে প্রদত্ত পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করিবেন।’

এই বিষয়টি আরও সামগ্রিকভাবে প্রমাণিত হয় সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যেখানে বলা আছে যে ‘রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত সকল কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন।’

কিন্তু যদি আদৌ পার্লামেন্ট ভাঙে তাহলে রাষ্ট্রপতি যে সরকারি বিজ্ঞপ্তি/পাবলিক নোটিফিকেশন দিয়ে সংসদ ভেঙে দিবেন তা সংবিধান অনুযায়ী ‘পাবলিক’ হওয়া উচিত। এটা যেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই এই পাবলিক নোটিশ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এই পাবলিক নোটিশ সর্বস্তরের জনগণের ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গোচরীভূত হওয়া প্রয়োজন। কারণ সংসদ ভেঙে যাবার পর এমপিরা এমপি থাকেন না। তাই তারা এমপি হিসেবে কোনও রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে পারেন না, বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা সরকারি কর্মচারীদের কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি বা নির্বাচনে, এমন অন্যায্য প্রভাব দেখা যায় প্রায়। তাই পাবলিক নোটিশ নিয়ে পলিটিক্স হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আরও লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২-এর প্রভিসো (শর্ত) অনুযায়ী, সংসদ ভাঙার এই প্রক্রিয়া কেমন হবে (অর্থাৎ, পাবলিক নোটিফিকেশনের ধরনসহ) তা রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে সম্পাদন করবেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭১(১) অনুযায়ী বলা আছে যে, একই ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততধিক নির্বাচনি এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন না। এই অনুচ্ছেদের মূল বক্তব্য হলো, একটি সংসদীয় আসনে এমপি থাকবেন একজন, আবার একজন ব্যক্তি একাধিক আসনে এমপি হিসেবে থাকবেন না। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়ার পরই অনেকে নিজেকে এমপি ভাবতে শুরু করেন, সেখানে নির্বাচনে জিতলে তিনি যে ক্ষমতা চর্চার জন্য সংসদের প্রথম অধিবেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না, তা বলা বাহুল্য। সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমগুলোতেই নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের এমন অতি উদযাপন বা উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। এই ক্ষমতায়ন আরও প্রকট আকার ধারণ করে তাদের শপথ অনুষ্ঠানের পর।

সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এবং প্রতিটা সংসদীয় আসনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দূর করার লক্ষ্যেই আসলে পার্লামেন্ট ভেঙে নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয়।

সরকারের অসীম ক্ষমতাকে সীমিত করার লক্ষ্যে যে সংসদীয় ব্যবস্থার জন্ম, সেখানে শুধু কালো অক্ষরের সাংবিধানিক আইনের প্রয়োগের বাইরেও সংবিধানের মোরালসকে (সাংবিধানিক নৈতিকতাকে) বা সাংবিধানিক কনভেনশনকে (প্রথা, যা সাংবিধানিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস) গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এতে গণতন্ত্র টেকসই হয়, অগণতান্ত্রিক চর্চা রহিত করা যায়।   

 

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

   

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিআইবির ‘হলফনামা বিশ্লেষণ’ নিয়ে প্রশ্ন আ.লীগ নেতাদের
উপজেলা নির্বাচনটিআইবির ‘হলফনামা বিশ্লেষণ’ নিয়ে প্রশ্ন আ.লীগ নেতাদের
রাইসির মৃত্যুতে লাভ কার?
রাইসির মৃত্যুতে লাভ কার?
বিদেশে অর্থপাচার রোধে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই: সিআইডি
বিদেশে অর্থপাচার রোধে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই: সিআইডি
এক উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৬ প্রার্থী, বিপাকে ভোটার
এক উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৬ প্রার্থী, বিপাকে ভোটার
সর্বশেষসর্বাধিক