X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

৭ মার্চের কাছে ফিরে যাওয়া ও ফিরে দেখা

মো. জাকির হোসেন
০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:১২আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:১২

স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে কয়টি মাইলফলক রয়েছে, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তার মধ্যে অন্যতম। ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণসমূহের একটি হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ Jacob F. Field বিশ্বের সবচেয়ে উদ্দীপক ও অনুপ্রেরণীয় বক্তব্যগুলো একত্রিত করে ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। এ সংকলনে সিসেরো থেকে উইনস্টন চার্চিল এবং আব্রাহাম লিংকন থেকে মাও সে তুংয়ের ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।  

ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর যুগোত্তীর্ণ এ ভাষণ সেই সময় থেকেই বিশ্বব্যাপী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়ে আসছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল’। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা’।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর তৈরি প্রতিবেদনে আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি (পোয়েট অব পলিটিকস) বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রশ্ন হলো, কেন বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি আখ্যায়িত করা হলো? কেন ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার মূল দলিল হিসাবে উল্লেখ করা হলো? কেন ভাষণটিকে মুক্তিকামী মানুষের শাশ্বত প্রেরণার উৎস হিসাবে ভূষিত করা হলো?

অনেক কবি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লেখার উপজীব্য হিসাবে নির্ধারণ করেন। জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে রচিত কবিতা মানুষকে আন্দোলিত, অনুপ্রাণিত করে দেশপ্রেমের দীক্ষায়। ১১ হাজার ৩৮ শব্দের ১৮ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড স্থায়ী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অনুপম কবিতার প্রতিরূপ। ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়ন, নির্যাতন, বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য-অবহেলা ও বাঙালির জীবন উৎসর্গের-আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। অকুতোভয়, পরাক্রমশালী বাঙালির অসীম সাহসিকতা, শক্তি ও বীরত্বের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করেছেন।  দমন, নিপীড়ন কিংবা চাপ প্রয়োগ করে অদম্য বাঙালিকে বশীভূত করে রাখা যাবে না সেই কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলেছেন ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’।  বাংলার মানুষের মনে এই উপলব্ধির স্ফুরণ ঘটিয়ে উত্তুঙ্গ দেশপ্রেম জাগ্রত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠে সাগরের উত্তাল জলরাশির মতো সত্য সুন্দর শব্দের উচ্চারণ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশাল জনস্রোতে। নির্মলেন্দু গুণ যথার্থই লিখেছেন, ‘অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/…’ সমবেত জনস্রোত পেরিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কবিতাসম ভাষণের ছন্দাবৃত আবেদন-আহ্বান। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জেলে, কৃষক, মজুর, শ্রমিক তথা আপামর জনগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কর্নেল তাহের, মেজর মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল)-সহ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তানি কারাগার থেকে প্রহরারত রক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে দুর্গম পথে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

এই ভাষণকে নেলসন ম্যান্ডেলা স্বাধীনতার মূল দলিল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় ৭ মার্চের ভাষণে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য দিকনির্দেশনা পেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো’। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল’।

অন্যদিকে, টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল’।

এএফপি তার বিশ্লেষণে বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই  দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে’। ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণেরই আলোকে’।

৭ মার্চের ভাষণে আন্দোলিত, প্রাণিত ও উদ্দীপ্ত সমগ্র জাতি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার নিমিত্তে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শারীরিক-মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি যুবসমাজকে সংগঠিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধযাত্রা ও প্রতিরোধ করার বল্গাহীন অভিপ্রায়ে মানুষ উন্মুখ হয়ে ওঠে। বয়স, ধর্ম ও বর্ণ এক্ষেত্রে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করতে ইস্পাত কঠিন ঐক্য আবশ্যক।

বঙ্গবন্ধু তাই গ্রামে ও মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। যার দ্বারা তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংঘটিত হতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে, ঐক্য বিনষ্টকারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’।

৭ মার্চের ভাষণটিকে মুক্তিকামী মানুষের শাশ্বত প্রেরণার উৎস বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?  ইন্দিরা গান্ধীর মতে ‘মুজিব ছিলেন নির্যাতিত মানুষের কন্ঠস্বরের প্রতীক’।

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণসমূহের একটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই ভাষণ একটি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে উদ্বুদ্ধ করে এবং জনমনে স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা জাগ্রত করে। এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।

পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা’। ১৯৭১ সালে রয়টার্স তার প্রতিবেদনে বলে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এরকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে’। ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিপাগল মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ, দখলদার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের প্রতিরোধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর এভাবেই মুক্তির মন্ত্রণায় দীক্ষিত বাঙালি দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ত্বরান্বিত করেছিল। একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য প্রস্তুত করা সহজ কাজ নয়। দীর্ঘ, দুরূহ ও দুঃসাহসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণকে প্রস্তুত করতে হয়, যাতে মুক্তির জন্য মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণ বিসর্জন ও আত্মত্যাগ করতে পিছপা না হয়। এ জন্য স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী অগ্রদূতকে দূরদর্শী হতে হয়, অতল ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অদূরদর্শিতা ও হঠকারিতার কারণে পৃথিবীতে বহু মুক্তির সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখেনি। নাইজেরিয়া থেকে আলাদা হয়ে বায়াফ্র স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল।

বাংলাদেশের মতো ৩০ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছিল। এত আত্মত্যাগের পরও পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বায়াফ্রার অস্তিত্ব নেই। পাকিস্তানের বেলুচরা স্বাধীন বেলুচিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের অনেক আগে থেকেই স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিল। বেলুচিস্তান আজও পরাধীন। অদূরদর্শিতা বিশেষ করে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে বহু স্বাধীনতার আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত হযে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বাংলার ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি বাঙালিকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ও হত্যা-নিপিড়ন-জুলুম সত্ত্বেও পাকিস্তানিদের সাথে বারবার শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, বাঙালিরা শান্তির পক্ষে।

অন্যদিকে অন্দোলনকে চূড়ায় ধরে রাখতে শান্তিপূর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হয়ে সব কিছু অচল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর এই দূরদর্শিতার কারণেই মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত হননি, বরং যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বসমাজ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের একদিনের ইতিহাস নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তাঁর লক্ষ্য ছিল।’

পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমর্থন ও সহায়তাপুষ্ট ছিল পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি জাতিকে সংগঠিত করা কতখানি দুরূহ, দুঃসাধ্য, দুঃসাহসিক ও কঠিন কাজ ছিল তা বোধকরি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

সেই ৪৮ সাল থেকে জীবন বাজি রেখে নিজের ও পরিবারের স্বপ্নকে কুরবানি করে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেছেন। বাংলার স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু ৪৬৭৫ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। অন্তত দুইবার মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সোপান ছয় দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতো তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলের নেতারাও ছয় দফার সমালোচনায় মেতে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যায়িত করেন। ডানপন্থি দলগুলো ছয় দফাকে পাকিস্তান ধ্বংস করার ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে অভিযুক্ত করে।

অন্যদিকে, কিছু বামপন্থি ছয় দফার ভিতরে সিআইএ’র সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছয় দফার প্রবল সমালোচনা হয়। দলের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ছিলেন চরমভাবে ছয় দফাবিরোধী। এই বিরোধিতা এতই প্রকট ছিল যে দলের মধ্যেই ভাঙন শুরু হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সব নেতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের আব্দুস সালাম খানের মতো অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে ১৯৬৭ সালের মে মাসে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠন করে। আর পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ তার অনুসারীদের নিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ছয় দফা ঘোষণার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছয়-দফা পক্ষে প্রবল জনমত গঠন করতে না পারলে, গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত না হলে মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য ছিল। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা তথা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে প্রহসনের বিচারে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছিল।

ভারতের গুপ্তচর মোহনলাল ভাস্কর পাকিস্তানি পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। মুক্তিলাভের পর তিনি তাঁর কারাজীবন নিয়ে ‘An Indian Spy In Pakistan’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। মিয়ানওয়ালি কারাগারে আটক থাকার স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘একরাতে আমাদের কারাগারে শেখ মুজিবকে লায়ালপুর কারাগার থেকে আনা হয়েছে।

আমরা শুনেছি, লায়ালপুর কারাগারে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু বন্দি সৈনিক শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য একটি সুড়ঙ্গ কেটেছিল; কিন্তু তারা ধরা পড়ে যায়। সে কারণেই শেখ মুজিবকে এই কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। জেল সুপার ছিলেন চৌধুরী নিসার। তিনি এসে জানান, শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে’। একদিন ডেপুটি সুপার ফাজালদাদ আমাকে ও অন্য সাত জন ভারতীয় বন্দিকে বললেন আট ফুট লম্বা আর চার ফুট চওড়া একটি গর্ত খুঁড়তে। সেই রাতে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হবে। এরপর তাঁকে এই গর্তে কবর দেওয়া হবে। সকাল ৯টা নাগাদ কবর খোঁড়া হয়ে গেলো। আমরা রাতভর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সকালে খবর পেলাম, সেই রাতে মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। পরে শুনেছি, ফাঁসির প্রস্তুতি যখন চলছিল, ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সৈনিক কর্মরত আছে। মুজিবের ফাঁসির খবর সেখানে পৌঁছলে বাঙালিরা তাদের একজনকেও জীবিত রাখবে না’।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে সংগ্রামের রূপরেখা, মানুষের করণীয়, যুদ্ধের কৌশল, গরিব মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য দিকনির্দেশনা, আন্দোলনে শত্রু বাহিনীর অনুপ্রবেশ বিষয়ে জনগণকে সাবধান করা এবং কৌশলী শব্দচয়নে পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।

ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু মুক্তির কথাও বলেছেন। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, বাংলা ভাষা যত দিন থাকবে, বাঙালি যত দিন থাকবে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা যত দিন প্রবাহিত থাকবে, বাঙালির হৃদয়ে আবেগ-অনুভূতি ও উত্তাপ যত দিন থাকবে, তত দিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।

৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, অতল দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এক অদম্য সাহস, শক্তি ও প্রেরণার জ্বালানি ছিল ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য । যা দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে সহায়ক হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই অনুধাবন করেছিলেন পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তার নাগরিকরা মুক্তির স্বাদ পায়নি। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তি দুটো শব্দই সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। ভাষণে স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তি শব্দটা বঙ্গবন্ধু বেশি ব্যবহার করেছেন। হতে পারে এটি গরিব-দুঃখী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন-সাধনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কিংবা বিচ্ছিন্নবাদী চিহ্নিত না হতে কৌশলী শব্দ চয়ন অথবা দুটোই।

ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’ আবার বক্তৃতার শেষে দু’বার মুক্তি শব্দ ব্যবহার করেছেন, প্রথমত: ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’ ও দ্বিতীয়ত: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও আ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। সাম্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পদের বৈষম্য দূর করার মধ্যেই নিহিত স্বাধীনতার আসল সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে’।

বঙ্গবন্ধু যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি এবং সকল প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির কথা কথা বলেছেন, সেই মুক্তি আজও মিলেনি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম এখনও চলমান। মুক্তির সংগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করতে দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী ও জাতিকে বিভাজনকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে। এ থেকে উত্তরণে ঐক্যের শক্তিতে বলীয়ান হতে আমাদের বারবার ৭ মার্চের কাছে ফিরে যেতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও ৭ মার্চকে ফিরে দেখতে হবে নানা আঙ্গিকে।

৭ মার্চের ভাষণকে বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল স্মরণ, সম্মান ও এর গুরুত্ব স্বীকার করে না। ৭ মার্চকে ভুলে গিয়ে, অবজ্ঞা-অবহেলা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বাংলাদেশের পক্ষের হওয়া যায় না।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ