X
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি দ্বিমুখিতা এবং আত্মপ্রতারণা নয়?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা
০৪ মে ২০২৪, ১৭:১৭আপডেট : ০৪ মে ২০২৪, ১৭:১৭

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এখানে পাকিস্তানের মতো একটি নতজানু বা পুতুল একটা সরকার চায়। কিন্তু চাইলেই তো সব আশা পূর্ণ হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরে চেষ্টা করেছিল, বাংলার মাটিতে খুনিদের রায় কার্যকর হয়েছে। পদ্মাসেতু নির্মাণেও বিরোধিতা করেছিল, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সারা বিশ্বে প্রশংসিত। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গ বৈষম্য ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অনেকে ভালোভাবে নিতে পারে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থের বিপরীতে গেলে কোনও দেশকে সন্ত্রাসী, আবার কোনও দেশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। এটা তাদের চিরাচরিত প্রথা। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ এখন বেশ সতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন খবর রয়েছে। গণতন্ত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হর হামেশাই তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রতিবেদন দাঁড় করায়।

বিশ্বের কোন দেশে মানবাধিকারের ধরন কেমন, কোন দেশের পয়েন্ট কত- তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য সংগঠনের প্রতিবেদন লক্ষ করে থাকি। কিন্তু তাদের এই মানবাধিকার প্রতিবেদনের মূল দর্শন তারা নিজেরাই কি অনুসরণ করে কিনা তা নিয়ে সকলের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র করে যাচ্ছে। অথচ প্রতিনিয়ত বিশ্বেও অন্যান্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছেন।

গত ৩০ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকার রিপোর্ট লেখে, কিন্তু আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ হত্যার ঘটনার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং নিন্দা জানান। একজন সাহসী বিশ্বনেতার ভূমিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে মূল্যায়ন করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ মাথা নত না করে বরং তাদের কর্মকাণ্ডের এই সমালোচনাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। আমেরিকায় ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের হামলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন।

অন্য রাষ্ট্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই খবরদারির বিষয়টি কোনোভাবেই বাংলাদেশ সমর্থন করে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাহসী প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের দাঁত ভাঙা জবাব। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। গাজায় ইসরায়েলের অভিযান ও তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ করছেন ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ দমনে ধড়পাকড় হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য নাগরিক তাদের এই দমননীতির বিরোধিতা করেছেন। একজন মহিলা প্রফেসর, যিনি তার নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। অসংখ্য নির্মম নির্যাতনের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের পেটে জোরপূর্বক ইউরোপ থেকে নিয়ে আসা ধর্মান্ধ জায়নবাদী ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল নামক একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর সেই অঞ্চলে বিরামহীনভাবে গণহত্যা আর তার আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ চলছে। সেই গণহত্যাকেও মদদ দেওয়ার জন্য মার্কিন কংগ্রেস সম্প্রতি ইসরায়েলের জন্য ২৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশসহ অন্য দেশের মানবাধিকার নিয়ে খুব সোচ্চার।

তাদের আচরণে সবসময়ই স্ববিরোধী অবস্থান লক্ষ করা যায়। তারা যে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রায়ই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা প্রকাশ করে– তা কি বিশ্ববাসীর জন্য সার্বজনীন? যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি দ্বিমুখিতা এবং আত্মপ্রতারণা নয়? গাজায় গত বছরের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অব্যাহত ইসরায়েলি গণহত্যায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এমনকি অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। যুক্তরাষ্ট্র যে এই গণহত্যা স্পষ্টভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট। মানবিধাকারের এবং গণতন্ত্রের যে বুলি যুক্তরাষ্ট্র দিনের পর দিন দিয়ে চলেছে– তা কি নির্লজ্জতার সামিল নয়? 

বছরদেড়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল চীন। চীনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ওই প্রতিবেদনে চীন বলে, যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধারকর্তা হিসেবে নিজেকে দাবি করে সেই যুক্তরাষ্ট্রেই আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতাসহ সম্পদ কুক্ষিগত করার ঘটনা অতি সাধারণ বিষয়। সেখানে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বাড়ছে এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা সেখানে ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার। চীনের দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদকের অপব্যবহারে আমেরিকানদের মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এ কারণে প্রতিবছর আমেরিকাতে ১০০,০০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায় যে আমেরিকান রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে কাজ করেন। এর ফলে তারা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতি সাড়া দেওয়া এবং সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার ইচ্ছা এবং বস্তুনিষ্ঠ ক্ষমতা হারিয়েছেন এবং মানবাধিকারের নিজস্ব কাঠামোগত নানা সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে।

মার্কিন প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে গত সাড়ে তিন বছরে প্রায় আড়াইশত সাংবাদিককে গ্রেফতার কিংবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর বাইরে শত শত সাংবাদিক বৈষম্য, শারীরিক নির্যাতন, আক্রমণ ও হুমকির শিকার হয়েছেন। মানবাধিকারের মূলনীতি সাম্য ও বৈষম্যহীনতা থেকে আমেরিকা এখনও অনেক দূরে। আমরা আহ্বান জানাবো, নিজেরা আগে মানবাধিকার চর্চা করুন, তারপরও অন্যদের পরামর্শ দেন। তাহলে নিশ্চয়ই সেটি মানানসই হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুম্বাইয়ের হারের পর হার্দিককে নিষেধাজ্ঞা
মুম্বাইয়ের হারের পর হার্দিককে নিষেধাজ্ঞা
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ভাসমান বন্দর হয়ে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানো শুরু
ভাসমান বন্দর হয়ে গাজায় ত্রাণ পৌঁছানো শুরু
বার্সা-মেসির চুক্তির ন্যাপকিন পেপার নিলামে বিক্রি হয়েছে ১১ কোটি টাকায়
বার্সা-মেসির চুক্তির ন্যাপকিন পেপার নিলামে বিক্রি হয়েছে ১১ কোটি টাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক