জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তিত রূপ ক্রমান্বয়ে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি এমন একটি সমস্যা, যা দেশ, জাতি, উপমহাদেশ কিংবা মহাদেশ কোনও কিছুর সীমানা মেনে চলে না। এই কলামটি লেখার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিএনএন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি খবর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে অলিম্পিক আয়োজন করতে পারে এমন শহরগুলোর সবকটিতে অ্যাথলেটিকদের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি তাপমাত্রা থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে অনেক বেশি ভাবতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অসংখ্য নেতিবাচক দিক আলোচনা হলেও অলিম্পিক আয়োজনের ক্ষেত্রে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে, আমরা কেউ কি আগে এমনটি ভেবেছি? এবারের প্যারিস অলিম্পিকের ক্ষেত্রে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঝিরঝির বৃষ্টির বৈরী আবহাওয়াপূর্ণ ছিল। কিন্তু সমাপনী দিনটিও ছিল আরও বৈরী আবহাওয়ার। সেখানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল সেদিন। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন রূপ সদ্য শেষ হওয়া প্যারিস অলিম্পিক আয়োজকদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব আরও বেশি গভীর, প্রকট ও বিপজ্জনক। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে চরমভাবে। অনেক পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের বাস্তুসংস্থান এবং মানুষের জীবনধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে এবং ঘটবে।
বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বাংলাদেশেও গড় তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে (International Centre for Climate Change and Development, 2020)। বিশেষত গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রায় ১.৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়েছে, যা কৃষি, জলবায়ু, এবং জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শীতকালের তাপমাত্রাও কমেছে, যা ফসলের চক্র এবং প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যার ফলে কৃষকরা তাদের চাষের সময়সূচি পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে এবং ফসলের মানও হ্রাস পাচ্ছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি মূলত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে ঘটছে, যা মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে সৃষ্ট। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই পড়ছে এবং তা ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। দেশটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিম্ন অবস্থান এবং জলবায়ুগত বৈচিত্র্যের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সরাসরি বিভিন্ন পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলাশয়ে পানির স্তর কমে যাচ্ছে এবং মিঠা পানির সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষির জন্য ব্যবহারযোগ্য পানি কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
তাপমাত্রার এই উভমুখী পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গ্রীষ্মের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গরমজনিত অসুস্থতা এবং তাপমাত্রা সম্পর্কিত রোগ, যেমন- ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক এবং তাপমাত্রাজনিত হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, শীতকালের তাপমাত্রা হ্রাসের ফলে শ্বাসতন্ত্রের রোগের ঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে।
এছাড়া ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, এবং অন্যান্য মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কারণ উষ্ণ তাপমাত্রা মশার প্রজননক্ষেত্র বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে, বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে। দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য বৃদ্ধি হলেও তা দেশের বৃহৎ অংশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ৩.৩ মিলিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে (Bangladesh Meteorological Department, 2019)। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে এই হার আরও বেশি, প্রায় ৫ থেকে ৭ মিলিমিটার পর্যন্ত।
উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ এই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষদের প্রধান জীবিকা কৃষি, মৎস্য এবং লবণ চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ছে, যার কারণে ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। এছাড়া মিঠা পানির উৎসগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়ছে, যা মানুষের পানির চাহিদা পূরণে সমস্যা সৃষ্টি করছে। মৎস্য চাষের ক্ষেত্রেও লবণাক্ততার কারণে প্রজাতির পরিবর্তন ঘটছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ এবং তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় একটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারা আরও তীব্র হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে এবং এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে চলে যেতে পারে, যার ফলে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে (World Bank, 2020)। এই বাস্তুচ্যুত মানুষদের একটি বড় অংশ শহরমুখী হবে, যা শহরের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। ঢাকার মতো প্রধান শহরগুলোতে ইতোমধ্যে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি এবং এই ধরনের জনসংখ্যার প্রবাহ আরও সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে নদীভাঙনের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা নদী এলাকার লোকজন প্রতি বছর নদীভাঙনের ফলে তাদের বসতভিটা হারাচ্ছেন। প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মানুষ নদীভাঙনের কারণে তাদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছেন (Center for Environmental and Geographic Information Services, 2021)। এসব মানুষদের পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠনের জন্য প্রতিবছর বিশাল অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সরকারকে।
তাছাড়া বাংলাদেশের বাঁধ এবং সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলোও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাঁধগুলো আরও বেশি শক্তিশালী এবং উঁচু করা না হলে, সমুদ্রের জল প্রবাহিত হয়ে আরও বড় এলাকার ক্ষতি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে এবং এগুলোর ব্যাপক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিকীকরণ বা পুনর্গঠন প্রয়োজন হবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির এই প্রভাবগুলো শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং বিশ্বের নিম্নাঞ্চলীয় এবং উপকূলীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জন্যও গভীর উদ্বেগের বিষয়। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে রক্ষা করতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। বাংলাদেশকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। বর্ষাকালের সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৯৫৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (BUET-Institute of Water and Flood Management, 2018)। তবে এই বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে উঠছে, যার ফলে বন্যা এবং খরার প্রবণতা বেড়েছে। বর্ষাকালের বৃষ্টিপাত এখন অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, অর্থাৎ অল্প সময়ের মধ্যে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই ধরনের কেন্দ্রীভূত বৃষ্টিপাত একদিকে যেমন কৃষিক্ষেত্রে বন্যা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে দেশের কিছু অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে খরা দেখা দেয়। এর ফলে, দেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। বর্ষাকালের এই অনিয়মিত বৃষ্টিপাত কৃষকদের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কারণ তারা ঠিকমতো ফসল ফলাতে এবং উৎপাদনের পূর্বাভাসও দিতে পারছেন না।
বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার প্রবণতা বেড়েছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে দেশের ৬৮ শতাংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল এবং অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। এই বন্যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছিল। কারণ কৃষি জমি, অবকাঠামো এবং বাসস্থানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এই ধরনের দুর্যোগের পরপরই খরা দেখা দেওয়া একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে, যা কৃষকদের জন্য এক অস্থির চক্র তৈরি করেছে।
বন্যার ফলে কৃষিজমি ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি নদীগুলোর পাড় ভেঙে যায়, যার ফলে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং নতুন ভাঙন এলাকা তৈরি হয়। এই ভাঙনের ফলে হাজার হাজার মানুষ তাদের জমি হারায় এবং বাস্তুচ্যুত হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনিয়মিত হওয়ায় দেশের পানি ব্যবস্থাপনাতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। একদিকে যেখানে অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা দেখা দেয়, অন্যদিকে কম বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের কিছু অংশে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা কৃষি এবং পানীয় জলের সংকট তৈরি করছে।
এছাড়া এই পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন দেশের জনস্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং বন্যার কারণে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে, যেমন- ডায়রিয়া, কলেরা, ও ম্যালেরিয়া। অন্যদিকে, খরার সময় পানির অভাবে এবং তীব্র গরমের কারণে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যেমন- ডিহাইড্রেশন এবং তাপপ্রবাহজনিত অসুস্থতা।
বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের একটি উদাহরণ, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও জটিলতা তৈরি করছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তনগুলো আরও তীব্র হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের পাশাপাশি, বাংলাদেশকে স্থানীয় পর্যায়ে পানি সংরক্ষণ, ফসলের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় এবং স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ নদীভাঙনের কারণে তাদের জমি হারাচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে (Center for Environmental and Geographic Information Services, 2021)। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা নদী এই ভাঙনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। দেশের কৃষি অর্থনীতি প্রধানত ধান, গম এবং অন্যান্য প্রধান শস্যের উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। তবে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং অন্যান্য জলবায়ুগত পরিবর্তনগুলো দেশের কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গুরুতর প্রভাব ফেলছে।
ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষ ধান চাষের সঙ্গে যুক্ত। তবে, ধান উৎপাদনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গড়ে ১০ শতাংশ হ্রাসের আশঙ্কা করা হচ্ছে (Food and Agriculture Organization, 2019)।
বিশেষ করে বোরো ধানের উৎপাদন ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ কমে যেতে পারে (Food and Agriculture Organization, 2019)। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধানের ফসল কাটার সময় এবং ফলনের গুণগত মানে প্রভাব পড়ছে। উষ্ণ তাপমাত্রা ধানের ফুল ফোটার সময়কালকে সংকুচিত করছে এবং ফলস্বরূপ ধানের দানা হালকা এবং পুষ্টি কম হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলোর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
গম বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গম উৎপাদন প্রায় ৩২% হ্রাস পেতে পারে (Food and Agriculture Organization, 2019)। গম সাধারণত ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভালো ফলন দেয়, কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গমের চাষ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গমের বীজের অঙ্কুরোদগম কম হচ্ছে এবং ফসল কাটার সময়কাল কমে যাচ্ছে। এর ফলে ফলনও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। গমের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হলো রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কিছু নতুন রোগ এবং পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে, যা গমের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করছে। কৃষকদের অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা কৃষিকাজের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং মাটির গুণগত মান নষ্ট করছে।
এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ধানক্ষেতের মাটির আর্দ্রতা হ্রাস করছে, যা ফলন কমানোর অন্যতম প্রধান কারণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে, যা সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করছে। এর ফলে কৃষকদের ফসলের জন্য বেশি সেচের পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা কৃষিকাজের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ফলন কমিয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু ধান এবং গমেই সীমাবদ্ধ নয়; শাকসবজি, ফলমূল এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসলেও এর প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, রসুন, আলু এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ফলন কমে যাওয়ার পাশাপাশি ফসলের গুণগত মানেও পরিবর্তন আসছে, যা বাজারে কৃষকদের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা হ্রাস করছে।
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের একটি বড় দিক হলো মাটির উর্বরতা কমে যাওয়া। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মাটির গুণগত মান এবং আর্দ্রতা হ্রাস পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষিক্ষেত্রের জন্য একটি বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে মাটির পুনরুজ্জীবনের জন্য অতিরিক্ত সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা কৃষিকাজের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ফলন কমিয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষরা তাদের বাড়িঘর হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে জলবায়ু শরণার্থী হতে পারে (World Bank, 2020)। এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। দেশের জিডিপি প্রায় ২ শতাংশ কমে যেতে পারে ২০৫০ সালের মধ্যে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা না হয় (World Bank, 2020)। কৃষি, মৎস্য এবং বস্ত্রশিল্প, যা দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং দারিদ্র্যের হার বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব বিবেচনা করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির সংকটও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ পানির অভাবে কষ্ট পেতে পারে (World Resources Institute, 2019)।
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীতে পানির প্রবাহ হ্রাস দেশের পানি সরবরাহে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এই সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী নদীগুলোর ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, তবে এটি যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি, বিশেষ করে কৃষি, শিল্প এবং পরিবহন খাতে। এছাড়া, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং বিদ্যমান শক্তি উৎসগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন (International Centre for Climate Change and Development, 2020)। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় এই কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে এবং উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, বাঁধ এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সহায়তা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রযুক্তি এবং অর্থায়ন সহায়তা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন (World Bank, 2020)। প্যারিস চুক্তি ও অন্যান্য বৈশ্বিক উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করছে। বনায়ন কার্যক্রম বাড়ানো এবং বিদ্যমান বনভূমির সংরক্ষণ নিশ্চিত করা জরুরি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে দেশের বনভূমির আয়তন প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি জাতীয় বনায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা জনগণের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করবে (Food and Agriculture Organization, 2019)। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় এই কার্যক্রমগুলোকে আরও বেগবান করা যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জলবায়ু শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এছাড়া বিভিন্ন মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। বৈশ্বিক শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর সহায়তায় জনসচেতনতা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করা যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তব এবং জটিল সমস্যা, যার সমাধান এককভাবে সম্ভব নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক সংকট, যার মোকাবিলায় সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ একটি নিরাপদ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে এখনই সময় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদের সচেতন করতে হবে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ নতুন বাংলাদেশ পায়।
লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান এবং ডাটা সায়েন্স, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।