এই যে কথায় কথায় আমরা ‘একুশের চেতনা’ কথাটা বলি, এর অর্থ কতটা বুঝি আমরা?
একুশের চেতনা মানে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা, বাংলায় কথা বলা, বাংলা বাংলা করে পাগলামি করতে থাকা – এসব নয়। আমরা প্রায়ই অনেক’কে বলতে শুনি যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেটা ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তারা উদাহরণ দেন- ইংল্যান্ডের মানুষের ভাষাকে বলে ইংলিশ। জার্মানির মানুষের ভাষা জার্মান, স্পেনের মানুষের স্প্যানিশ, হিন্দুস্তানের মানুষের ভাষা হিন্দি। অর্থাৎ আগে দেশ, তারপর সেই দেশের ভাষা। কিন্তু এখানে বাংলাদেশের মানুষের ভাষা বাংলাদেশি নয়, বরং বাংলা ভাষাভাষীদের দেশের নাম বাংলাদেশ, অর্থাৎ এটা বাংলার দেশ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, অন্য সব দেশের ক্ষেত্রে দেশগুলো আগে, ভাষা তার পরে। দেশের নামেই ভাষার নামকরণ হয়েছে। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভাষা আগে, দেশ পরে। অর্থাৎ ভাষার নামে নামকরণ করা হয়েছে দেশের।
কিন্তু এই দাবিটা মোটেই সঠিক নয়। ইংল্যান্ড রাষ্ট্রের বয়স কত, আর ইংলিশ ভাষার বয়স কত? জার্মানি দেশটার জন্ম আগে, নাকি জার্মান ভাষার? ... বঙ্গ, বাঙ্গালা এই নামগুলোর বয়স কত, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? তাই এই যুক্তিতে ফাঁক আছে। যুক্তিবিদ্যার ভাষায় একে বলে অনুপপত্তি। আরব দেশের ভাষা আরবি, কিন্তু আরবি ভাষার উৎপত্তি আরবের প্রতিষ্ঠার বহু বহু আগে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম অনেক পরে। এই তো, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। যেহেতু অনেক অনেক পরে প্রতিষ্ঠা, তাই এই দেশের বেলায় দেখেশুনে নামকরণ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বাকি যেসব বড় বড় জাতি ও ভাষার কথা এখানে বলা হয়েছে, সেগুলো এত প্রাচীন যে, ভাষার কারণে জাতির নাম, নাকি জাতি অনুসারে ভাষার নাম – সেটা আবিষ্কার করা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। সে প্রসঙ্গ থাক। আমরা একুশের চেতনা নিয়ে কথা বলি।
একুশের চেতনা ব্যাপারটা আসলে কী?
প্রথমত, এটা কোনো ‘ব্যাপার’ নয়। ব্যাপার মানে কী? ব্যাপার মানে ব্যবসা। ব্যবসায়ীদের ব্যাপারী বলা হয়। ... অনেকের কাছে চেতনা একটা ব্যবসাই বটে, সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। আমার কাছে একুশের চেতনা হলো, অধিকারবোধের চেতনা। স্বাধিকার। একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিলো, স্বাধীনতার আন্দোলন নয়। আবার অন্য অর্থে, সেটা স্বাধীনতারই আন্দোলন ছিল। ব্যাপারটা কিন্তু এমন ছিল না যে, পাকিস্তানের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাটা বাদ পড়ে যাচ্ছে কেন, তা নিয়ে আন্দোলন। বরং আন্দোলনটা ছিল, পাকিস্তানের সংবিধানে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হচ্ছে না কেন? সাতচল্লিশের দেশভাগের পর যে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, তার ডেমোগ্রাফি কি খেয়াল করেছি আমরা? বাঙালি সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। দুই পাকিস্তান মিলিয়ে।
হ্যাঁ, অধিকাংশ বাঙালির অবস্থান পূর্ব পাকিস্তানে ছিল বটে, কিন্তু এই পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ওই জনসংখ্যার পুরোটাই যে আবার উর্দুভাষী ছিল, তাও নয়। উর্দু একটি মাইনরিটি ভাষা ছিল পাকিস্তানের। সিন্ধ্, বালুচ, পাঞ্জাবি, পাশতুন... অনেকগুলো ভাষা, যার সবগুলোর ভাষাভাষী উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ! তাহলে উর্দুকেই কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলো তখনকার সরকার? ১৯৫১ সালে উর্দু ছিল কেবলমাত্র সিন্ধু প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ, তাও সেটা উত্তর ভারতের উর্দুভাষী ১২ লাখ মানুষের সিন্ধু প্রদেশে মাইগ্রেশনের পর। সাতচল্লিশের দেশভাগের কারণে কেবল পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে, তা তো নয়। পশ্চিম পাকিস্তানেও ব্যাপক ওলটপালট হয়েছে। কয়েক লাখ শিখ এবং হিন্দু চলে গেছে সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনওয়ালা থেকে। ওপার থেকেও এসেছে উর্দুভাষী উত্তর-ভারতীয় এলিট সম্প্রদায়। এটা হতে পারে যে, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্’র এক রকম অলিখিত চুক্তিই ছিল ওই এলিট উর্দুভাষীদের সাথে, যাতে তারা নতুন বসতিতে এসে নিজেদের কিছুতেই অরক্ষিত মনে না করেন, সে জন্যই, মাইনরিটি হওয়া সত্ত্বেও তাদের ভাষাটাকেই রাষ্ট্রের প্রধান এবং একমাত্র ভাষা হিসেবে ডিক্লেয়ার করে দেন জিন্নাহ্।
অর্থাৎ, গুটি কয়েক, মানে সব মিলিয়ে মাত্র কয়েক লাখ মানুষের কারণে চার কোটির বেশি বাঙালিকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্!
আমরা ছোট থেকে শুনে আসছি, পাকিস্তানের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতো ১২ কিংবা ২৪টি পরিবার? সঠিক সংখ্যা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, তবে জরুরি হচ্ছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশকে গুটিকয় পরিবার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের বাঁচামরা, খাওয়াপরা সবকিছুর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ওই অল্প ক’টা পরিবার। তো, এই এলিট পরিবারগুলোর সবগুলোই ছিল উর্দুভাষী। এবং তারা অধিকাংশই এই নয়া পাকিস্তানের ভূমিপুত্র ছিল না। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে তাদের দেশ বদলে গেল সাতচল্লিশে। জিন্নাহ্ তাদের সবাইকে যাকে বলে হ্যান্ড পিকড, সেই কায়দায় পাকিস্তানে নিয়ে এলেন। শিল্প-বাণিজ্যের সব ব্যবস্থা করে দিলেন। তার একটাই কথা, এই লোকগুলো কেবল নিজেরা থাকতে আসেননি পাকিস্তানে, বরং তাদের ধন-দৌলতও নিয়ে এসেছেন সাথে। এরা চলে গেলে ফাঁকতালে পাওয়া এই দেশটাকে গড়ে তোলার কোনও ব্যবস্থা হবে না। টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল। তাই টাকাওয়ালাদের মাথায় করে রাখতে হবে। তারা যা চাইবে, তাই করতে হবে। সেটা করার জন্য সবার আগে যা করতে হবে, তা হলো, এদের নিশ্চয়তা দেওয়া যে, এটা আপনাদেরই দেশ, আপনাদের কথায় চলবে দেশটা। বাকি সবাই আপনাদের প্রজা, আপনারাই প্রভূ। এই এলিটদের কেউ কখনও রাজনীতিতে জড়াননি, কুরসি নিয়ে মাথা ঘামাননি। কিন্তু দেশের রাজনীতির হাওয়া যেদিকেই বইতে থাকুক না কেন, তাদের পালে সেই হাওয়াকে প্রতিফলিত করা সরকার এবং রাজনীতিক ও কুটনীতিকদের কাজ – এই ছিল মোদ্দা কথা। জিন্নাহ্ ঠিক এই কারণেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
এবার যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, তাহলে একুশের চেতনাটা ঠিক কী দাঁড়াচ্ছে?
খুব সহজ। একজন বা এক পরিবার বা গুটিকয়েকের ইচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে বাকি সবাইকে বঞ্চিত করা কেবল স্বৈরতন্ত্রই নয়, এটা ফ্যাসিবাদ। একুশ স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে। একুশে ফেব্রুয়ারি হতে পারে ভাষা আন্দোলনের স্মারক, কিন্তু একুশ মানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই কেবল নয়। একুশ মানে তাই স্বাধিকারের আন্দোলন, আত্মমর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। গণতন্ত্রের আন্দোলন। এবং একুশ হলো ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদগুলোর একটি।
জিহাদ? একুশ এবং জিহাদ - দুটো কি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক নয়?
একদমই তা নয়। জিহাদ কাকে বলে? জিহাদ কার বিরুদ্ধে করা হয় বা করা যায়? জিহাদ মানেই তো ‘কাফের-কতল’ নয়। বরং আমাদের জানা থাকা আবশ্যক যে, ইসলামি খিলাফতের শর্ত হলো – খলিফা ন্যায়চ্যূত হতে পারবেন না, তিনি প্রজাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি যৌক্তিক কারণ না দর্শিয়ে নাকচ করতে পারবেন না, প্রজারা চায় না বা তাদের জন্য ক্ষতিকর এমন বিধান চাপিয়ে দিতে পারবেন না। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার মাধ্যমে খিলাফতের সবগুলো শর্ত ভঙ্গ করেছিলো। তাই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, বিদ্রোহ করা ফরজ হয়ে গিয়েছিলো। পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষে পাকিস্তানের জনগণ জুলুমবাজ শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়েছিলেন। গুটিকয় মানুষকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে ন্যায়চ্যূত সরকার ইসলামি খিলাফতের শর্ত ভঙ্গ করেছিলো। যে শাসক ইসলামি খিলাফতের শর্ত রক্ষা করতে পারে না – তা অবৈধ হয়ে যায়। আর এমন অবৈধ শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরোধিতা করাটাই হলো জিহাদ। তাই, একুশ এবং জিহাদ – মোটেই সাংঘর্ষিক নয়।
কিন্তু আমরা এভাবে ভেবে দেখি না বিষয়টা। আর একুশের চেতনার সাথে সবচেয়ে সাংঘর্ষিক কিছু যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা বরং এই ‘ভেবে না দেখা’র চর্চাটা। একুশ আমাদের ভাবতে শেখায়। জানতে শেখায়, চিনতে শেখায়। নিজেকে, নিজের অধিকারকে, নিজের চেতনাকে, নিজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দেশ, মাটি-মানুষ, জাতীয়তা, স্বকীয়তা, স্বাধীনতা – সবকিছুকে। আমরা এর কিছুই কি চিনতে চেষ্টা করছি? জানতে চেষ্টা করছি? আমরা কি আদৌ কিছু ভেবে দেখছি? তাহলে একুশের চেতনাকে কতটা সমুন্নত রাখতে পারছি আমরা? বরং আমরাই কি একুশের চেতনাকে সবচেয়ে বেশি অবমাননা করছি না?
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও উন্নয়ন গবেষক